শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

শূণ্য হৃদয় !

হৃদয়কে শূণ্য করতে হবে। পূর্ণ পাত্রে কিছু ঢুকাতে চাইলেও আর ঢুকানো যাবেনা। হৃদয় পবিত্রকরণের জন্য তাই সর্বপ্রথম বিভিন্ন কৃত্তিম বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়কে শূণ্য করতে হবে। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হল একত্ববাদ বা তাওহীদ। সেই একত্ববাদের মুল ভিত্তি হল হৃদয় শূণ্য করা।

কাউকে যদি ভালবাসি তাহলে প্রথম শর্ত হল ভালবাসার সেই দাবিতে অন্য কারো হক থাকবেনা। সামান্য প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসায় যদি তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে তাহলে ভালবাসায় ফাটল ধরে। আর যিনি পুরা বিশ্বজাহানের অধিকারি তার প্রতি ভালবাসার নিরংকুশ অধিকারে অন্য কারো দাবি থাকা সাধারণ সেন্সেও অযৌক্তিক লাগে। তাই বান্দার একচ্ছত্র শর্তহীন সীমাহীন ভালবাসার একমাত্র দাবিদার সেই বিশ্বজাহানের মালিক ছাড়া আর কার হতে পারে?

হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে যখন বৃদ্ধ বয়সে তার প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কুরবানি করতে বললেন তখন তো ব্যসিক্যালি আল্লাহ দেখছিলেন ভালবাসা কার প্রতি বেশি। সন্তানের প্রতি নাকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি? আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ) এর হৃদয়কে শূণ্য করলেন পার্থিব ভালবাসা থেকে। তাওহীদের বানী গেঁথে দিলেন।

ইসলামের ৫টি মূল ভিত্তির মেইন থিম হল যাবতীয় সকল পার্থিব বিষয় হতে হৃদয় শুণ্য করা। কলেমার প্রথম বাক্য হল কোন ইলাহ নেই। আমাদের কে অনুভব করতে হয় এই জগতে কোন ইলাহ নেই, কোন ক্ষমতাশীল নেই যে এই জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আকাশ ও পৃথিবী মন্ডলে এমন কেউ নেই যার কাছে সবকিছু জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের হৃদয় শূণ্য করা হল কলেমার এই প্রথম বাক্য দিয়ে। এরপরই বলা হল, একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত। অর্থাৎ কোন ইলাহ নেই একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত। হৃদয়কে শূণ্য করেই সেই শুণ্য হৃদয় আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হল।ময়লা-আবর্জনা দিয়ে পূর্ণ পাত্র পরিষ্কার করতে হলে সর্বপ্রথম সেই পাত্র খালি করতে হয়। তদ্রূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস, পার্থিব আবেগ, মোহ, ভালবাসা সবকিছুকে পিছনে ফেলে কেবল এক আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়। এক আল্লাহর প্রতি সমগ্র বিশ্বাস, ভালবাসা,নির্ভরতা দিয়ে হৃদয়কে পূর্ণ করতে হয়।

এরপর নামাজ। এখানেও হৃদয় শুণ্য করতে হয় সর্বপ্রথম। আমি সারাদিনে পাঁচবার যখন আল্লাহকে স্মরন করি তখন আমি যত কাজেই থাকিনা কেন, যত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকুক না কেন সবকিছুকে ইগনোর করে হৃদয়কে কেবল আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। পার্থিব সব চাহিদা,প্রয়োজনীয়তা থেকে হৃদয়কে শূণ্য করে সেই এক আল্লাহর প্রতি ভালবাসা দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করতে হয়। দিনে হয়ত একবার সময় করে নামাজ পড়লেই হয়ে যেত। কিন্তু ভালবাসার দাবিতে সকাল,দুপুর,বিকাল,সন্ধ্যা,রাত অর্থাৎ সমগ্র দিন-রাতে আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। একত্ববাদ দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করার জন্য পাচবার হৃদয়কে শূণ্য করতে হয়।

সাওম বা রোজা। এটা তো হৃদয় শূণ্য করার একদম বাস্তব প্র্যাকটিস। শারীরিক,মানসিক,জৈবিক সব চাহিদা থেকে বিরত থাকতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও পারবনা একটিবারের জন্য সামান্য পানি পান করতে। সমগ্র ইচ্ছার অধীন একমাত্র আল্লাহ। তার জন্য ইচ্ছাকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। লুকিয়ে, গোপনে হয়ত অনেক কিছুই করা যায় কিন্তু যখন এটা বিশ্বাস করা হয় যে প্রকাশ্য ও গোপন কোন কিছুই তার অজানা নয় তখন সমগ্র পার্থিব ইচ্ছা দিয়ে পরিপূর্ণ হৃদয়কে রিক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সেই রিক্ত হৃদয় পূর্ণ করতে হয়।

সম্পদের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা কে যাকাত দিয়ে মিনিমাইজ করতে হয়। সম্পদের প্রতি ভালবাসা ত্যাগ করতে হয়। সেই কিয়ামতের দিন যখন পার্থিব সোনা-রূপা কোন কাজেই আসবেনা তখন এই পৃথিবীতে পার্থিব সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার আর কি মানে রইল? যারা অভাবী, খেতে পায়না দু’মুঠো, এতিম,মিসকিন সবার প্রতি নিজের কষ্টে অর্জিত সম্পদ থেকে ভাগ দিতে হয়। কি এত দায় পড়েছে তাদের আমি যাকাত দিব? কষ্ট করে আমি সম্পদ উপার্জন করেছি। আমার সম্পদে তাদের কেন হক থাকবে? এই পার্থিব সম্পদের প্রতি ভালবাসা পুর্ণ হৃদয়কে পুনরায় শূণ্য করতে হয়। সম্পদের পরিপূর্ণ যাকাত আদায় করে শূন্য হৃদয় আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে পূর্ণ করে নিতে হয়।

বছরে একবার হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। আমি অনেক হাই স্ট্যাটাস মেইনটেইন করি। আমার ফ্যামিলি, আমার পড়াশুনা, আমার চাকরি সবকিছুই অনেক বেশি প্রেস্টিজিয়াস। তাই অবশ্যই আমার আর একজন সাধারণ মানুষের সাথে পার্থক্য থাকবে ড্রেসে,গেটআপে, চলাফেরা, কথা-বার্তা সবকিছুতে। হজ্ব আমাদের এই হাই স্ট্যাটাস,সুপিরিয়রিটি সিন্ড্রোমে পূর্ণ হৃদয়কে শূণ্য করে। এখানে সবাইকে এক পোশাকে, একই কাতারে, একই গেটআপে এক আল্লাহর জন্য দাঁড়াতে হয়। কোন ভেদাভদেদ করা যায়না কে সুপিরিয়র কে ইনফিরিয়র। আমাদের হৃদয়কে শূণ্য করা হয় এভাবে যে পার্থিব এই সুপিরিয়রিটি আল্লাহর সুপিরিয়রিটির কাছে কিছুইনা। শুধু মানসিকভাবে কন্ডিশনিং হয় তা নয়। সম্পদের মোহ ত্যাগ করে, পার্থিব সময়ের গুরুত্ব ত্যাগ করে, শারীরিক আরাম-আয়েশের সুযোগকে পিছনে রেখে এক আল্লাহর জন্য অনেক হাই স্ট্যাটাস হওয়া সত্ত্বেও খুব লো স্ট্যাটাসের কারো পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অনুসন্ধান করতে হয়। হৃদয়কে কত সুচারুভাবে এক হজ্বের মাধ্যমে শূণ্য করে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করা হয়।

পার্থিব জিনিসে পূর্ন হৃদয় আল্লাহর ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করা যায়না। এজন্য বলা হয়েছে যারা বিশ্বাস করেনা তাদের যতই শুনানো হোক তারা শুনবেনা, তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। কারণ তাদের হৃদয় অলরেডি ভ্রান্ত বিশ্বাস,মোহ,ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ। একমাত্র তারাই আল্লাহর ভালবাসা , অনুগ্রহ পেতে পারে যারা সেইসব ভ্রান্ত বিশ্বাস, পার্থিব মোহ থেকে হৃদয়কে শূণ্য করতে পেরেছে।

তাওহীদের যে বানী প্রথমেই হৃদয়কে শূন্য করার তাগিদ দিয়েছে তা কেবল বাক্যেই সীমাবদ্ধ থাকেই, বরং একজন মুসলিম তার সমগ্র লাইফে কিভাবে হৃদয় শূন্য করবে তার একটা প্রোটোকলও দিয়েছেন আল্লাহ। দুনিয়া থেকে দুনিয়াবি স্বার্থ যেমন হাসিল হয় তেমনি অপার্থিব স্বার্থও এই হৃদয় শূন্যের মাধ্যমে হাসিল হয়। হৃদয়কে তাই সেই প্রোটোকল অনুযায়ী শূন্য করার চেষ্টা করছি। সেই একমাত্র মহান অধিপতি আল্লাহর দিকেই হৃদয়কে পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

(ইয়াসমিন মুজাহেদ’র আর্টিকেল অবলম্বনে)

কোন মন্তব্য নেই: