শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মনোরসায়নঃ এলোমেলো আলাপ-৬

কয়েক মাস আগে “Road To Mecca”র বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনও কোন ইংলিশ বই এর বাংলা অনুবাদ পড়বনা। অনুবাদ আসলে খুব কঠিন ছিল কিনা জানিনা, তবে আমার পড়তে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। যাইহোক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পল কেলহো’র দুইটি ইংলিশ নভেল পড়লাম। একটি বই ছিল একটি মেয়ের জীবনী নিয়ে যা সে তার নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিল। পড়ে মারাত্বক অভিভূত হলাম।
এই ডায়েরি জিনিসটা কেন যেন আমার কখনও মেইনটেইন করা হয়না। ছোটবেলা থেকেই অনেক বার এটেম্পট নিয়েছিলাম ডায়েরি নিয়মিত লেখার। অবশ্য এই এটেম্পট নেবার পিছনে অন্য আরেকটি কারণও ছিল, তা হল প্রচুর ডায়েরি গিফট পেতাম।কিন্তু আসলে শেষ পর্যন্ত কোন ডায়েরি আমি লিখতে পারিনি।

যাইহোক, ডায়েরি নিয়মিত লিখলে একটি জিনিস খুব ভালভাবে এনালাইসিস করা যায় তাহল- নিজের ম্যাচিউরিটির ক্রমাগত পরিবর্তন। মেডিকেলের এক ভাইয়া বলছিলেন যে তিনি ক্লাস ফাইভ থেকে ডায়েরি লিখেন, এবং তিনি দেখেছেন যে তার ব্যসিক চিন্তা-ভাবনার কোন পরিবর্তন এখনও হয়নি। আমার তো মনে হয় গতকাল আমি যে চিন্তা করেছিলাম তা আজকেই কিছুটা হলেও মডিফাই হয়ে যাবে।
হুম, ব্যসিক চিন্তা হয়ত সেভাবে মডিফাই হবেনা, কিন্তু আশেপাশের চিন্তা অবশ্যই

ছোটবেলা থেকেই খুব কৌতুহল ছিল সবকিছুর প্রতি। যা সাধারণত সবার ভিতরই থাকে। এই যেমন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, পাশে কোন দোকান। সেই দোকানে কি আছে, লোকজন কিভাবে কেনাকাটা করছে, কিভাবে কথা বলছে সব কিছুর প্রতি চরম আকর্ষণ। ক্লাস সেভেন অথবা এইটে থাকতে বিজ্ঞানীদের সংগা পড়েছিলাম যে বিজ্ঞানী হবার মেইন শর্ত হল কৌতুহল থাকা। অর্থাৎ জানার আগ্রহ যার মধ্যে নাই সে কখনও বিজ্ঞানী হতে পারবেনা। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমার বিজ্ঞানী হবার স্টেপ শেষ। কারণ কৌতুহল কমে যাচ্ছিল সবকিছুর প্রতি। কেন হবেনা! পড়াশুনার প্রতি কৌতুহল আমার কোন কালেও ছিলনা। জানার আগ্রহ আছে তবে সেটা অবশ্যই পড়াশুনার বাইরের জগতের প্রতি।

সেদিন ভাবছিলাম যে বাংলাদেশের মানুষের অনেক সম্ভাবনা ছিল যুগে যুগে ভুরি ভুরি বিজ্ঞানী প্রজনন করার। ফার্মগেটের রাস্তার পাশে দাড়ালে দেখা যায় কেউ মাইকে ওয়াজ করে ভিক্ষা করছে, কিছু মানুষ তার পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাসুন্দি দিয়ে আনারস বিক্রি করছে তার পাশেও কিছু মানুষের ভিড়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যে রাস্তা খননের কাজ চলছে কিংবা ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে তার পাশেও ভিড়। এত্ত কৌতুহল সবার!! আবার কেউ রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে তার পাশেও ভিড় লেগে থাকে। কোথায় ইনজুরড লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে তা না করে সব তাকিয়ে তাকিয়ে ভিড় করে দেখে। কি যে দেখে আল্লাহই জানে!
বলছিলাম চিন্তাভাবনার পরিবর্তন...হুম। সেদিন এক ব্যসিক চিন্তা পুরাপুরি পরিবর্তিত হয়ে গেল। এবং কথায় কথায় ফ্রেন্ডকে সেদিন একথা বলছিলাম, দেখলাম সেও কিছুটা কনফিউসড।
আমরা যারা অন্যদের বদলে দেবার প্রত্যয় নিয়ে সর্বদা চিন্তা করি ভেবেও দেখিনা সবচেয়ে বড় পরিবর্তন নিজেদের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের সমগ্র কাজের ইনসেনসিবল পার্ট হল নিজেকে নিজের জায়গায় ঠিক রেখে অন্যকে বদলে দেয়া। হুম, আমি বলছিনা যে সবসময় আমাকে বদলাতে হবে। তবে যে জিনিসটা আমি অন্যের মধ্যে দেখতে চাই সেটাই কেন নিজের মধ্যে প্রথমেই আয়ত্বে আনার চেষ্টা করিনা?
ইথিক্যাল কথা যদি নিজের মধ্যেই ধারণ করা না গেল তাহলে ইথিকসের কথা না বলাই ভাল। তা না হলে সেটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় কোন একটা অন্যায় কাজ করছি, ক্রমাগত ভুল হচ্ছে। তারপর নিজেদের সেই অন্যায় থেকে নিউট্রাল করার জন্য বলছি “ আমি তো আমার অন্যায় বুঝতে পারছি, কিন্তু অন্যরা তো সেটাও পাচ্ছেনা”। এমন না যে অন্যায় কিংবা ভুল থেকে শুধরানোর চেষ্টা বরং অন্যায় কে নিজেদের ভিতর ধীরে ধীরে ডাইলিউট করা।

এখন আসি যে অন্যায় বুঝতে পারছে সে বেশি ক্ষতগ্রস্থ নাকি যে বুঝতে পারছেনা সে বেশি??

আমার ক্ষেত্রে যেটা হয় যে বেশিরভাগ সময় আমি বুঝতে পারি যে কেন আমার অমুক ভুল বা অন্যায় হল? আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছি তার ক্ষেতেও সেইম। কিন্তু সবশেষ একটাই সান্ত্বনা যে আমরা তো অন্যায় বুঝতে পেরেছি, অন্যরা কি তা পারছে? সুতরাং......
ব্রেইনের সম্মুখ বা ফ্রন্টাল লোবের সাথে অন্যান্য সব অংশের সংযোগ থাকে। ফ্রন্টাল লোব বেসিক্যালি মানুষের বিবেক বুদ্ধি, বিবেচনা, ভাল-মন্দ সেন্স, আবেগ-অনুভূতি, পারসোনালিটি, সামাজিক আচরন ইত্যাদি এসবের জন্য সিগন্যাল দেয়। তাই ভাল-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা জন্ম থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। যদি চুরি কিংবা মিথ্যা কথা বলি তাহলে ফ্রন্টাল লোব সাথে সাথে একটা নেগেটিভ সিগন্যাল দিবে। যদি সেই নেগেটিভ সিগন্যাল কে আমরা ওভারলুক করি তাহলে ফ্রন্টাল লোবের সাথে অন্যান্য অংশের কাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। নাহ! এটা কিছুদিন বা কয়েকমাসের জন্য না। ক্রমাগত দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রন্টাল লোবের নেগেটিভ সিগন্যাল যখন এভয়েড করা হয় তখন সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যায় একদম অজান্তেই। যে মানুষটা যত বেশি জানে তার ফ্রন্টাল লোবের নেগেটিভ সিগন্যাল যদি বেশি বেশি এভয়েড করা হয় তাহলে ব্রেইনের অন্যান্য অংশের সাথে ভারসাম্য তার বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে আমরা যাকে সচরাচর ভাল মানুষ হিসেবে জানি দেখা যায় সেই এমন একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করে যা কোন সমীকরণেই মেলানো যায়না।
আমরা হয়ত বলে থাকি এরকম একজন ভাল মানুষ সে কিভাবে এই কাজটা করতে পারল যা কিনা একজন সাধারণ মানুষ থেকেও আশা করিনা?? লুক্কায়িত মেসেজ আসলে ফ্রন্টাল লোবের এই থিওরির মধ্যেই লুক্কায়িত।




খুব সুন্দর কিন্তু মারাত্বক বৈজ্ঞানিকভাবে কুরআনে সূরা আ’লাক্বে ১৫-১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

“সে কি জানে না , আল্লাহ দেখছেন ? কখনই নয় , যদি সে বিরত না হয় তাহলে আমি তার কপালের দিকে চুল ধরে তাকে টানবো , সেই কপালের চুল ( ওয়ালা ) যে মিথ্যুক ও কঠিন অপরাধকারী।”

তাই কোন কিছু না জেনে না মানার মধ্যে ক্ষতি যতটা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হল জেনে পালন না করা। তাই অন্তত আজকে একথা জানার পর থেকে ওই কথা বলার সুযোগ আর থাকলনা “আমি তো আমার অন্যায় বুঝতে পারছি, কিন্তু অন্যরা তো সেটাও পাচ্ছেনা”।

লেখার শেষ মুহূর্তে এসে মনে হল আমার লেখার মোরাল লেসন অনেকেই ভেবে বসতে পারেন, যে “যত কম জানা যায় ততই উত্তম”। কিন্তু আমি আসলে যতটুকু জানি ততটা মেনে চলার চেষ্টার তাগিদে এই এলোমেলো লেখাটা শেয়ার করলাম।

কোন মন্তব্য নেই: