শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৩

হাটি হাটি পা পা......




পাঁচ বছরের ছেলে আবির। বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান। খুব কিউট চেহারা। একটি অনুষ্ঠানে সব মায়েরা যেখানে গল্প করে সেখানে আবিরের মা খুব গর্বের সাথে অন্য এক ভাবিকে বলছে তার ছেলে সিনেমার নায়কের মত বিকেলে খেলতে গিয়ে কোন মেয়েকে ফুল দিয়েছে। এটা শুনে সবাই হাসছে আর আবিরকে আদর করে অনেকেই বলছে একদম নায়কের মত হবে দেখতে। সব মেয়েরা পিছনে ঘুরে বেড়াবে।
ঘটনাটা খুব সাধারণ একটি ঘটনা। কিন্তু এই পাঁচ বছরের বাচ্চার নিজস্ব জগতে ঘটনাটা মোটেই সাধারণ না। পরিবার, পরিবেশ কিভাবে একজন বাচ্চাকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে সেটার উপর ব্যাসিস করেই এই সিরিজ লেখা চলবে। আমাদের বাবা-মায়ের ভূমিকা কতটুকু এবং বাচ্চাকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনটা নেগেটিভ ও পজিটিভ সেটাই এই সিরিজে ফুটে উঠবে ইনশয়াল্লাহ।
শিশুদের জগত আর আমাদের বড়দের জগত একেবারেই আলাদা। আমরা বড়রা যখন একটি শিশুকে ধীরে ধীরে বড় হতে দেখি তখন যদি এই শিশুর জগতের সাথে একেবারে মিশে না যাওয়া যায় তাহলে শিশুদের নিজস্ব জগতের হাসি,কান্না, আবেগ, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জগতে বিরাট আলোড়ন ঘটে যায়। একটা নেগেটিভ ইম্প্যক্ট নিয়ে শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
আচ্ছা বাচ্চাদের জগতের সাথে আমাদের জগতের পার্থক্য কোথায়?
বাচ্চাদের ব্রেইনের গঠন শুরু হয় মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যখন তার বয়স মাত্র তিন সপ্তাহ। বাচ্চা পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই তার কিছু প্রাইমারি ব্রেইন গঠন পূর্ণ হয়ে যায়। যেমনঃ কান্না করা, হাত-পা নাড়াচাড়া, ফিডিং রিফ্লেক্স, আই কন্ট্যাক্ট ইত্যাদি। বাচ্চাদের ব্রেইনের সাথে বড়দের ব্রেইনের পার্থক্য হল বাচ্চাদের ব্রেইন অনেক বেশি ইম্প্রেসনেবল। অর্থাৎ তাদের যত ইনপুট দেয়া তারা সেটাকেই ক্যাপচার করবে। কিন্তু আমাদের কোন ইনপুট দেয়া হলে আমরা সাথে সাথেই সেটা ক্যাপচার করবনা। আচ্ছা আপনার খুব অভ্যাসগত বিষয়কে কেউ যদি এখন বদলে দিতে চায় সেটা কি আপনি মেনে নিবেন? নিবেননা। কিন্তু বাচ্চাদের এই ইম্প্রেসনেবল ব্রেইন যেকোন ইম্প্রেসন সাথে সাথেই তাদের ব্রেইনের নিউরনে সিন্যাপ্স তৈরি করে ফেলবে। ফলে যত ধরনের ইনপুট আপনি দেননা কেন এতে বাচ্চা মোটেই বিরক্ত হবেনা।
ব্রেইনের পরিপূর্ণ গঠন নির্ভর করে জেনেটিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর । একটু সহজভাবে বুঝিয়ে বলি। একটি টেলিফোন লাইনের কথা চিন্তা করেন। যেখানে সব ডিজিট নির্দিষ্ট ও নেটওয়ার্ক কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে সেটাও নির্দিষ্ট। কিন্তু আপনি এই টেলিফোন লাইন দিয়ে কিভাবে আপনার নেটওয়ার্ক মেইনটেইন করবেন, কাদের সাথে কথা বলবেন, কি কাজে কথা বলবেন সবই অনির্দিষ্ট। জেনেটিক ব্যাপারটা ঠিক টেলিফোন লাইনের ডিজিট ও নেটওয়ার্কের মত, এখানে কারো কোন হাত নেই। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ হল এই টেলিফোন আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন সেটা নির্ধারণ করে।
জন্মের পরপরই ব্রেইনে নিউরনের সংখ্যা থাকে প্রায় ১০০বিলিয়ন। বাচ্চা যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখন এই নিউরনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়না বরং এক নিউরনের সাথে আরেক নিউরনের সংযোগ বৃদ্ধি পায় যাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় সিনাপ্স। এই সিনাপস্পই মূলতঃ শিশুর ব্রেইনকে ধীরে ধীরে পরিবেশের সাথে ম্যাচিউর করে তুলে। সিনাপ্সের কার্যকারিতা নির্ভর করে মায়েলিনেশানের উপর। মায়েলিনেশান হল পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার যোগ্যতা। অর্থাৎ একটি বাচ্চাকে যখন আপনি কোন কমান্ড করবেন তখন সেটা প্রথমে সে শুনবে এরপর এই কমান্ড তার ব্রেইনে গিয়ে আপনার কমান্ডকে প্রোসেসিং করে কি করতে হবে সেটা নির্দিষ্ট করবে, এরপর বাচ্চাটি আপনার কমান্ড অনুসরন করবে। এই যে এত ধীর গতিতে বাচ্চাটি কাজটি করবে এটার কারণ হল দূর্বল মায়েলিনেশান। অর্থাৎ এক নিউরনের সাথে আরেক নিউরনের সংযোগ বৃদ্ধি পাবেনা যদিনা মায়েলিনেশান ঠিকমত না হয়।
শিশুদের ব্রেইনের সিনাপ্স তিন বছর বয়সে প্রায় ৮০%, পাঁচ বছর বয়সে ৯০% পূর্ণ হয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধিতে সিনাপ্স প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এজন্য একজন বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকে যে ভাষায় শিক্ষা দিবেন ঠিক সে ভাষাই সে সুন্দরভাবে রপ্ত করে ফেলবে। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পর যে ভাষা সে শিখবে সেটার কিছু দুর্বলতা থাকবে। যেমন বাংলা ভাষার একজন শিশু যখন বয়ঃসন্ধির পর ইংরেজি ভাষা শিখবে হয়ত সে ব্যাকরণ, শব্দভান্ডার, কথা বলা সবই শিখতে পারবে কিন্তু উচ্চারনগত একটা বাঙ্গালিয়ানা ভাব থেকেই যাবে। ইংরেজদের মত করে উচ্চারন হবেনা কিছুতেই। আসলে বয়ঃসন্ধির পর ব্রেইনের ইম্প্রেসনেবল ক্যপাবিলিটি ধীরে ধীরে কমে যায়। সিনাপ্স পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই নতুন কিছু শেখা মানেই পুরান কিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুছে যাওয়া।
যাইহোক ব্রেইনের কার্যক্ষমতা আসলে ইলেক্ট্রিক্যাল সারকিটের মত। যত বেশি পরিবেশের সাথে ব্রেইন পরিচিত হবে তত বেশি নিউরনাল সার্কিট তৈরি হবে। বাচ্চাদের এই সার্কিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জন্মের পরপরই বাচ্চার সাথে মা কথা বলছে, গান গেয়ে শুনাচ্ছে, বিভিন্ন গল্প করছে এতে করে বাচ্চা কথা কিছু না বুঝলেও তার নিউরনাল সার্কিট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সে কোন ব্যাকরন, শব্দভান্ডার ছাড়াই কেবলমাত্র শুনে শুনে সে কথা বলা শিখে যাবে।
বয়সভেদে শিশুদের ব্রেইনের ম্যাচিউরিটি বিভিন্ন হয়ে থাকে। একেক বয়সে শিশু একেকরকম ভুবন গড়ে তোলে তার নিজের মধ্যে। এই ভুবন গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি যারা ভূমিকা রাখেন তারা হলেন পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন প্রমুখ। এই ভুবন গড়ে তোলার মুহুর্তে যদি বাচ্চাকে আমাদের অজান্তেই নেগেটিভলি আমরা স্টিমুলেশান দেই তাহলে সেটার পরবর্তি ফলাফল হবে খুব অপ্রত্যাশিত।
ছয় মাসের বাচ্চা কিংবা দুই বছরের বাচ্চার সাথে যদি সঠিক প্যারেন্টিং গাইডলাইন না থাকে তাহলে বাচ্চার মানসিক, শারীরিক উভয়ই মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই শিশু লালন-পালন বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন ও আগ্রহী হওয়া খুব জরুরি।

বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৩

কষ্টের সাথেই স্বস্তি (২)

অবশেষে প্রফ শেষ হল ফাইয়াজের বাবা ঢাকার বাইরে ক্লিনিকে গেল জব করতে আর আমি চলে আসলাম বাবা মায়ের কাছে ততদিনে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত প্রফের ধকল মনে হচ্ছিল তখনও যায়নি তবুও প্রশান্তি এটুকু ছিল যে ফাইনাল প্রফ অবশেষে শেষ হল বাবার বাসায় আসার পর সর্বপ্রথম আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল এটা ভেবে যে ফাইয়াজ পেটে আসার পর অতিরিক্ত টেনশানে প্রথম ভেবেছিলাম এমআর করব কিনা ( আল্লাহ মাফ করুক) বাবার ওখানে পাশের এক আপু এসেছিল, যে গত কয়েক বছর ধরে কনসিভ করছে কিন্তু এবরশন হয়ে যাচ্ছে এজন্য সেই দম্পতি খুব মনোকষ্টে ছিল আমার কাছে এসেছিল ভাল একজন গাইনি ডাক্তারের খোজ নিতে তাদের ঘটনা শুনে আমার অপরাধবোধ আরো বেড়ে গিয়েছিল ভাবছিলাম আল্লাহ আমাকে এত বড় একটা উপহার না চাইতেই দিয়ে দিল, আর আমি কিনা সেজন্য শুকরিয়া পর্যন্ত আদায় করলাম না!

প্রফের রেসাল্ট দেয়ার পূর্বে আমার টেনশান এত বেশি হচ্ছিল যে ঠিকমত কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছা করতনা মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকত তার উপর একা একা সংসার সামলানো আমার জন্য পুরাই অসম্ভভ হয়ে পড়ছিল রান্না ঘরে গেলেই বমি হত কিছু খেতে গেলেও বমি এমতাঅবস্থায় যদি রেসাল্ট খারাপ হয় তাহলে এই শরীরে আবার কিভাবে সাপ্লি দিব !! সাতপাচ অনেক কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম বাবা-মায়ের সাথে একসাথে বাসা নিয়ে থাকব আমার শাশুড়ি,ননদ কেউই ঢাকায় থাকেনা তাই প্রফের রেসাল্টের কিছুদিন আগেই বাসা শিফট করে আমার হাসপাতালের কাছে বাবা-মায়ের সাথে নতুন বাসায় উঠলাম এরপর এক বিকেলে প্রফের রেসাল্ট বের হল এবং আমার রিডিং পার্টনার প্রথমেই ফোন করে আমাকে কংগ্রাচুলেশান জানাল যে আমি ডাক্তার হয়ে গিয়েছি সেই মুহূর্তটা যে কি পরিমান আনন্দের ছিল ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা সত্যি কথা বলতে কি আমার তখন মনে হচ্ছিল ফাইয়াজের সুবাদেই আল্লাহ আমাকে সাপ্লি দেবার মত অনেক বড় বোঝা থেকে মুক্তি দিয়েছে তারউপর বাবা-মায়ের সাথে বিয়ের পরেও একসাথে থাকার যে উসিলা সেটাও ফাইয়াজের কথা ভেবেই আসলে আল্লাহ মানুষের জন্য যা প্ল্যান করেন সেটাই উত্তম যদি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা যায়

আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে ফাইয়াজকে পেটে নিয়ে যখন মেডিসিন ভাইভা দিতে যাই তখন কেবলই মনে হচ্ছিল প্রফের মত পার্থিব আজাব মনে হয় আর কোন কিছু হয়না আমার লং কেইস ছিল একজন এসাইটিস(পেটে পানি জমা) এর পেশেন্ট তার উপর হিস্ট্রি,পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমার বমি চলে এসেছিল কোনরকম এন্টিএমেটিক খেয়ে পরীক্ষাটা শেষ করেছিলাম সার্জারী পরীক্ষায় পুরা হল জুড়ে ছিল এক ভয়ার্ত নিরবতা কারণ সার্জারী ডিপার্টমেন্টাল হেডের চিল্লাচিল্লিতে সবার ত্রাহি অবস্থা লং কেইস, শর্ট কেইস শেষে যখন স্যারের কাছে ভাইভা দিতে যাব তখন কেবলই মনে হচ্ছিল পাশ-ফেইল যাইহোক এই ভয়ার্ত নিরবতা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই ভাইভাতে স্যারের বকাবকি ছাড়াই আমি উতরিয়ে গেলাম,আলহামদুলিল্লাহ আর গাইনি বরাবরি আল্লাহর রহমতে ভাল পরীক্ষা হল সবমিলিয়ে আমার তখন কেবল একটাই অনুভূতি, বিরাট সমুদ্র ছোট তরী নিয়ে সুন্দর ভাবে পাড়ি দেবার রহমত ফাইয়াজের জন্যই তাই যারা কেবল ক্যারিয়ারের জন্য বিয়া,সংসার,বাচ্চা-কাচ্চা নিতে ভয় পায়, আমার ধারণা তারা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রহমতের অংশটুকু মিস করে যায়

এরপর শুরু হল ইন্টার্নি পেশাগত ডাক্তার হবার প্রথম ট্রেইনিং অনেকেই তখন আমাকে ইন্টার্নি করতে নিষেধ করল বাসায় রেস্টে থাকতে বলল কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি হাসপাতালে  যাওয়া, রোগী দেখা, ডাক্তার হিসেবে নিজের হাসপাতালে বিচরণ করার লোভ সামলাতে পারছিলাম না আর ততদিনে আমার সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার চলছিল পুরাপুরি সুস্থ ছিলাম, শারীরিক-মানসিক সব সমস্যা থেকে মুক্ত আল্লাহর উপর ভরসা করেই ইন্টার্নি শুরু করলাম চেয়েছিলাম গাইনি দিয়ে শুরু করতে কিন্তু একাডেমিক্যালি আমার রোস্টার পড়ল সার্জারীতে প্রথমে এজন্য কিছুটা মন খারাপ ছিল মন খারাপটা আরো তীব্র হয়েছিল যখন আমাকে ডিপার্টমেন্টার হেডের ইউনিটে ইন্টার্নি করতে হবে এটা ভেবে কিন্তু ইউনিট চেইঞ্জ করার কোন সুযোগ ছিলনা পুরা চারমাসে সার্জারীতে ডিউটি করতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে আমি বুঝেছিলাম সার্জারী ইউনিট-১ ছিল আমার জন্য আরেকটি বিশাল বড় রহমত সবকিছুতে অতিরিক্ত কিছু সুবিধা ভোগ করছিলাম আমার ফ্রেন্ড কাম কলিগরাও আমাকে অনেক ফেবার করত যেকোন কাজে নাইট ডিউট মেয়েদের ছিলনা ইভিনিং ডিউটিতে কখনও খুব খারাপ লাগলে আমার ফ্রেন্ড কে ডিউটি হ্যান্ডওভার করে চলে আসতে পারতাম সবমিলিয়ে সার্জারীতে কাজ শেখা, ডিউটি করা, সবার কাছে সহযোগীতা পাওয়া আমার ইন্টার্নি কে খুব অর্থবহ করে তুলেছিল তারউপর স্যার-ম্যাম দেরও আমার প্রতি আলাদা কেয়ারিং এটিচিউড আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল সব আল্লাহর বিশেষ রহমত যা কেবল আমি ফাইয়াজের সুবাদে উপভোগ করছিলামআর আল্লাহর উপর ভরসা করে ইন্টার্নি শুরু করার সিদ্ধান্ত যে মোটেই ভুল ছিলনা এটাই  আরো বেশি করে বুঝলাম  


দীর্ঘ নয় মাস পর যখন ফাইয়াজ জন্ম নিল তার পরের দিন ফাইয়াজের বাবার বিসিএসের গেজেট প্রকাশিত হল একসাথে দুই আনন্দে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করার ভাষা খুজে পাচ্ছিলামনা বছর শেষে আমার ক্যারিয়ারে তখন দুইটা ডিগ্রি যুক্ত হল এক. এমবিবিএস ডিগ্রি, দুই. মাতৃত্বের অনুভূতি আসলে ক্যারিয়ার নিয়ে যেসব মেয়েরা অতিমাত্রায় সচেতন, এবং যেকারণে তারা সময়মত বিয়ে,সংসার,বাচ্চা নিতে ভয় পায় তাদের জন্য আমার একটাই পরামর্শ, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না আর আল্লাহর উপর ভরসা করলেই কেবল এই বিশেষ পরামর্শের উপযোগীতা উপলব্ধি করা যায় কোন কিছুই একাডেমিক ক্যারিয়ারের জন্য থেমে থাকবেনা বরং জীবনের সব পর্যায়কে ক্যারিয়ারের একটা পার্ট হিসেবে দেখলে দেখা যায় একসাথে সবকিছুই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়ে যায় এই আমি যদি কেবল ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করতাম তাহলে কি বছর শেষে এত মূল্যবান দুইটা ডিগ্রি অর্জন করতে পারতাম ?? গভীরভাবে কি উপলব্ধি করতে পারতাম যে নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে?? নিশ্চয় সব প্রশংসা এবং ক্রেডিটের একমাত্র অধিকারী পরম করুণাময় আল্লাহ যিনি মানুষের প্রতিটা প্রার্থনায় সাড়া দেন

কষ্টের সাথেই স্বস্তি (১)

 তখন সবেমাত্র নতুন সংসার শুরু হল । এতদিন  বাবা মায়ের সংসারে যে আমার কখনও খুব একটা রান্না ঘরে ঢুকার প্রয়োজন হয়নি  সেই আমি তখন নতুন সংসার আর এম বি বি এসের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । যাকে বলে একেবারে কুয়ার ব্যাঙ কে সমুদ্রের মধ্যে ছেড়ে দিলে যেরকম হয় আমার অবস্থা তার থেকে কম কিছু ছিলনা। চোখের পানি আর নাকের পানিতে আমার একেবারে কাহিল অবস্থা। এখনও সেসব কষ্টের দিনের কথা মনে পড়লে কান্না আসে। 

 প্রতিদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর রান্না ঘরে চলে যেতাম। আলু ভর্তা,ডিম ভাজি কিংবা খিচুড়ি রান্না করে আমি চলে যেতাম আমার হাসপাতালে আর ফাইয়াজের বাবা তার হাসপাতালে। সারাদিন হলে থেকে টানা রাত দশটা পর্যন্ত আমি আর আমার রিডিং পার্টনার একসাথে প্রফের প্রস্তুতি নিতাম। এরপর ফাইয়াজের বাবা আমাকে নিতে আসত। দুজনে রিকশা করে সেই রাতে আমরা ছোট্ট সংসারে ফিরতাম। এরপর কোনরকম খাবারের কিছু ব্যবস্থা, নামাজ আর ঘরের টুকিটাকি কাজ শেষ করে যখন বিছানায় যেতাম তখন রাত একটা পার হয়ে যেত। এরপর আবার সেই পুরান রুটিনের সাইকেল। ঘরের কাজ বলতে দুই একদিন পরপর ঝাড়ু দিতাম। আর মাসে দুই একবার আমার মা এসে পুরা সংসার ঝেড়ে মুছে, কাপড়-চোপড় সব ধুয়ে একেবারে তকতকে করে দিয়ে যেত। মাঝে মাঝে আব্বু এসে একগাদা রান্না তরকারি দিয়ে যেত। সেসব ফ্রিজে রেখে কয়েকদিন পার করে দিতাম। সে কয়েকদিন হয়ত আমার রান্নাবান্নার ঝামেলা কম থাকত। একটু সকাল সকাল রাতে ঘুমাতে যেতে পারতাম। এই তো ! কারণ সবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও আমাদের দুজনের সাপ্তাহিক ছুটি বলে কিছু ছিলনা। ফাইয়াজের বাবার শুক্রবারও ডিউটি থাকত আর আমিও চলে যেতাম সেই ভোরে আমার হলে, টানা গাধার মত পড়ার জন্য। এতকিছুর পরেও স্বস্তি ছিল এটা যে সংসারের সব ঝামেলা আমরা দুজন মিলেই করতাম। হয়ত আমি রান্না করেছি, খাওয়া শেষে ফাইয়াজের বাবা সব প্লেট-বাটি সুন্দর করে ধুয়ে রেখেছে। হয়ত আমি ঘর ঝাড় দিচ্ছি ওদিকে সে নোংরা কাপড়-চোপড় সব ওয়াশ করছে। কখনও আমি একটু অসুস্থ হলে রান্না বান্না, ধুয়া মুছা সব সেই করেছে। আমার ফাইনাল প্রফের বিরাট ধাক্কা বেচারার উপরও গিয়েছে। 

আর হলে থেকে আমি আর আমার রিডিং পার্টনার ম্যারাথন পড়া দিতাম। দুজনই ছিলাম বিবাহিত। তাই দুজনেরই কিছু সাংসারিক ঝামেলা মিটিয়ে প্রফের প্রস্তুতি নেয়া ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এজন্য অন্য কারো সাথে আমাদের পড়াশুনার রুটিনের বিন্দুমাত্র কোন মিল ছিলনা। সবাই রাতে জেগে পড়ে,সকালে দেরি করে উঠে। আর আমরা মোটামুটি সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টানা পড়তাম। মাঝখানে কেবল খাওয়া,গোসল আর নামাজের বিরতি। আমাদের এরকম হাভাতের মত পড়া দেখে আশে পাশে সবাই টিজ করত। কিন্তু আমরা দুজন জানতাম এরকম না পড়লে প্রফে পাশ তো দূরের কথা বসার যোগ্যতাও হবেনা। সারা বছরের জমানো মেডিসিন, সার্জারি আর গাইনির পাহাড়সম সিলেবাসের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ডাক্তার হবার জন্য এরকম পড়াশুনা ছাড়া আমাদের সেকেন্ড কোন অপশন ছিলনা। তার উপর তো ওয়ার্ডে গিয়ে গিয়ে কেতাবি জ্ঞান রোগীদের উপর একদফা ঝাড়া লাগত। হুম, এভাবেই চলছিল নতুন সংসার আর বহু কাংখিত ডাক্তার হবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি ।

জানুয়ারির ১তারিখে ফাইনাল প্রফ শুরু হল। রিটেন শেষ হল খুব ভালভাবেই। এরপর অসপিও ভালভাবে শেষ হল। এরমধ্যে ফাইয়াজের বাবার বিসিএসের ভাইভার রেসাল্ট দিল। আলহামদুলিল্লাহ টিকে গেল। কষ্টের মধ্যেও একটু আনন্দের ছোয়া। ভালভাবেই চলছিল সব । কিন্তু ভাইভা  শুরুর কয়েকদিন আগেই আমি টের পেলাম ফাইয়াজকে আল্লাহ পৃথিবীতে আসার জন্য নির্ধারন করে দিয়েছেন। প্রেগন্যান্সি টে্সটেও পজিটিভ আসল। শুরু হল প্রেগন্যন্সির প্রথম তিন মাসের শারীরিক ধাক্কা, সাথে ভাইভার মহা টেনশান। সবমিলিয়ে এক দুর্বিসহ জীবন শুরু হল.........



চলবে...