মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০১০

খুব মায়া হয় তোমাদের দেখে!

সামাজিক স্তরের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার একটি শ্রেণীবিভাগ পড়েছিলাম। অনেকটা এরকম... উচ্চস্তরের মানুষের ছেলে-মেয়েরা ইংলিশ মিডিয়ামে, মধ্যবিত্তরা বাংলা মিডিয়ামে আর নিম্নবিত্তরা মাদ্রাসায়। কোন প্রাতিষ্ঠানিক বইতে এই শ্রেণীবিভাগ পড়িনি। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা শিক্ষা সংস্কারমূলক একটি প্রবন্ধে এটা পড়েছিলাম। খুব মজা পেয়েছিলাম এটা পড়ে। আজ হঠাৎ এই শ্রেণীবিভাগের কথা মনে পড়ে গেল।
যখন নাইনে পড়তাম তখন খুব ইচ্ছা করত স্টুডেন্ট পড়াতে। অন্যকে পড়ানোর মধ্যে নাকি একটা আলাদা আনন্দ আছে। স্টুডেন্ট পড়ানোকে মনে করতাম খুব বড় একটা ব্যাপার। আমাদের বাসায় তখন আমি,আমার ছোট ভাই, কাজিন সহ মোট ৫/৬ জন স্যারের কাছে পড়তাম। ব্যাপারটা খুব দারুন ছিল, কারণ সেখানে কেউ সেইম ক্লাসের থাকতনা। ছয়জন ছয় ক্লাসের। অনেকটা রিক্রিয়েশানমূলক পড়াশুনা হত। খুব গল্প,হাসাহাসি,পড়াশুনা সব । আমি ছিলাম নাইনে, হাসান এইটে, মামুন (আমার ছোট ভাই) সেভেনে, পলি আপু টেনে, শিলা সিক্সে আর অনিক ছিল ফোরে। হাসান আমার খুব ভক্ত ছিল, সো স্যার তাকে যতনা অংক করাত সে আমার কাছে অংক বেশি করত। স্যার এটা জানতেন এবং অংক আমার ফেবারিট সাবজেক্ট হওয়ায় স্যারও হাসানকে উৎসাহিত করতেন যেন না পারলে সে আমার কাছে হেল্প নেয়। অনিক ছিল আমাদের মাঝে সবচেয়ে ছোট এবং খুব দূরন্ত। একদিন স্যার আমাকে বললেন অনিককে একটা সম্পাদ্য শিখায় দিতে। আমি তো মহা উৎসাহে তাকে সম্পাদ্য আঁকানো শিখায় দিলাম এবং আঁকানো শেষে বললাম যে প্রসেসে সম্পাদ্য এঁকেছো সেটাই এখন নিজের ভাষায় বর্ণনা করে লিখে দিলেই হবে। সাথে সাথেই অনিক আমাকে প্রশ্ন করল, " আচ্ছা আপু আমার নিজের ভাষা তো বাংলা, আমি কি বাংলায় লিখব তাহলে?" আমি ঠিক সে মুহূর্তে কি বলব বুঝতে পারছিলামনা। যাইহোক সেই ঘটনা আমাকে কিছুটা শিক্ষা দিয়েছিল যে কাউকে কোন কিছু শেখানো বা পড়ানো সবসময় সহজ না।
কিছুদিন পূর্বে বাড়িওয়ালা আন্টি খুব খুব রিকোয়েস্ট করে গিয়েছেন মামুন যেন তার ছেলেকে পড়ায়। যেহেতু মামুনের সামনে এডমিশান টেস্ট তাই সে এখন পড়াতে পারবেনা এই অযুহাত দিলে আন্টি আমাকে খুব রিকোয়েস্ট করলেন যেন এটলিস্ট মামুনের এডমিশানের আগ পর্যন্ত আমি পড়ায়। এমনিতেই আন্টি একজন প্রফেসার মানুষ, সারাবছরই কিছু না কিছু সত্যায়িত করার জন্য আন্টিকে আমি খুব খুব বিরক্ত করি, তার উপর বাড়িওয়ালা- সবকিছু চিন্তা করে মামুনের টিউশানির প্রক্সি দেবার জন্য কিছুদিনের জন্য রাজি হলাম।
রুহিত, আমার স্টুডেন্ট। সামনে এসএসসি দিবে। ম্যাথ আর বিজ্ঞান পড়াচ্ছি। তাকে একদিন খুব সাধারণভাবে একটা প্রশ্ন করলাম যে সে কিভাবে তার অবসর কাটায়? খুব সিম্পল এন্সার, তার কোন অবসর সময় নেই। বাংলা, ধর্ম, ভূগোল, ইংলিশ, একাউন্টিং,ম্যাথ+বিজ্ঞান, সমন্বিত সাবজেক্ট এর জন্য যার আলাদা আলাদা টিচার থাকে সে কিভাবে অবসর সময় পাবে? আমার তো তার সাবজেক্ট ভিত্তিক টিচারের শিডিউল শুনে মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা। এসএসসিতে আমি মাত্র একজনের কাছে পড়েছি তাও কেবল ম্যাথ। বাকি সব নিজে নিজেই পড়তাম। স্কুলের পড়ানো + বাসায় সেলফ অধ্যয়নের জন্য সায়েন্সের সাবজেক্টও আমি নিজেই পড়ে নিতাম। কোন অসুবিধা হতনা। শুধু কি তাই? যত্ত ধরনের আউট বুকস আছে সেগুলো আমার রেগুলার স্টাডির একটা অবিচ্ছেদ্য পার্ট ছিল। টিভি দেখা হত খুব লিমিটেড। আলিফ লায়লা বা সিন্দাবাদ টাইপ সিরিয়াল দেখতাম। সবচেয়ে মারাত্বক ছিল গল্পের বই এর প্রতি নেশা। কত রাত জেগে জেগে আমি ক্লাসের বই এর মাঝে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়েছি তার হিসাব নাই। প্রথম আলো পেপারের সাথে যে "আলপিন" বা "ছুটির দিনে" বা "নারী মঞ্চ" দিত তাতো পুরা মুখস্ত হয়ে যেত আমার। অথচ রুহিত গল্পের বই পড়া তো দূরের কথা সে নিজের জন্য পারসোনাল সময় বের করতে পারেনা টিচারের শিডিউলের কারণে। উহ! কি মর্মান্তিক লাইফ স্টাইল। রুহিত কে দেখলে আমার সত্যি খুব মায়া লাগে।
ইসহাক সেও স্টুডেন্ট। তবে কোন রিকোয়েস্টের স্টুডেন্ট না। পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহ অনেক। কেউ গেলেই তার কাছে পড়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখায়। তবে তার অবসর সময় প্রচুর। রুহিতের মত তার সাবজেক্ট ভিত্তিক টিচার নাই, রুহিতের মত উচ্চবিত্তের ছেলেও সে না। কিন্তু ইসহাকের জন্য মিনিমাম একজন টিচারও নাই যে তার কাছে সে রেগুলার পড়বে। ইসহাক কোন স্কুলে পড়েনা, কারণ স্কুলে পড়ার খরচ তাকে কে দিবে? আর থাকে সেই বস্তিতে কোন দালান কোঠাতে না। ইসহাকের জন্যও আমার খুব খুব মায়া লাগে, যেমন লাগে রুহিতের জন্য।

রুহিতের শিক্ষার সাথে ইসহাকের শিক্ষার এত এত তফাৎ শুধুমাত্র সামাজিক স্তরভেদের জন্য। জাফর ইকবালের সেই প্রবন্ধের কথা তাই মনে পড়ে গেল।লেখক অবশ্য সেই লেখাতে ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদ্রাসার খুব নেগেটিভ সমালোচনা করে বাংলা মিডিয়ামের বিভিন্ন সংস্কারের কথা তুলে ধরেছেন। সেই আলোচনাতে আজ গেলামনা। তবে আমি ঠিক জানিনা বর্তমান শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি সবাই এ প্লাসের জন্য ছুটছে। আমার এক কাজিন সেদিন এসেছিল "হাজার বছর ধরে" উপন্যাস বুঝতে। উপন্যাস কিভাবে কাউকে শেখানো যায় আমি জানিনা। তবে সে কখনও কোন উপন্যাস পড়েনি, গল্পের বই এর প্রতি আগ্রহ নাই। যেটুকু সময় পায় সেটা সে টিভিতে বাংলা নাটক,হিন্দি সিরিয়াল,মুভি,মিউজিক এসবেই কাটায়।
হাজার বছর ধরে উপন্যাস যখন প্রথম পড়েছিলাম একদম মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। মকবুল মারা যাবার পর টুনির ম্যাচিউরিটির সাথে নিজের মধ্যেও এক ধরনের ম্যাচিউরিটি ফিল করেছিলাম। অথচ সেই ব্যাপারটাই কি কাউকে ম্যাথ/বিজ্ঞান শেখানোর মত শেখানো যায়? এরকম আরো কয়েকদিন সেই কাজিন যখন বাংলা গল্প,কবিতা বুঝতে আসে তখন তাকে বিভিন্ন গল্প,উপন্যাস পড়ার পরামর্শ দিলাম। বললাম যে তোমাদের মত সময়ে আমরা আউট বুকস লুকিয়ে পড়তাম, কিন্তু তোমাদের জন্য এখন লুকিয়ে পড়া লাগবেনা বরং এগুলাও তোমরা টেক্সট বই হিসাবে একটু সময় করে পড়ে নিও।
আজকাল সব ছেলে-মেয়েরা কি এরকম রোবোটিক হয়ে যাচ্ছে? আনন্দবিহীন পড়াশুনা করে শুধুমাত্র এক সার্টিফিকেইটের জন্য এক কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে? অন্যদিকে সামাজিক শ্রেণীবিভেদ এত বেশি যে কেউ টিচারের শিডিউলের জন্য নিজের জন্য সময় পায়না আর কারো জন্য কোন টিচারই থাকেনা! কি অস্বাভাবিক এক রেশিও!! ঠিক কিরকম যেন একটা হ্যাপাজার্ড অনুভূতি হচ্ছে আমার। কিরকম সেই অনুভূতি তা বলতে পারবনা তবে বর্তমান জেনারেশান দেখে ও ভবিষ্যত জেনারেশানের কথা চিন্তা করে একটি কথাই বলতে ইচ্ছা করছে "সত্যি খুব কষ্ট ও মায়া হয় তোমাদের দেখে..."

তোমার কি আজ মন খারাপ??

তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। অ-নে-ক অ-নে-ক দেখতে ইচ্ছা করছে। তোমার অসীমতা আর সাথে আকাশের বিশালতার মাঝে আজ নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা শেষ কবে তোমাকে দেখেছিলাম? হুম, মনে পড়েছে ক্লাস ফোরে। ক্লাস ফোরের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ বড় হয়ে তোমাকে আবার দেখতে চাইছে। ছোট্ট বেলায় তোমাকে প্রথম দেখে আমার অনুভূতি কেমন হয়েছিল জান? অনেক বিস্ময়কর! চারদিকে শুধুই অসীমতা বিরাজ করছিল, তোমার অসীমতার মাঝে নিজেকে শুধুই হারিয়ে ফেলছিলাম। তখন ক্ষুদ্র নিজ সত্তাকে তোমার সামনে আরো বেশি ক্ষুদ্রতর মনে হচ্ছিল।এখনও কি তাই মনে হবে তোমাকে আবার দেখলে?
খুব বেশি ব্যবধান নয়, মাত্র ১১ বছরের ব্যব্যধান। এতদিনে তোমার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? নাকি তুমি সেই আগেরই মত রয়েছ? দশ বছরের ক্ষুদ্র বালিকার দৃষ্টিতে তুমি ছিলে অসীম, আর একুশ বছরের এই আমার চোখে তুমি মনে হয় সসীম। সত্যি বলছি। তুমি বিশ্বাস করছনা?

এত্ত কমপ্লেক্স, এত্ত জট্টিল সব মানুষের মাঝে বসবাস যে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে যাই। আচ্ছা তোমারো কি তাই করতে হয়? প্রতিনয়ত আমাকে জীবন দর্শন খুজে যেতে হয়, প্রতিনিয়ত বিভিন্নমুখী সত্তার সম্মুখীন হতে হয়, প্রতিনিয়ত সত্যিকার বন্ধুত্ব খুজতে গিয়ে এক নির্মম নিষ্ঠুর বন্ধুত্বের সন্ধান পাই, প্রতিনিয়ত এক অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে যেতে হয়, প্রতিনিয়ত স্বপ্ন পূরণ আর স্বপ্ন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের প্রেরণা পাই, প্রতিনিয়ত সীমাহীন এক মনোজাগতিক জটিলতা ফেইস করতে হয়, প্রতিনিয়ত নিজ সত্তার সাথে অবিরত সংগ্রাম করতে হয়, প্রতিনিয়ত মনপবনে জোয়ার আসে।, প্রতিনিয়ত মনপবনের ভাটা আসে, প্রতিনিয়ত কোন পরম সত্যকে সন্ধান করতে হয়, প্রতিনিয়ত নিজের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যেতে চাই, প্রতিনিয়ত সীমাবদ্ধতার মাঝে এক সুষম সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়, প্রতিনিয়ত ভুল করে যাই, প্রতিনিয়ত ভুল শুধরাতে হয়, প্রতিনিয়ত কারও কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাই, প্রতিনিয়ত কারো খুব কাছাকাছি চলে যাই, প্রতিনিয়ত কারো জটিলতাকে নিজের সরলতা দিয়ে ঢেকে দিতে চাই, প্রতিনিয়ত নিজের জটিলতাকে অন্যের সরলতার মাঝে নবরূপ পায়, প্রতিনিয়ত সবাইকে ভালবেসে যাই, প্রতিনিয়ত সবার ভালবাসা পেতে চাই...
তোমারও কি আমার মত এরকম প্রতিনিয়ত রঙ বদলায়? নাকি তুমি চিরকাল একই ধারায় বহমান প্রতিনিয়ত?? আকাশের নীলীমা আর তোমার সাথে গোধূলীর মিশ্রিত ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত আমি নতুন করে উপভোগ করতে চাই। তুমিও কি চাও? তোমার রঙ কি আমার মনের মত কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও সবুজ, কখনও বেগুনী কিংবা আসমানী!!! কিংবা সর্বদাএকই থাকে?
তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার ক্ষুদ্রতা কোথায়? আর আমার অসীমতা কোথায়? তুমি কি রাগ করেছ? তোমার কি আজ মন খারাপ সমুদ্র..................!!!!!