শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মানসিক দাসত্ব !

একজন নারীর সফল ক্যারিয়ার আসলে কি হওয়া উচিত এটা নিয়ে পুর্বের পোস্টে ব্যাপক আলোচনা হল। শুধু যে আলোচনাই হল তা নয়, আমাকে পারসোনালি অনেকের কাছ থেকে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্নের এন্সার দিতে হল। যেহেতু আমি মেডিকেলে পড়ছি সুতরাং আমি প্রফেশনালি মানবতাকে সার্ভ করব এই প্ল্যান নিয়েই পড়ছি। তাহলে কি আমার পূর্বের পোস্ট অনুযায়ী সফল ক্যারিয়ারিস্টিক নারী হিসেবে আমি নিজেকে দেখতে পাব?

আমি কখনও নারীর উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে না, নারীর বাইরে জবের বিরুদ্ধে না। কারণ কেবল নারী মুক্তি নয় আমাদের সকল মানসিক দাসত্বের মুক্তির জন্য শিক্ষা প্রয়োজন। কুরআন শুরু হয়েছে "পড়" শব্দ দিয়ে। সেখানে নারী শিক্ষা নিয়ে আমি স্পেসিফিক্যালি কিছু বলতে চাইনা। কথা হচ্ছে নারীর সফল ক্যারিয়ার নিয়ে।

যদি নারীরা মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত না হয় তাহলে অনেক হাই ডিগ্রি, অনেক বড় জব করেও তারা মুক্ত হতে পারবেনা, স্বাধীন হতে পারবেনা। যদি সন্তান পালন, সংসার করাকে নারীত্বের অবমাননা মনে করে নারীরা তাহলে পুরুষের পাশাপাশি বাইরে জবও তাদের ক্যারিয়ারে এক্সট্রা কিছুই যোগ করবেনা। বরং কেবল সুপার উইমেন হবার চেষ্টা তাদের মানসিক ও শারীরিক বার্ডেন বাড়াবে।

একটু চিন্তা করে দেখেন, নারীরা এখন হাইয়ার ডিগ্রি নিচ্ছে, বাইরে জব করছে কিন্তু সন্তান জন্মদান ও লালন পালনের প্রাইমারি কাজ নারীরা কখনও ওভারলুক করতে পারবেনা। কারণ নারীরা যদি হাজার আন্দোলনও করে তাহলে পুরুষরা তাদের এই প্রাইমারি কাজ শেয়ার করতে পারবেনা।

বেগম রোকেয়া নারীদের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে বহু আগেই লিখে গিয়েছেন ঠিক এভাবে,

"এই অলংকারের জন্য ললনাকূলের কত আগ্রহ! যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে! তাই দরিদ্রা! কামিনীগন স্বর্ণরৌপ্যের হাতকড়ি না পাইয়া কাচের চুড়ি পরিয়া দাসী-জীন সার্থক করে। যে (বিধবা) চুড়ি পরিতে অধিকারিনী নহে তাহার মত হতভাগিনী যেন এ জগতে নাই! অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভাল লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহেনা।সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি-গর্ব্বে স্ফীতা হই! "

এখন আসি, বর্তমান এই উচ্চশিক্ষা এবং বাইরে জব আসলেই নারীকে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে কিনা! পূর্বে আয়ের সোর্স কেবল পুরুষরা ছিল তাই তাদের পরিবারে ও সমাজে আলাদা একটা মর্যাদা ছিল। যেহেতু নারীদের আয়ের সোর্স ছিলনা তাই তারা নিগৃহিত ছিল ঘরে। কিন্তু এখন? নারীদের উচ্চশিক্ষা আছে, উপার্জন করছে। তারা এখনও নিগৃহিত হচ্ছে ঘরে এবং ঘরের বাইরে। কিভাবে??
আমি যখন দেখি ইউনিভার্সিটি তে পড়া মেয়েরা যারা পড়াশুনা করছে কেবল জবের উদ্দেশ্যে তারা অবসর সময়ে শপিং করতে খুব ভালবাসে, হিন্দি সিরিয়ালে কে কি ড্রেস পড়ল, কে কি গহনা পড়ল, কি কিভাবে সাজল সেটা নকল করতে ভালবাসে। কর্পোরেট দুনিয়ায় নিজেদের পণ্য করতেও দ্বিধা বোধ করেনা। শেভিং ক্রিম থেকে শুরু করে এমন কোন প্রোডাক্ট নেই যেখানে নারীদের পণ্য করা হচ্ছেনা। টিভিতে বিজ্ঞাপনে এই আধুনিক যুগেও যখন নারীদের দেখানো হয় টিপিক্যাল সেই সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনা দিয়ে, যেখানে একজন নারী পাশের মহিলার সুন্দর গহনা,শাড়ি দেখে নিজের হাজবেন্ডের সাথে ঝগড়া বাধায়, যেখানে একজন নারী সাবানের মডেল হয় কোমল ত্বকের অধিকারী হবার জন্য যা হাজবেন্ডের মন যুগাবে সেখানে আমি কিভাবে বলব নারীর তথাকথিত উচ্চশিক্ষা ও বাইরে জব তাদের মুক্তি দিয়েছে, তাদের সত্যিকার মর্যাদা দিয়েছে, তাদের কে সফল ক্যারিয়ারিস্টিক নারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে?

আমি কেবল নারীকে তার ভ্রান্ত চিন্তা-বিশ্বাস থেকে উঠে আসতে বলেছি। বলেছি পুরুষের মত অনুকরণে নয়, পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে নয় বরং নারীর মুক্তি আসবে নারীর স্বাতন্ত্রে। নারী তার নারী সত্তা দিয়ে নিজেকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারবে। সন্তান ধারণ করা নারীত্বের সবচেয়ে সাফল্যময় দিক, সন্তানকে পালন করা তার ক্যারিয়ারের একটা মূল্যবান সাইড। যারা বাইরে জব করেনা তারা যেন মনে না করে তাদের উচ্চশিক্ষা সব বিফলে গেল, কারণ এখন সন্তান কে ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য তৈরি করা উচ্চশিক্ষা ছাড়া সম্ভব না। নারীকে ভাবতে হবে, শিক্ষা কেবল আয়ের উৎস নয় বরং নিজেকে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তির অনন্য উপায়।

আহমাদ মুসাফফা, নাজমুসসাকিব নির্ঝর,সত্য কন্ঠ ও শিহান মির্জার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরছি......

আহমাদ মুসাফফা ভাইয়া প্রশ্ন করেছেনঃ


মেয়েদের চাকুরী না করতে বলা হলে কিছু ethical প্রশ্ন আসতে পারে । যেমনঃ
১.আমার ক্লাসের মেয়েরা আমার মতই কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনা করছে । এখন তাদেরকে যদি চাকুরী না করতে বলা হয় তাহলে সেটা কি অবিচার হবে না?
২ সন্তান পালন করাই যদি আসল কাজ হয়ে থাকে তাহলে এত কষ্ট করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নামিদামি ভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হওয়াতে স্বার্থকতা কোথায়?
৩ মেয়েরা মেধায় কম যায়না । যেমন আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড দুইজনই মেয়ে । ক্লাসের অন্য মেয়েরাও খুব ভাল । তারা কি ছেলেদের মত কম্পিউটার প্রোগ্রামার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেনা?

জবাবঃ
# নাজমুসসাকিব নির্ঝর ভাইয়া জবাব দিয়েছেন এইভাবে,


"পুরা ব্যাপারটার শুরু কোথায়? ব্যাপারটার শুরু হয়েছে একটা ডিপলি রুটেড আন্ডারভ্যালুয়েশন থেকে। যেসমাজের পুরুষ এবং নারী উভয়েই ঘরের সেই ছেলের বউ কে খুব দাম দেয় যে বড় চাকরী করে। আর যে বউটা বাসায় থেকে ঠিক মত ছেলে মেয়ে গুলোকে "মানুষ" করে তাকে অবহেলা করে। অথচ তারা জানেনা যে দ্বিতীয় কাজটা লিটারেলি এবং মেটাফরিকালি কি প্রচন্ড রকমের প্রয়োজনিয় কাজ। দ্বিতীয় কাজটা হচ্ছে একটা কন্ট্রিবিউশন টু এন্টায়ার সিভিলাইজেশন।
একজন যথার্থ সুশিক্ষিত মায়ের অভাবই একটা বাচ্চাকে অমানুষ বানাইতে যথেষ্ঠ। এবং আমরা আজকের যে পশ্চিমকে দেখছি এই পশ্চিমের তরুনদের অনেকেই এসেছে এইরকম ক্যারিয়ারিস্ট মা’র কাছ থেকে। তাদের বেড়ে ওঠার উপর এর একটা সাংঘাতিক প্রভা...ব আছে। তুই চিন্তা কর, একদম ছোট বেলায় যদি মা বাসায় না থাকত তাইলে আমরা কী করতাম? ৫০ বছর আগের পশ্চিম এর ক্ষেত্রে হয়ত এরকম মা’র কাছ থেকে আসা সন্তানের সংখ্যা ৩০% বা আরো কম ছিল। সেসময় অপরাধপ্রবনতাও আরো কম ছিল। হয়ত এই কোরিলেশনটা টু মাচ সিম্পলিস্টিক হয়ে গেল। কিন্তু পশ্চিম স্বীকার করুক আর নাই করুক নিঃসন্দেহে এটা সবচাইতে ইম্পর্টেন্ট ফ্যাকটর গুলোর একটা।

মির্যা গালিব ভাইয়ের ফেমিনিসম বিষয়ক একটা সাম্প্রতিক বক্তব্যের কথা বারবার মনে পড়তেছে, তিনি বলেছিলেন মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া ফেমিনিসম এর প্রতিরোধ সম্ভব না। মুখে খুব ইসলাম ইসলাম করা আর বাসায় যেয়ে বউকে বলা যে "আরে তোরে খাওয়াই আমি তুই কথা শুনবিনা কেন"? এইটাই ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট এর মোমেন্টাম হিসাবে যথেষ্ট। তিনি আরো বলেছিলেন, যদি মা'র কন্ট্রিবিউশন টা যথাযথ স্বীকৃতি পাইত তাইলে খুব কম মেয়ে (লেখিকার ভাষায় সুপার উইমেন) পাওয়া যাইত যারা এই রোদ্রের মধ্যে নিজের ইচ্ছায় বাসে ঝুলে অফিসে যাইতে চাইত।"



শিহান মির্জা জবাব দিয়েছে এইভাবে,


"প্রশ্নগুলো/আপত্তিগুলো apparently খুব শক্তিশালী। কিন্তু, এগুলো scrutinize করলে এগুলোকে refute করা সম্ভব।
১) বর্তমান দুনিয়াতে পড়াশোনা করার পিছনে যে মাইন্ডসেট কাজ করে তা হচ্ছে ভালো একটা জব পাওয়া, ভালো জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং পারলে খ্যাতি অর্জন করা। এখন কথা হচ্ছে, এই কারণগুলো আসলেই জ্ঞানার্জনের পিছনে যে মূল Ethical Reason (i.e. To serve Humanity [from secular perspective] or to serve Islam [From an Islamic perspective])থাকার কথা সেগুলোর খিলাফ কিনা তা ভাবার সময় আসছে। কম্পিউটার সাইন্সের জ্ঞান শুধু জবেই কাজে লাগতে পারে, এর বাইরে কাজে লাগতে পারে না সেটা মনে হয় ঠিক না। উম্মাহকে সার্ভ করার জন্য এর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অর্জিত জ্ঞানকে কিভাবে তাদেরকে তাদের মূল কর্তব্য থেকে না সরিয়ে ব্যবহার করা যায় সেটা ভাবতে হবে।

২) সন্তান লালনপালন করার জন্য সুশিক্ষিত মায়ের প্রয়োজনীয়তা অনেক অনেক বেশী। একটা সন্তানের কাছে ৫ম শ্রেণী পাশ করা মায়ের চাইতে মেডিকেল/ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নেয়া মায়ের প্রভাব অনেক বেশী থাকবে। সন্তানের সাথে Understanding এর ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় শ্রেণীর মায়েদের সফলতা অনেক বেশী থাকবে। তাছাড়া সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে যে প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সেটাও দ্বিতীয় শ্রেণীর মায়েরা বেশী বোঝার কথা কেননা তারা নিজেরাও শিক্ষিত। সুতরাং উচ্চশিক্ষা অর্জন শুধুমাত্র নিজের স্বার্থোন্নতির জন্য নয়। বরং, উচ্চশিক্ষা অর্জন মুসলিম নারীদের তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করার Potential অনেক বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা যায়।

৩) এর জবাব ১ এবং ২ নং পয়েন্টে পাবেন।"


রেইন স্পট জবাব দিয়েছে এইভাবে,


"আসলে কি জানেন, আমাদের মেয়েদের মধ্যে একটি বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে যে পড়ালেখা যখন শিখেছি তখন অবশ্যই জব করতে হবে। আমি নিজে মেয়ে হয়ে কিন্তু মেয়ে...দের বাইরে জবের বিরুদ্ধে কথা বলিনা। যেটা বলি সেটা হল উচ্চশিক্ষা কখনও বাইরে জবের জন্য না বরং জীবনে প্রয়োগের জন্য। এখন একটি মেয়ের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ফিল্ড হল তার সংসার & সন্তান। কারণ এই সন্তান ধারণের ব্যাপার আল্লাহ পুরুষকে দেননি, তারমানে অবশ্যই মেয়েদের এইদিকে এক্সট্রা কন্সার্ন দিতে হবে। কখনও যদি এরকম হয় আমার বাইরে জব আমার সংসার ও সন্তানের জন্য কনফ্লিকশান হচ্ছে তাহলে অবশ্যই সংসার ও সন্তানকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি নিজে মেডিকেলে পড়ছি, আমাকে বাইরে জব করতে হবে, কিন্তু অবশ্যই আমি আমার সংসার ও সন্তানের সাইডটা প্রাধান্য দিব আগে। কারণ আমার শিক্ষা যে কেবল বাইরে জব করেই প্রয়োগ করতে হবে এমন নয়, আমার সন্তান,পরিবার,আত্বীয়স্বজন,প্রতিবেশি এদের মধ্যেও প্রয়োগ শিক্ষা প্রয়োগ করা যায়। এখন সন্তান পালন করাকে যতটা সহজ কাজ বলে নারীরা মনে করছে ব্যাপারটা ততটা সহজ না। আগে হয়ত মায়েদের উচ্চশিক্ষা না হলেও চলত কিন্তু এখন এই সন্তানের জন্যই উচ্চশিক্ষার দরকার আছে। চাইল্ড সাইকোলজি বুঝে ফিউচার জেনারেশানকে লিড দিতে হলে ঘরে একটি মেয়েকে কতটা ডাইনামিক হতে হবে এটা বুঝলে মেয়েরা এখন আর বাইরে জব নিয়ে মাতামাতি করতনা। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটা নিরঝর ভাইয়া উল্লেখ করেছে, মেয়েদের এই বাইরে বের হবার আন্দোলনের ইন্ধন যুগিয়েছে পুরুষরা। কারণ তারা যদি মেয়দের ঘরে সংসার ও সন্তান পালনের জন্য আন্ডারএস্টিমেইট না করত তাহলে নারী আন্দোলনের এই তথাকথিত কনসেপ্ট আসতনা। যাইহোক আমি আশাবাদী এই পুরুষরা যদি এখন নারীদের উপযুক্ত সম্মান ও অধিকার ঘরেই দেয় তাহলে উচ্চশিক্ষিত নারীরাই আমাদের ভবিষ্যত জেনারেশান কে লিড দিবে।"


আহমাদ মুসাফফা ভাইয়ার প্রশ্নঃ
যদি এটাই মনে হয় উচ্চশিক্ষা জবের জন্য না তাহলে একটা ethical প্রশ্নও উঠে আসতে পারেঃ
মেয়েরা কি তাহলে পাবলিক ভার্সিটি, মেডিকেল কলেজে আসন নষ্ট করছেনা? অন্যছেলেদের কথা নাই বা বললাম হাজার হাজার A+ গ্রেডধারী ছেলেও উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য ভর্তি হতে পারছেনা । জবই যদি মেয়েরা না করল তাহলে এইসব ছেলেদেরই বা কেন বঞ্চিত করল?

রেইন স্পটের জবাবঃ
"অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু আমি এটা বলিনি যে উচ্চশিক্ষা করেও সব মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে। আমি বলেছি উচ্চশিক্ষা মানেই জব না। আর সন্তান পালনের জন্য তারা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে ব্যাপারটা তাও না। আমি যেটা ফিল করি সেটা হল ...প্রতিটি বাচ্চার জন্য একটা টাইম পিরিয়ড থাকে যখন মায়ের সংস্পর্শে থাকাটা অনেক জরুরি। এরপর সেই টাইম পিরিয়ড কমে যায়, তখন বাইরে জবের সাথে সন্তান পালন খুব একটা বৈপিরত্য হয়না। এসব আসলে সিচুয়েশান বুঝে এনালাইসিস করার মত প্রশ্ন। আপনি যদি কোন কেইস আমাকে বলেন তাহলে সেভাবে চিন্তা করে এন্সার দেয়া যাবে। তবে অবশ্যই যে ব্যাপারটা সর্বদা প্রাধান্য সেটা হল সন্তান প্রতিপালন। কারণ একটি পুরুষের যেমন ফিনান্সিয়াল রেসপন্সিবিলিটি সবার উপরে তেমনি একটি মেয়ের সন্তান প্রতিপালন সবার উপরে। এন্সার ক্লিয়ার না হলে, প্লিজ আমাকে একটি কেইস বর্ণনা করে প্রশ্ন করেন, তাহলে হয়ত সেভাবে এন্সার দেয়া ইজি হবে।"

আহমাদ মুসাফফা ভাইয়ার প্রশ্নঃ
মানুষের মনমস্তিষ্ক এমন এক জিনিস যে চর্চায় না থাকলে সে আসতে আসতে সে সব ভুলতে শুরু করে । সেটা মেডিকেল বলেন আর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-ই বলেন । বিয়ের পর একটি মেয়ে যদি ৫-১০বছর তার সাবজেক্টে চর্চা না করে তাহলে সে আগে যা শিখেছিল তার বেশিরভাগই ভুলে ...যাবে । তারমানে সে এত কষ্ট করে যা শিখলো তা "লস্ট প্রজেক্ট" ভিন্ন কিছু হবে না বলে আমার বিশ্বাস ।
এখন আমার চতুর্থ প্রশ্নের দিকে খেয়াল করুন । এখন দেখতে পাবেন ঐ মেয়ে সম্ভাবনাময় একটি ছেলেকে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/ইকোনোমিস্ট হতে দেয়নি । না সে নিজে হতে পারল না অন্যকে হতে দিল ।
.........

সত্য কন্ঠের জবাবঃ
আমার মনে হয় রেইন আসলে বুঝাতে চেয়েছে জব করাটা মেয়েদের ফার্স্ট টার্গেট হওয়া উচিৎ না,কিন্তু কেউ করতে চাইলে ও তাকে বাধাও দিচ্ছেনা।যেমন আমি......আমার ডিটারমাইন্ড ইচ্ছে আমি জব করবোনা।সেই ধরণের কোন টার্গেটই নাই আমার।কয়েকটা কারণ আছে এর।প্রথমত আল্লা...হ আমাকে অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত দিয়েছেন।আল্লাহ আমাকে যা থেকে মুক্ত দিয়েছেন তা আমি আমার উপর চাপিয়ে নিব নিজের উপর এতোখানি জুলুম কিংবা বোকামি আমি করবনা(বাধ্য হলে ভিন্ন কথা)।আমি বাইরে বের হয়ে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে বাসের ভীরে ধাক্কাধাক্কি করে ৯টা-পাচঁটা অফিস করে আমি আমার সম্মান বাড়াতে চাইনা(বাসের ভীরে ধাক্কাধাক্কি না করতে হলেও বাইরের পরিবেশ একটা মেয়ের জন্য কতোখানি প্রতিকুল সেটা মেয়ে মাত্রই জানে)।আমার সম্মান আল্লাহ এমনিতেই অনেক বেশী দিয়ে রেখেছেন।আমি কন্যা,আমি স্ত্রী,আমি মা।এ সম্মানের তুলনা কোন কিছুর সাথেই হয়না।আমাকে কেন সম্মানের জন্য কর্ম ক্ষেত্র খুজেঁ নিতে হবে???আমার কর্ম ক্ষেত্রতো আল্লাহই ঠিক করে দিয়েছেন গৃহকে।আমার সম্মান আমার গৃহে।তবে হ্যাঁ,কেউ যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটা ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাকে আমি নিষেধও করিনা।আমার ছোট বোন স্বপ্ন দেখে একটা সফল ক্যারিয়ারের।আমি তাকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে বলি।কিন্তু নিজের জন্য গৃহ ছেড়ে আমি নতুন কর্ম ক্ষেত্র খুজঁবনা কখনোই।আমার মনে হয়েছে রেইন এটাই বলেছে।ও কাউকে বাধ্য করছেনা ক্যারিয়ার না গড়ার জন্য।অনুপ্রানিত করছে আল্লাহ নারীদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেটা যথাযথভাবে পালন করার জন্য আর আল্লাহ যে সম্মান দিয়েছেন সেটাকে মূল্যায়ণ করার জন্য।

শিহান মির্জার জবাবঃ
ভাইয়া আপনি ঠিকই বলেছেন। কোন কিছু চর্চায় না থাকলে মানুষ তা ভুলে যায়। আসলে, এখানে কেউই বলেনি যে, কোন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট মা বা কম্পিউটার প্রোগ্রামার মা তার সন্তান লালনপালনের জন্য তার স্কিলটার চর্চা বাদ দেবেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ...হচ্ছে, নিজের অর্জিত শিক্ষার প্র্যাকটিক্যাল ইমপ্লিমেন্টেশন ফিল্ড কেন শুধু জবকেই ধরা হবে? আপনি একটিবার চিন্তা করুন, ধরুন কোন এম বি বি এস পাশ করা মা যদি নিজের ঘরেই একটা ছোট ক্লিনিক খুলে এলাকার গরীব মহিলাদের বিনা চিকিৎসায় ট্রিটমেন্ট দেয় কিংবা, কোন প্রোগ্রামার মা যদি ঘরে বসে নিজের স্কিলকে কাজে লাগিয়ে, ঘরে বসে পড়াশোনা করে একটা এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার তৈরী করার চেষ্টা করে, সেটা কি তার সন্তান লালনপালনে খুব একটা ব্যাঘাত ঘটাবে? তাছাড়া অনেক ইসলামিক স্কলারই বলেছেন যে, আধুনিক কোন ইসলামী রাষ্ট্রে যে দুটি ফিল্ডে মেয়েদের সবচেয়ে বেশী জড়িত হওয়া দরকার তার একটি হচ্ছে ডাক্তারী পেশা অপরটি হচ্ছে শিক্ষকতা।
আর কোন ছেলে যদি ইউনিতে/মেডিকেলে চান্স না পায় সেটা কি মেয়েটার দোষ নাকি ছেলে আর সরকারের দোষ?


আহমাদ মুসাফফা ভাইয়ার প্রশ্নঃ
আপনি যখন "নারীর প্রকৃত ক্যারিয়ার কি হবে" এমন বিষয়ে লিখবেন তখন আপনাকে নারীর ব্যাপারে
১ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হওয়া উচিত,
২ শিক্ষাব্যবস্থাকে নারীর উপযোগি করে কিভাবে ঢেলে সাজাতে হবে,
৩ আধুনিক নারীর চাওয়া পাওয়া নিয়ে আপনার মূল্যায়ন,
৪ ইনফরমেশন ট...েকনলজি যেভাবে সামাজিক বাধা দূর করে দিয়ে তথ্য আদান প্রদানকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সেই গ্লোবাল ভিলেজে নারীর ভূমিকা কি
সহ আরো অনেক বিষয়ে আপনাকে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিতে হবে ।

মনে রাখবেন, নারী সমাজে বেগম রোকেয়া কথাগুলো রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয় । "পুরুষ মেজিস্ট্রেট হতে পারলে আমরা কেন লেডি মেজিস্ট্রেট হতে পারবনা" এর স্থলে আপনি নারীদের হয়ত বাসায় থাকতে বলবেন । আবার আপনি যদি এও বলেন যে পাঁচ থেকে দশ পর চাকুরী করতে সেটা কতটুকু যৌক্তিক সেটা বিবেচনায় রাখবেন আশা করি ।
আপনি কি বেগম রোকেয়ার বইগুলো পড়েছেন?


রেইন স্পটের জবাবঃ নারীর প্রকৃত ক্যারিয়ার কি হবে সেটা আমার এই পোস্টেই স্পষ্ট বলা আছে। আপনার বাকি প্রশ্ন ডিসকাশনের আরো দিক উন্মোচন করবে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত ক্যারিয়ার এর ব্যাপারে আল্টিমেইট এন্সার সেইম। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি,শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক নারীর চাওয়া-পাওয়া, ইনফরমেশান টেকনোলজি সবকিছুই এখন নারীরে প্রতিকূলে। কারণ নারীরা এখন যে আইডিয়া তে আধুনিক হচ্ছে, বা যে আইডিয়াতে আমাদের সেকুল্যার সমাজ নারীকে আধুনিক করতে চাইছে সেটাকে পরিবর্তন করা বা কিরকম হওয়া উচিত সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নাই, আমি আসলে আধুনিক নারীদের কিছু চিন্তা ভাবনার ভুল সাইড টা নক করতে চাইছি। কারণ নারীরা যদি সমাজের চাওয়া-পাওয়ার পুতুল হয়ে থাকে, যদি তারা নিজেদেরকে সমাজের এক্সপেকটেশান অনযায়ী আধুনিক হয় কোনদিন তাদের মুক্তি আসবেনা। তাদের মুক্তি আসবে তাদের ভ্রান্তি আইডিয়া যদি সংশোধিত হয় তবেই। আমি কেবল ওই ভ্রান্তি আইডিয়ার দিকেই ফোকাস করছি।

বেগম রোকেয়া নারী মুক্তি নিয়ে সামান্য কিছু জিস্ট আজকের পোস্টে দিলাম। ইচ্ছা আছে বেগম রোকেয়ার নারী কেন্দ্রীক চিন্তা ভাবনা নিয়ে আরো পোস্ট দিব।

(বিশেষ কৃতজ্ঞ নির্ঝর, মুসাফফা ভাইয়া, শিহান ও সত্য কন্ঠের প্রতি এবং দুঃখিত এত বড় পোস্টের জন্য)

সফল ক্যারিয়ারিস্টিক নারী !

নারী শিক্ষা এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহনের ফলে দেশ, জাতি এবং নারী সমাজের উন্নতি হইলেও পুরুষ সমাজ মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হইতেছে। নারী তো পাষাণী। স্বামী বিরহের চেয়ে অর্থোপার্জনপূর্বক আত্মপ্রসাদলাভই তাহার জন্য পছন্দসই। অথচ এই প্রিয়া বিরহ পুরুষকে শয়নে-স্বপনে-অফিসে-মিটিং এ একদন্ড শান্তিতে থাকিতে দেয় কিনা সন্দেহ। আবার যদি এমন হয়ত যে অর্থোপার্জন এমন স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ পুরুষের জন্য ধর্মীয় ও নীতিগতভাবে বাধ্যতামূলক নহে, তবে হয়ত অধিকাংশ পুরুষই স্ত্রীর কাছাকাছি থাকিত
http://www.rtnn.net/details.php?id=29085&p=1&s=27

লাইনগুলো কোট করেছি একটি অনলাইন ধারাবাহিক উপন্যাস থেকে। সমাজে নারীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে চিন্তা করছিলাম। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। পূর্বে নারীদের শিক্ষা ছিলনা,আয়ের স্কোপ ছিলনা কেবল ঘরের কাজ আর সন্তান পালনেই নারীরা আবদ্ধ ছিল বলে পুরুষের মত গুরুত্ব সমাজ দিতনা। তাই অনেক এনালাইসিস করে নারীরা চিন্তা করল শিক্ষিত হতে হবে, বাইরে জব করতে হবে, উপার্জন করতে হবে...তবেই নারীর মুক্তি। কিন্তু কেবল এই চক্রেই নারীরা থেমে থাকেনি, পুরুষের থেকে কিসে কম তারা? পুরুষরা যে কাজ করে সেখানেও নারীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তারা এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে এখন বিচরন করছেনা। চিকিৎসক,ইঞ্জিনিয়ার,জজ,ব্যারিষ্টার ই কেবল নয় আর্মি,পুলিশ,পাইলট সবখানেই নারীর আজ সদর্পে পদার্পন। কিন্তু নারী কি আজ সত্যিই স্বাধীন?

নারীরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। এজন্য কিসের স্বাধীনতা কিংবা কিসের সাথে তাল মিলিয়ে আসলে তারা নিজেদের কিভাবে সম্মানিত করতে চাইছে সেটা তারা নিজেও বুঝতে পারছেনা। নারী-পুরুষের অধিকার কখনও এক অপরের সমানে নয়, বরং স্বাতন্ত্রে। পুরুষের মত পোশাক পরলেই, পুরুষের সাথে কাজ করলেই নারী তার প্রাপ্য অধিকার কখনও পাবেনা।

নারী সমাজের উন্নতির জন্য যদি নারীরা তাদের আসল অধিকার কোথায় এবং সেটা কিভাবে পাওয়া সম্ভব সেটা যদি স্টাডি করত তাহলে বুঝতে পারত বর্তমান পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য দ্বন্দ্ব,হতাশা, সন্তানের অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য নারীর এই তথাকথিত মডার্নাইজেশান দায়ী।

পাশ্চাত্য উন্নত বিশ্বে নারীদের সাথে মুসলিম নারীরা যদি তাদের তুলনা করতে যায় তাহলে প্রথমেই যে ভুলটি হবে সেটা হল আইডিওলোজিতে। পাশ্চাত্য নারীরা প্রচন্ড পরিমান বস্তুবাদি জীবন যাপনে বিশ্বাসী। তাদের কাছে যেহেতু সৃষ্টিকর্তার কোন ধারণা নাই সেহেতু তাদের উন্নতির অন্যতম ইউনিট হচ্ছে পুরুষ। পুরুষকে অনুসরন করাই তাদের উন্নতি এবং আধুনিকতার ইউনিট। এজন্য তারা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নত ও আধুনিক হচ্ছে। এবং এতে করে তারা নিজেদের খুব সম্মানিত মনে করছে। তারা মনে করছে নারীরা এখন আর সন্তান উৎপাদনকারী নয়, তাই তারা সন্তানের দায় দায়িত্ব নেয়াকে নারীত্বের অবমাননা মনে করছে। ফলস্বরূপ মা-সন্তানের সম্পর্ক খুব শিথিল হয়ে পড়ছে, কেউ কারো কাছে দায়বদ্ধ না। সন্তানেরা এক গভীর সাইকোলজিক্যাল ট্রমাতে ভুগছে।

আমাদের দেশে কি ঘটছে এখন? খুব খুউব নিরাপদ সম্পর্কও এখন প্রশ্নের সম্মুখিন। সন্তানের হাতে মা কিংবা মায়ের হাতেই সন্তান খুন। পরকীয়ার জন্য একজন মা তখন কেবলই এক ক্রেজি নারী হয়ে উঠছে, সন্তানের কাছে তার 'মা' আইডেন্টিটিও তখন কেবল কর্পুরের মত বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অনেক আগেই প্রশ্নবিদ্ধ, এখন সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্কও প্রশ্নবিদ্ধ। হুম, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। নারীরা এখন অনেক স্বাধীন,মুক্ত। তারা এখন আর কোন কিছুর পরোয়া করছেনা। নিজের অধিকার আদায়ে কোন সম্পর্ককেও আর গুরুত্ব দিচ্ছেনা। যদি পাশ্চাত্যকে আদর্শ ধরা হয় তাহলে নারীর এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি, এই উন্নতি, এই আধুনিকতা সবকিছু নারীর উন্নতির স্পষ্ট সাইন।

কিন্তু ইসলামে নারীকে সর্বোচ্চ যে অধিকার দিয়েছে সেটার বিচারে নারীরা আজ কতটা স্বাধীন,সম্মানিত ও আধুনিক সেটা বিচার করি। নারী যদি নিজেদের অধিকার ও সম্মান আদায় করতে চায় তাহলে সেক্ষেত্রে নারীদের আদর্শ ধরতে হবে সেই সৃষ্টিকর্তাকে যিনি নারীকে সৃষ্টি করেছেন। রাসূল (সাঃ) এর সেই দুইটি হাদীস যেখানে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। আর সেই ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে যখন নবীজী(সাঃ) পরপর তিনবার মায়ের সেবার পর বাবার সেবার কথা বললেন তখন কিভাবে বলব যে ইসলাম নারীর সম্মান দেয়নি, অধিকার দেয়নি?

বর্তমান নারীরা অনেক বেশি সম্মান অর্জন করতে গিয়ে তাদের আসল সম্মানের জায়গাতে নিজেদের হিউমিলিয়েট করছে। তারা সুপার উইম্যান হতে চায়। একজন সফল ক্যারিয়ারিস্টিক নারী, সফল মা, সফল স্ত্রী, সফল হোমমেকার....সবকিছুতেই সফলতা অর্জন করতে গিয়ে নিজেদের উপর নিজেরাই বার্ডেন বয়ে আনছে। ক্যারিয়ারিস্টিক হওয়া মানেই পুরুষের মত হওয়া নয়, ক্যারিয়ারিস্টিক হওয়া মানেই পুরুষকে সফল ক্যারিয়ারের ইউনিট মনে করা নয়। ক্যারিয়ারিস্টিক হওয়া মানেই সন্তান জন্ম দেয়া ও পালন করা নারীত্বের অবমাননা নয়।
একজন নারী সফল ক্যারিয়ারিস্টিক, সফল মা, সফল স্ত্রী, সফল হোমমেকার হতে পারে যদি এই সফলতার ইউনিট মৃত্যুর পরের জীবনকে কেন্দ্র করে হয়। একজন নারী যদি তার পায়ের নিচে জান্নাতকে বাদ দিয়ে বস্তুবাদি সভ্যতা আর ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে থাকে তাহলে সে ক্যারিয়ারিস্টিক হতে পারলেও একজন সফল মা,স্ত্রী ও হোমমেকার হতে পারবেনা কখনও। আর যে সন্তান তার জান্নাত খুজে পাবে তার মায়ের নিচে সেই মা যদি সন্তান পালন করাকে নারীত্বের অবমাননা মনে করে তাহলে নারীর উন্নতি কেবল এই স্বপ্নময় জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে, মৃত্যু পরবর্তী অসীম বাস্তবতার জীবনে সবকিছু হবে শূন্য।

তাই পাশ্চাত্যের মত উন্নতি করতে গিয়ে মুসলিম নারীরা যদি পুরুষের মত সমান হওয়াকে আদর্শ ধরে তাহলে কাংখিত উন্নতি কখনই আসবেনা। সমাজে এক গভীর ক্ষত তৈরি হবে, আজকের সন্তানেরা বড় হবে নিরাপদহীন পৃথিবীতে, তারাই ভবিষ্যতে আরো গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়ে যাবে এই সমাজের বুকে। যেখানে সন্তানেরা তাদের মায়ের মাঝে খুজে পাবেনা তাদের জান্নাত সেখানে তারা কি শান্তি আনবে ভবিষ্যত সমাজের জন্য?

একজন শিক্ষিত নারী যদি বাইরে জব নাও করে তার সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ জব করতে হয় ঘরের ভিতরে। একজন নারী ঘরে বসে বিশ্ব পরি্চালনায় অংশগহন করে। এই বিশ্ব পরিচালনার কাজ নিশ্চয় এত সহজ না যতটা একজন নারী ভাবে! আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। আগামী ভবিষ্যতের দায়ভার একজন নারীকে নিতে হয়, কোন পুরুষকে নয়। তাদের পারিবারিক আবহে সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দেওয়া, মানসিক ও শারিরীক বিকাশে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি এসব কাজের জন্য যদি কোন প্রতিষ্ঠান খোলা হয় আমি নিশ্চিত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ও প্রেস্টিজিয়াস প্রতিষ্ঠান হবে সেটা। একটা শিশুর মনে মায়ের প্রভাব কিভাবে বিস্তার করে সেটা নিয়ে গবেষণা করলে সেই গবেষণার পেপার এতখানি গুরুত্ব পাবে পুরা বিশ্বে যে সবাই একথা
একবাক্যে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে যে এক মায়ের জন্যই পুরা পৃথিবী টিকে আছে। একথা আমি হলফ করে বলতে পারি কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক একজন সন্তানের জন্য নারীকে জান্নাতের পথকে সুগম করে দেবার কাজ পৃথিবীর হাজার শ্রেষ্ঠ কাজের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

সবকিছুর শেষে প্রতিটি নারীকে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, নিশ্চিত জান্নাতের মত উন্নতির পথ ছেড়ে কেন আপনারা একেবারে মূল্যহীন আধুনিক হবার প্রতিযোগীতায় নেমেছেন? আমাকে যদি অপশন দেয়া হয় তাহলে আমি সফল মা হয়ে ,পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাতকে নিজের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার হিসাবে বেছে নিব এবং সেভাবেই চেষ্টা করব। কারণ আমার ইউনিট ম্যাটেরিয়ালিস্টিক স্বপ্নীল পৃথিবী নয়, আমার ইউনিট অসীম বাস্তব জীবনে জান্নাত পাবার সার্থকতা। সেক্ষেত্রে একজন নারী হিসেবে এরচেয়ে সফল নিশ্চিত ক্যারিয়ার নারীরা আর কোথায় পাবে?

স্বপ্নময় জীবন !

দূর্গম পাহাড়ের উপর দিয়ে হাটছিলাম। কিন্তু কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথায় যাব। আমি একা না, সাথে আমার কিছু বন্ধুরাও ছিল। কিন্তু তারা যে কোথায় হঠাৎ উধাও হল বুঝতে পারছিনা। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসছে, তার মানে সূর্য ডুবে যাবে। মনের ভিতর ভয় আর শংকা জেগে উঠল। আমি খুব একটা ভীতু মেয়ে না। কিন্তু নাইট ফোবিয়া আছে আমার প্রচন্ড পরিমান। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন জানি! একটু শিহরন লাগে। চিন্তা করলাম, দেরি করে লাভ নেই, এখনি আমাকে দৌড়ে পালাতে হবে। কিন্তু একি? আমার পা যে মাটি থেকে সরছেনা! নাহ! খুব বেশি ভয় পেলে চলবেনা, আমাকে পালাতে হবে। যখন দৌড়াতে দৌড়াতে আমি অনেকদূর চলে এসেছি,ভাবলাম ওই অপরিচিত ছেলেরা আমার আর নাগাল পাবেনা ঠিক তখনি সামনে তাকিয়ে দেখি ম্যজিকের মত তারা যেন কোথা থেকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মধ্যে প্রচন্ড বড় একটা ধাক্কা খেলাম। পিছনেই তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের একদম শেষ চূড়া। একটু সরে গেলেই ঠিক ১০০ তলা সমান উপর থেকে নিচে গিরিখাদে পড়ে যাব। কি করব? প্রচন্ড ঘামছি। কি করব ভেবে না পেয়ে যখন পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দিতে যাব ঠিক তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল..........

যাক! ওটা তাহলে স্বপ্ন ছিল। কি অদ্ভুত স্বপ্ন। আরে বাবা, আমি কেন পাহাড়ে উঠতে যাব? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি আরে আমি মাত্র দশ মিনিট ঘুমিয়েছি। পড়তে পড়তে কখন টেবিলে ঘুমিয়েছি টের পাইনি। অথচ স্বপ্নে মনে হল আমি যুগ যুগ সময় পার করে এলাম।ভাগ্যিস ওটা স্বপ্নই ছিল!

জীবনটাও কি অদ্ভুত, স্বপ্নের মতই! জীবনের সংগা তাই খুঁজে ফিরি বারবার। জীবনের উদ্দেশ্য কি? এর সার্থকতা কিসে, কিসে ব্যর্থতা? কি ভাল? কি মন্দ? এই তো পাশের বাড়ির রব্বান চাচা,সারাজীবন ঘুস খেয়েছে, অন্যের সম্পদ ফাঁকি দিয়ে নিজে রাশি রাশি টাকার মালিক হয়েছে। এখন তার বাড়ি,গাড়ি সবই আছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। আর জামাল চাচা! সারাজীবন সৎ উপায়ে চাকরি করেছে, কখনও টাকার কাছে নিজের সততা বিকিয়ে দেয়নি। আজ শেষ বয়সে মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে জেলে পড়ে আছে। মোটা অংকের টাকা না দিলে নাকি মুক্তি মিলবেনা। আর তার একমাত্র কর্মোক্ষম ছেলেটার নাকি কি জটিল অসুখ হয়েছে, লাখ লাখ টাকা না দিলে নাকি চিকিৎসা হবেনা।

হায়রে জীবন! যে সারাজীবন অন্যের হক নষ্ট করল সেই আজ সুখী। আর যে কষ্ট করে সৎ থেকে গেল আজীবন, সেই অসুখী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সৃষ্টিকর্তা বলে কি কিছু আছে এই পৃথিবীতে? থাকলে কি সে ন্যয় বিচারক? তাই যদি হয় তাহলে এ কেমন তার ন্যয় বিচার??

যারা বস্তুবাদি তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তা বলে আসলে কিছু নাই, কারণ সৃষ্টিকর্তা থাকলে তো আর জামাল মামার মত লোকেরা জীবনে এত কষ্ট ভোগ করতনা। অন্যদিকে রব্বান চাচার মত লোকেরাও আর সুখে থাকতনা। সুতরাং জীবনের সাকসেস মূলতঃ এই জীবনেই। যত বেশি হাই স্ট্যাটাস,যত বেশি গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারব, তা সে যে উপায়েই হোক না কেন তাহলে আমি সার্থক। কি হবে সৎ থেকে? সৎ থেকে যদি জীবনকে উপভোগ করতে না পারলাম তাহলে সেই জীবনের সাকসেস বলে আর কিছু থাকল?

ভাল কিংবা মন্দের কি আসলেই এবসলিউট কোন সঙ্গা আছে? যে ছুরি দিয়ে একজন খুনি মানুষের গলা কাটে সে খারাপ,মন্দ। আর একই ছুরি দিয়ে যদি ডাক্তার মানুষের গলা কাটে তাহলে সে মহৎ। কি অদ্ভুত। ভাল-মন্দের ইউনিট তাই একেক জনের কাছে একেকরকম। একজন চোরও তার চুরির পক্ষে সাফাই গাইবে। আর জীবনের উদ্দেশ্য? সেটা তো আরো বেশি রহস্যময়।
যে ছেলেটি বিয়ে করার জন্য কেবল সুন্দরী-রূপসী মেয়ে খুঁজে, যার বাবার প্রচুর টাকা আছে, সমাজে একটা স্ট্যাটাস আছে তার উদ্দেশ্য হল বন্ধুদের কাছে নিজের প্রেস্টিজ বাড়ানো, স্ট্যাটাস বাড়ানো। আর যে ছেলেটি বিয়ের জন্য একজন সৎ চরিত্রের মেয়ে খুঁজে যার মেধা আছে, জ্ঞান আছে, যে পারসোনালিটি সম্পন্ন। তার উদ্দেশ্য জীবন চলার পথে শত বাধা আসলেও যেন মেয়েটি তার চরিত্রের আলো দিয়ে, জ্ঞানের মাধুর্য দিয়ে সব বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। দু'টি ছেলে, যাদের উদ্দেশ্য দু'রকম। কে জানে কোনটি ভাল? কোনটি মন্দ?

জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনে স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে, জ্বীন ও মানুষ জাতিকে কেবল আল্লাহর ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জীবনের সাকসেস সেটাই যা আল্লাহর সান্নিধ্য আনে, ব্যর্থতা সেটাই যা আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কারো কোটি কোটি টাকা যদি তাকে দাম্ভিক করে তোলে, তাকে অন্যায়-অবিচার করার ইন্ধন যোগায়, আল্লাহর স্মরন থেকে গাফেল করে তোলে তাহলে তার সেই কোটি কোটি টাকায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অন্যদিকে কারো জীবনের চরম দারিদ্য তাকে ধৈর্য্যশীল করে, অসৎ হতে বিবেকে বাধা দেয়, আল্লাহর আরো বেশি কাছাকাছি হবার সুযোগ করে দেয় তাহলে সেই দারিদ্র্যই তার জীবনের চরম সার্থকতা। অন্যদিকে যারা বস্তুবাদি, স্বল্পদৃষ্টির লেন্স নিয়ে জীবনকে দেখে তাদের কাছে জীবনের সাকসেস-ব্যর্থতার হিসাব পুরাই উলটা হবে।

মৃত্যুর পর যখন জেগে উঠব, যখন অপরাধীরা তাদের সকল অপকর্ম দেখতে পাবে তখন তারা চিৎকার করে বলে উঠবে, আমরা তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে ছিলাম মাত্র। অল্প একেবারে অল্প সময়ের জন্য আমরা পৃথিবী নামক গ্রহে বিচরন করেছিলাম। সেখানে কালো টাকার এসি গাড়িতে চড়ে মনে করেছিলাম, এটাইতো জীবন! আমাদের যেন আমাদের পৃথিবীতে ফেরত দেয়া হয় তাহলে আমরা কিছু ভাল কাজ করে আসতে পারি।

স্বপ্নময় এই জীবন। স্বপ্নীল এই জীবনেও সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি তো দেখছেন এই স্বপ্নের সামান্য সময়ে কে তার সান্নিধ্য পাবার জন্য অবিরাম কষ্ট করে যাচ্ছে। তিনি তো তার জন্য মৃত্যুর পরে সেই অসীম বাস্তব জীবনে এক বিশাল সুখের সম্ভার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনিই তো ন্যয় বিচারক। আর যে বস্তুগত সুখ নিয়ে সুখি, যে অন্যকে ঠকিয়ে কালো টাকার পাহাড় জমিয়ে খুশি তাকেও তিনি দেখছেন, তার জন্যও তিনি অসীম বাস্তব জীবনে সীমাহীন আযাব নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তার মত ন্যয়বিচারক আর কে হতে পারে?

জীবনের উদ্দেশ্য,সাকসেস, ব্যর্থতা, ভাল, মন্দ এই স্বপ্নীল জীবনের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে হিসাব নিকাশ করা যাবেনা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়ে দুঃস্বপ্নের মতই জীবনটা কে দুর্বিষহ মনে হবে। মনে হবে কত যুগ ধরে আমি স্বপ্ন দেখছি অথচ জেগে উঠার পর মনে হয়ে কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক মিনিট। ঘুম থেকে উঠার পর মনে হবে ভাগ্যিস ওটা স্বপ্ন ছিল! স্বপ্নের মধ্যে যত সুখেই থাকিনা কেন জেগে উঠার পর মনে হয় সেই সুখ কিছুইনা। আর যত বিপদেই থাকিনা কেন, ঘুম কেটে যাবার পর খুব স্বস্তিতে থাকি এটা ভেবে যে ওই বিপদ সত্যি ছিলনা।

জীবনটা তাই স্বপ্নময়। জীবন শুরু হবে তখন যখন আমরা মৃত্যুর পরে জেগে উঠব। তখন অসীম সেই মৃত্যু পরবর্তী বাস্তব জীবনের কাছে পার্থিব জীবন খুব বেশি হেয়ালি মনে হবে । যেমন উপরে বর্ণিত স্বপ্নের মতই ঘুম থেকে জেগে উঠার পর আমার মনে হয়েছিল....................

শূণ্য হৃদয় !

হৃদয়কে শূণ্য করতে হবে। পূর্ণ পাত্রে কিছু ঢুকাতে চাইলেও আর ঢুকানো যাবেনা। হৃদয় পবিত্রকরণের জন্য তাই সর্বপ্রথম বিভিন্ন কৃত্তিম বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়কে শূণ্য করতে হবে। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হল একত্ববাদ বা তাওহীদ। সেই একত্ববাদের মুল ভিত্তি হল হৃদয় শূণ্য করা।

কাউকে যদি ভালবাসি তাহলে প্রথম শর্ত হল ভালবাসার সেই দাবিতে অন্য কারো হক থাকবেনা। সামান্য প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসায় যদি তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে তাহলে ভালবাসায় ফাটল ধরে। আর যিনি পুরা বিশ্বজাহানের অধিকারি তার প্রতি ভালবাসার নিরংকুশ অধিকারে অন্য কারো দাবি থাকা সাধারণ সেন্সেও অযৌক্তিক লাগে। তাই বান্দার একচ্ছত্র শর্তহীন সীমাহীন ভালবাসার একমাত্র দাবিদার সেই বিশ্বজাহানের মালিক ছাড়া আর কার হতে পারে?

হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে যখন বৃদ্ধ বয়সে তার প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কুরবানি করতে বললেন তখন তো ব্যসিক্যালি আল্লাহ দেখছিলেন ভালবাসা কার প্রতি বেশি। সন্তানের প্রতি নাকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি? আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ) এর হৃদয়কে শূণ্য করলেন পার্থিব ভালবাসা থেকে। তাওহীদের বানী গেঁথে দিলেন।

ইসলামের ৫টি মূল ভিত্তির মেইন থিম হল যাবতীয় সকল পার্থিব বিষয় হতে হৃদয় শুণ্য করা। কলেমার প্রথম বাক্য হল কোন ইলাহ নেই। আমাদের কে অনুভব করতে হয় এই জগতে কোন ইলাহ নেই, কোন ক্ষমতাশীল নেই যে এই জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আকাশ ও পৃথিবী মন্ডলে এমন কেউ নেই যার কাছে সবকিছু জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের হৃদয় শূণ্য করা হল কলেমার এই প্রথম বাক্য দিয়ে। এরপরই বলা হল, একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত। অর্থাৎ কোন ইলাহ নেই একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত। হৃদয়কে শূণ্য করেই সেই শুণ্য হৃদয় আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হল।ময়লা-আবর্জনা দিয়ে পূর্ণ পাত্র পরিষ্কার করতে হলে সর্বপ্রথম সেই পাত্র খালি করতে হয়। তদ্রূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস, পার্থিব আবেগ, মোহ, ভালবাসা সবকিছুকে পিছনে ফেলে কেবল এক আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়। এক আল্লাহর প্রতি সমগ্র বিশ্বাস, ভালবাসা,নির্ভরতা দিয়ে হৃদয়কে পূর্ণ করতে হয়।

এরপর নামাজ। এখানেও হৃদয় শুণ্য করতে হয় সর্বপ্রথম। আমি সারাদিনে পাঁচবার যখন আল্লাহকে স্মরন করি তখন আমি যত কাজেই থাকিনা কেন, যত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকুক না কেন সবকিছুকে ইগনোর করে হৃদয়কে কেবল আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। পার্থিব সব চাহিদা,প্রয়োজনীয়তা থেকে হৃদয়কে শূণ্য করে সেই এক আল্লাহর প্রতি ভালবাসা দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করতে হয়। দিনে হয়ত একবার সময় করে নামাজ পড়লেই হয়ে যেত। কিন্তু ভালবাসার দাবিতে সকাল,দুপুর,বিকাল,সন্ধ্যা,রাত অর্থাৎ সমগ্র দিন-রাতে আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। একত্ববাদ দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করার জন্য পাচবার হৃদয়কে শূণ্য করতে হয়।

সাওম বা রোজা। এটা তো হৃদয় শূণ্য করার একদম বাস্তব প্র্যাকটিস। শারীরিক,মানসিক,জৈবিক সব চাহিদা থেকে বিরত থাকতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও পারবনা একটিবারের জন্য সামান্য পানি পান করতে। সমগ্র ইচ্ছার অধীন একমাত্র আল্লাহ। তার জন্য ইচ্ছাকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। লুকিয়ে, গোপনে হয়ত অনেক কিছুই করা যায় কিন্তু যখন এটা বিশ্বাস করা হয় যে প্রকাশ্য ও গোপন কোন কিছুই তার অজানা নয় তখন সমগ্র পার্থিব ইচ্ছা দিয়ে পরিপূর্ণ হৃদয়কে রিক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সেই রিক্ত হৃদয় পূর্ণ করতে হয়।

সম্পদের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা কে যাকাত দিয়ে মিনিমাইজ করতে হয়। সম্পদের প্রতি ভালবাসা ত্যাগ করতে হয়। সেই কিয়ামতের দিন যখন পার্থিব সোনা-রূপা কোন কাজেই আসবেনা তখন এই পৃথিবীতে পার্থিব সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার আর কি মানে রইল? যারা অভাবী, খেতে পায়না দু’মুঠো, এতিম,মিসকিন সবার প্রতি নিজের কষ্টে অর্জিত সম্পদ থেকে ভাগ দিতে হয়। কি এত দায় পড়েছে তাদের আমি যাকাত দিব? কষ্ট করে আমি সম্পদ উপার্জন করেছি। আমার সম্পদে তাদের কেন হক থাকবে? এই পার্থিব সম্পদের প্রতি ভালবাসা পুর্ণ হৃদয়কে পুনরায় শূণ্য করতে হয়। সম্পদের পরিপূর্ণ যাকাত আদায় করে শূন্য হৃদয় আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে পূর্ণ করে নিতে হয়।

বছরে একবার হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। আমি অনেক হাই স্ট্যাটাস মেইনটেইন করি। আমার ফ্যামিলি, আমার পড়াশুনা, আমার চাকরি সবকিছুই অনেক বেশি প্রেস্টিজিয়াস। তাই অবশ্যই আমার আর একজন সাধারণ মানুষের সাথে পার্থক্য থাকবে ড্রেসে,গেটআপে, চলাফেরা, কথা-বার্তা সবকিছুতে। হজ্ব আমাদের এই হাই স্ট্যাটাস,সুপিরিয়রিটি সিন্ড্রোমে পূর্ণ হৃদয়কে শূণ্য করে। এখানে সবাইকে এক পোশাকে, একই কাতারে, একই গেটআপে এক আল্লাহর জন্য দাঁড়াতে হয়। কোন ভেদাভদেদ করা যায়না কে সুপিরিয়র কে ইনফিরিয়র। আমাদের হৃদয়কে শূণ্য করা হয় এভাবে যে পার্থিব এই সুপিরিয়রিটি আল্লাহর সুপিরিয়রিটির কাছে কিছুইনা। শুধু মানসিকভাবে কন্ডিশনিং হয় তা নয়। সম্পদের মোহ ত্যাগ করে, পার্থিব সময়ের গুরুত্ব ত্যাগ করে, শারীরিক আরাম-আয়েশের সুযোগকে পিছনে রেখে এক আল্লাহর জন্য অনেক হাই স্ট্যাটাস হওয়া সত্ত্বেও খুব লো স্ট্যাটাসের কারো পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অনুসন্ধান করতে হয়। হৃদয়কে কত সুচারুভাবে এক হজ্বের মাধ্যমে শূণ্য করে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করা হয়।

পার্থিব জিনিসে পূর্ন হৃদয় আল্লাহর ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করা যায়না। এজন্য বলা হয়েছে যারা বিশ্বাস করেনা তাদের যতই শুনানো হোক তারা শুনবেনা, তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। কারণ তাদের হৃদয় অলরেডি ভ্রান্ত বিশ্বাস,মোহ,ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ। একমাত্র তারাই আল্লাহর ভালবাসা , অনুগ্রহ পেতে পারে যারা সেইসব ভ্রান্ত বিশ্বাস, পার্থিব মোহ থেকে হৃদয়কে শূণ্য করতে পেরেছে।

তাওহীদের যে বানী প্রথমেই হৃদয়কে শূন্য করার তাগিদ দিয়েছে তা কেবল বাক্যেই সীমাবদ্ধ থাকেই, বরং একজন মুসলিম তার সমগ্র লাইফে কিভাবে হৃদয় শূন্য করবে তার একটা প্রোটোকলও দিয়েছেন আল্লাহ। দুনিয়া থেকে দুনিয়াবি স্বার্থ যেমন হাসিল হয় তেমনি অপার্থিব স্বার্থও এই হৃদয় শূন্যের মাধ্যমে হাসিল হয়। হৃদয়কে তাই সেই প্রোটোকল অনুযায়ী শূন্য করার চেষ্টা করছি। সেই একমাত্র মহান অধিপতি আল্লাহর দিকেই হৃদয়কে পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর একত্ববাদ দিয়ে হৃদয় পূর্ণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

(ইয়াসমিন মুজাহেদ’র আর্টিকেল অবলম্বনে)

হোস্টেল লাইফ-৬

ঢাকায় থাকি বলে সবসময় হোস্টেলে থাকা পড়েনা। তারপরও মেডিকেলে হোস্টেলে থাকাটা কিছুটা বাধ্যতামূলক। তা না হলে পড়াশুনা করা যায়না। আমার তো এখন ভাবতেই অবাক লাগে কিভাবে মানুষ বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। হোস্টেলে না থাকলেও এটলিস্ট লাইব্রেরিতে বসে রিডিং পার্টনারের সাথে পড়া ছাড়া আমি বাসায় একা একা পড়াশুনার কথা ভাবতেই পারিনা। সেকেন্ড প্রফ শেষ হল। বলা যায় প্রায় টানা আড়াই মাস হোস্টেলে আছি। মাঝখানে একদিন-দুইদিন করে মাঝে মাঝে বাসায় বেড়াতে যেতাম।

আসলে হোস্টেলে লাইফের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হল মানুষকে চেনা, বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরো বেশি উপলব্ধি করা। আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে হল এই তো পাচ মাস হল। ওর ধারণা ছিল জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হল হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। বাকি সব সম্পর্ক কারো সাথে না থাকলেও চলে। ও ভেবেছিল বন্ধুত্বের সম্পর্কও হাজব্যন্ড দিয়ে ফিল আপ করা যাবে। কিন্তু কি আর করা, ভাইয়াও ডাক্তার। সময় দিতে পারেনা একটুও। তাই আমার ফ্রেন্ড একটু দুঃখ করে বলছিল আসলে জীবনে সব সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই যে হোস্টেলে আছি, ফ্রেন্ডের সাথে পড়ছি, অনেক কিছু শেয়ার করছি এটা তো আর সবার সাথে শেয়ার করা যায়না। বন্ধুদের সাথে যেটা শেয়ার করা যায় তা কি আর হাজব্যান্ডের সাথে শেয়ার করা যায়? কিংবা হাজব্যান্ডের সাথে যা শেয়ার করা যায় তাতো আর বন্ধুদের সাথে করা যায়না।

আবার বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝেও অনেক ধরনের সম্পর্ক থাকে। সেই সম্পর্কও মেইনটেইন করা শেখা যায় হোস্টেলে থেকেই। আমার হয়ত তিনজন ফ্রেন্ড খুব ক্লোজ, কিন্তু তারপরও আমার কোন ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে হয়ত আমি কেবল একজনকেই সব শেয়ার করব। কিংবা আমি যাকে খুব ফ্রেন্ড ভাবছি সে আমাকে আদৌ তা হয়ত ভাবছেনা। যাকে ফ্রেন্ড মনে করে অনেক কিছু শেয়ার করলাম সে হয়ত সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলনা। এরকম বন্ধুত্বের মাঝে বহু সম্পর্ক থাকে যা আসলে ডিফাইন করা যায়না। কিন্তু তারপরও আমরা সবাই ফ্রেন্ড।

হোস্টেলে থাকার ফলে আমি যে জিনিসটা খুব প্র্যাক্টিক্যালি শেখার চেষ্টা করেছি তা হল এটিচিউড পরিবর্তন করা। প্রতিটা মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। একেকজন একেকরকম। আমার চিন্তা-ভাবনার সাথে হয়ত সবাই মিলে যাবেনা। হয়ত আমি যেরকম করে একজনকে নিয়ে ভাবি, সে আমাকে নিয়ে ভাববেনা। আবার আমাকে নিয়েও কেউ হয়ত একরকম চিন্তা করবে, আমি মোটেই সেরকম না। এরপর বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কিছুটা ফাটল। একটা কথা আছে, নিজে ভাল তো জগত ভাল। এই ব্যাপারটা আসলেই তাই। নিজে যদি সবসময় যেকোন সিচুয়েশানে এটিচিউড পজিটিভ রাখতে পারি তাহলে সব সমস্যা নিমেষেই শেষ।

থিওরিটিক্যাল এরকম বহু কথা এর আগে আমি শুনেছি। কিন্তু যে আমাকে ভুল বুঝল, মনে করল আমি তার আসল বন্ধু না, এজন্য হয়ত এমন কিছু কাজ করল যা কখনই পজিটিভ এটিচিউড দেখানোর মত মানসিক পরিস্থিতি থাকেনা। কিন্তু এই সি্চুয়েশানেও যদি পজিটিভ এটিচিউড দেখানো যায় তাহলে অন্যরকম একটা আউটপুট পাওয়া যায়। একেবারে প্র্যাকটিক্যাল, কোন হাইপোথিসিস না।

কিন্তু এর জন্য যেটা দরকার সেটা হল নিজের প্রতি পর্যবেক্ষন। আমি কখনই ১০০% সঠিক না। অন্য কেউও ১০০% সঠিক না। কিন্তু সবার মাঝেই অবশ্যই ভাল কিছু থাকে যা সবকিছুর উপরে থেকে তার প্রতি পজিটিভ এটিচিউড দেখানো যায়। একজন যদি ভাল নাও হয় , জেনে রাখতে হবে সে একেবারে খারাপও না। তার সেই ভাল দিক চিন্তা করেই পজিটিভ এটিচিউড দেখাতে হয়।

জীবনের আসলে অনেক অর্থ আছে। জীবনে অনেক কিছু করার আছে। ছোট এই জীবনে শুধু শুধু মাইনর ব্যাপার নিয়ে সম্পর্কের মাঝে একটি অবিশ্বাস তৈরি করার কোন মানে নাই। কারো সাথে শত্রুতা মনোভাব নিয়ে থাকারও কোন মানে নাই। কেউ আমাকে বন্ধু ভাবুক আর নাই ভাবুক আমি অন্তত কাউকে শত্রু ভাববনা। এই পজিটিভ এটিচিউড যদি নিজের মধ্যে গ্রো করানো যায় তাহলে দেখা যায় সময় গুলো আর বন্ধুদের সাথে অন্য কারো সমালোচনা, গীবত করে কাটেনা। বন্ধুদের সাথে সময়গুলো আরো বেশি মধুর আর অর্থবোধক হয়ে উঠে। জীবনের আসল মিশন থেকে দূরে গিয়ে আর অন্যের ব্যাপারে শত্রুতা পোষণ করাকে তখন খুব বোকামি মনে হয়। মনে হয় আসলে সত্যিই বন্ধুত্ব একটি অন্যরকম উপহার।

বন্ধুত্বের প্রতি না কেবল, জীবনের সকল সম্পর্কের প্রতি যদি পজিটিভ এটিচিউড দেখাতে পারি তাহলে আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই সুন্দর হয়ে উঠবে যা আগে কখনও এত সুন্দর হয়ে দেখা দেয়নি। মনে হবে এই একটি মাত্র জীবনে আসলে ইরিভারসিবল বলে কিছু নাই। সবকিছুই রিভারসিবল হতে পারে। যাকে কখনই ক্ষমা করবনা বলে মনে করা হয় সেই হতে পারে জীবনের পরম বন্ধু। যে ভুল কখনই শোধরানো যাবেনা বলে মনে হয় সেই ভুল থেকেই কেউ হয়ত আরো বেশি শুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।

হোস্টেলে থেকে আসলে বিভিন্ন বন্ধুর সাথে পজিটিভ এটিচিউড দেখানোর একটি প্র্যাক্টিক্যাল প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যায়। আর সেটা যদি জীবনের সকল সম্পর্কেও এপ্লাই করা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। !!!

আক্ষেপ ! :-(

কয়েকদিন ধরে মনের ভিতর কিছু আক্ষেপ জমা হয়েছে। কেমন আছি কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলব ভাল আছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আসলেই কি আমি ভাল আছি? তুলনামূলক ভাবে হয়ত ভাল আছি তাদের তুলনায় যারা আমার থেকেও খারাপ অবস্থায় আছে। প্রতিনিয়ত যত বেশি কাজের চাপ বাড়ছে, পড়াশুনার ব্যস্ততা বাড়ছে তত নিজেকে অসুখী মনে হচ্ছে।

সেদিন পড়তে গিয়েই হঠাৎ মনে হল এমন কোন সিস্টেম যদি থাকত যে যা পড়তে চাই তা সব ব্রেইনের মধ্যে আপলোড হয়ে যাবে। তাহলে কষ্ট করে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কষ্ট করে বই এর সামনে বসে থাকা লাগবেনা।প্রতিদিন ক্যাম্পাসে যেতে কার ভাল লাগে? খুব টায়ার্ড ফিল করছিলাম সেদিন, কিন্তু কি আর করা! যেতেই হবে। মনে হচ্ছিল এমন কোন ব্যবস্থা যদি থাকত যে মনে চাইল আর সাথে সাথে সেখানে চলে গেলাম। এরপর পরীক্ষার আগ মুহূর্তে যখন খাওয়ার সময়ও থাকেনা তখন মনে হয় যে ইশ! খেতে চাই মনে হলেই যদি খাবার সব সামনে হাজির হয়ে যেত! এরপর অটোমেটিক্যালি সব খাওয়া হয়ে যেত...এসব হাবিজাবি আক্ষেপে আজকাল মন ভারাক্রান্ত থাকে।
বিকেলে লাইব্রেরি থেকে বাসায় ফেরার পথে যখন মাথার উপর নির্মল আকাশ দেখি, একঝাঁক পাখিদের আনন্দে উড়াউড়ি দেখি তখন নিজের মনের আক্ষেপ আরো বেশি বেড়ে যায়। একদম যদি ফ্রি হয়ে যেতে পারতাম যাবতীয় সব টেনশান থেকে, ওই দূর আকাশের পাখিদের মত যদি আনন্দে ডানা মেলে উড়তে পারতাম!

খুব শখ, গভীর রাতে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নভোবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আকাশের তারা দেখার। সারারাত আকাশের ওই তারাগুলোর সাথে নিরিবিলি সময় কাটাবার। নিজের সাথে নিজেকে বোঝাপড়ার জন্য এর থেকে ভাল মুহূর্ত আর কি হতে পারে! কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে টানা ভিজে যাওয়া আর প্রকৃতির সাথে চুপি চুপি খেলা করা। কিন্তু কি এক জীবন...যেখানে এসব শখ বিলাসিতা ব্যতিত কিছুইনা।
মন খারাপ থাকলে কেন জানিনা যা কিছুই করতে যায় সেসব কাজে গভীর মনোযোগ দিতে পারি। সময়ের তাড়াহুড়া থাকেনা তখন। ঠিক এরকম একটি মুহূর্তে যখন কুরআন পড়ছিলাম তখন মনের ভিতরের আক্ষেপ আরো বেশি জোরাল হয়ে উঠল। আরবী ভাষা যদি বাংলার মত ফ্লুয়েন্টলি বুঝতে পারতাম! বারবার আরবি পড়ে বাংলা অনুবাদ পড়তে ভাল লাগেনা। ছোটবেলা থেকেই এটলিস্ট একজন মুসলিম হিসেবে আরবি ভাষা সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে শেখা কি উচিত ছিলনা? ইংরেজি নিয়ে কত মাতামাতি আমাদের। কেন সাথে আরবি ভাষা থাকলে কি খুব অসুবিধা হয়ে যেত ক্যারিয়ারের পথে? হঠাৎ এই আক্ষেপ মনে হতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পরবর্তি জেনারেশানের জন্য ইংলিশের পাশাপাশি আরবি ভাষা কম্পালসারি হিসাবে রাখব। ঠিক এই সিদ্ধান্তে আসার পর একটু ভাল অনুভূত হচ্ছে...মনের আক্ষেপ ধীরে ধীরে নিউট্রাল হচ্ছে।

কোথায় যেন পড়েছিলাম প্রভু থাকেন দূর্বল মানুষের অন্তরে। ঠিক জানিনা কথাটা কোন এঙ্গেল থেকে বলা হয়েছে, তবে কথাটার মধ্যে কিছু নাস্তিক্যবাদী ঘ্রাণ আছে। আগে একটা সময় নাস্তিক-আস্তিক আমার কাছে খুব স্পর্শকাতর একটা ইস্যু ছিল। কিন্তু সময়ের গতিবেগের সাথে যেসব খুব স্পর্শকাতর ব্যাপার ছিল আমার কাছে তা ধীরে ধীরে খুব সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। আসলে বিশ্বাস ব্যাপারটা একদম অন্তরের অন্তস্থলের ব্যাপার। এই ব্যাপারটা নিয়ে যে চিন্তা করেনা তার সাথে নাস্তিক-আস্তিক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলোচনা চালিয়ে যাওয়া নিছক বোকামী ছাড়া কিছু মনে হয়না।

মানুষ দূর্বল কিনা জানিনা তবে চারপাশে যখন অন্যায়-অবিচার দেখি, যখন একজন নিরপরাধ মানুষকে শুধু শুধু শাস্তি পেতে দেখি, যখন কঠিন অপরাধীদেরও দিব্যি নিরপরাধ হিসেবে ক্রুর হাসি হাসতে দেখি তখন পৃথিবীর সকল মানুষকে আমার বড় দুর্বল মনে হয়। শুধু এটুকু মনে হয়, প্রভু যদি সত্যি না থাকত তবে পার্থিব আক্ষেপের কোন সীমা পরিসীমা থাকতনা। জীবনকে তখন মনে হত এক অভিশাপের প্রতিচ্ছবি। আক্ষেপ ধীরে ধীরে ডাইলিউট হতে থাকে যখন চিন্তা করি সেই বিচার দিবসে এমন একজন বিচারপতি হবেন যার দ্বারা ইনজাষ্টিস হবার কোন চান্স নাই। যিনি হবেন সকল বিচারকের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠতম বিচারক। যিনি প্রত্যেকের চুল পরিমান ন্যয় ও অন্যায়কেও বিচারের আওতাধীন রাখবেন। ইশ! যত কুরআন পড়ি ততই বুঝতে পারি, মানুষ আসলেই কত দুর্বল। যে কিনা নিজের সবচেয়ে কাছের একজনকে সন্ধান করতে পারেনা। যে কিনা তার সর্বমুহূর্তের সঙ্গি কে আবিষ্কার করতে পারেনা। সত্যিই মানুষ আসলেই দূর্বল যদি সে তার প্রভুকে চিনতে না পারে।

জীবন নিয়ে আসলে আমরা যে যেরকম ভাবিনা কেন আসলে তা পুরাই আক্ষেপে ভরপুর। এবং আক্ষেপ যদি সারা জীবনও করে যাই তাও পূর্ণ হবার নয়। মানব হৃদয়কে পৃথিবীতে আসলে এরকম করেই পাঠানো হয়েছে। আমার যত আক্ষেপ তা সবই স্বর্গীয় আক্ষেপ। মন যা চাইবে তাই সাথে সাথে হয়ে যাবে। এটা তো সেই চির আকাংখিত জান্নাত ব্যতিত কোথাও পূর্ণ হবার না। স্বর্গীয় আক্ষেপ আছে বলেই হয়ত জীবন টা মাঝে মাঝে বোরিং হলেও কোন কিছুর পাবার আকাঙ্ক্ষা সব কষ্টকে , সব দুঃখকে সহ্য করা যায়। এভাবেই জীবন কেটে যাবে স্বর্গীয় আক্ষেপের মধ্য দিয়ে। তাই হয়ত কোরআনে যে বার বার সেই মোহময় জান্নাতের বর্ণনা দেয়া হয় সৎকর্মশিল মুমিনদের জন্য যা কোন মানব হৃদয় কল্পনা করতে পারবেনা তা সত্যিই অসাধারণ। একদম মানব মনের ভিতরের আক্ষেপের পূর্ণতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি জীবনকে খুব জীবন্ত করে তোলে। নতুন করে আবার রিভাইভ করতে ইচ্ছা করে। আক্ষেপের তীব্রতা যতই বাড়ছে ততই জীবন আরো জীবন্ত হয়ে উঠছে.........

মনোরসায়নঃ এলোমেলো আলাপ-৬

কয়েক মাস আগে “Road To Mecca”র বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনও কোন ইংলিশ বই এর বাংলা অনুবাদ পড়বনা। অনুবাদ আসলে খুব কঠিন ছিল কিনা জানিনা, তবে আমার পড়তে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। যাইহোক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পল কেলহো’র দুইটি ইংলিশ নভেল পড়লাম। একটি বই ছিল একটি মেয়ের জীবনী নিয়ে যা সে তার নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিল। পড়ে মারাত্বক অভিভূত হলাম।
এই ডায়েরি জিনিসটা কেন যেন আমার কখনও মেইনটেইন করা হয়না। ছোটবেলা থেকেই অনেক বার এটেম্পট নিয়েছিলাম ডায়েরি নিয়মিত লেখার। অবশ্য এই এটেম্পট নেবার পিছনে অন্য আরেকটি কারণও ছিল, তা হল প্রচুর ডায়েরি গিফট পেতাম।কিন্তু আসলে শেষ পর্যন্ত কোন ডায়েরি আমি লিখতে পারিনি।

যাইহোক, ডায়েরি নিয়মিত লিখলে একটি জিনিস খুব ভালভাবে এনালাইসিস করা যায় তাহল- নিজের ম্যাচিউরিটির ক্রমাগত পরিবর্তন। মেডিকেলের এক ভাইয়া বলছিলেন যে তিনি ক্লাস ফাইভ থেকে ডায়েরি লিখেন, এবং তিনি দেখেছেন যে তার ব্যসিক চিন্তা-ভাবনার কোন পরিবর্তন এখনও হয়নি। আমার তো মনে হয় গতকাল আমি যে চিন্তা করেছিলাম তা আজকেই কিছুটা হলেও মডিফাই হয়ে যাবে।
হুম, ব্যসিক চিন্তা হয়ত সেভাবে মডিফাই হবেনা, কিন্তু আশেপাশের চিন্তা অবশ্যই

ছোটবেলা থেকেই খুব কৌতুহল ছিল সবকিছুর প্রতি। যা সাধারণত সবার ভিতরই থাকে। এই যেমন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, পাশে কোন দোকান। সেই দোকানে কি আছে, লোকজন কিভাবে কেনাকাটা করছে, কিভাবে কথা বলছে সব কিছুর প্রতি চরম আকর্ষণ। ক্লাস সেভেন অথবা এইটে থাকতে বিজ্ঞানীদের সংগা পড়েছিলাম যে বিজ্ঞানী হবার মেইন শর্ত হল কৌতুহল থাকা। অর্থাৎ জানার আগ্রহ যার মধ্যে নাই সে কখনও বিজ্ঞানী হতে পারবেনা। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমার বিজ্ঞানী হবার স্টেপ শেষ। কারণ কৌতুহল কমে যাচ্ছিল সবকিছুর প্রতি। কেন হবেনা! পড়াশুনার প্রতি কৌতুহল আমার কোন কালেও ছিলনা। জানার আগ্রহ আছে তবে সেটা অবশ্যই পড়াশুনার বাইরের জগতের প্রতি।

সেদিন ভাবছিলাম যে বাংলাদেশের মানুষের অনেক সম্ভাবনা ছিল যুগে যুগে ভুরি ভুরি বিজ্ঞানী প্রজনন করার। ফার্মগেটের রাস্তার পাশে দাড়ালে দেখা যায় কেউ মাইকে ওয়াজ করে ভিক্ষা করছে, কিছু মানুষ তার পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাসুন্দি দিয়ে আনারস বিক্রি করছে তার পাশেও কিছু মানুষের ভিড়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যে রাস্তা খননের কাজ চলছে কিংবা ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে তার পাশেও ভিড়। এত্ত কৌতুহল সবার!! আবার কেউ রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে তার পাশেও ভিড় লেগে থাকে। কোথায় ইনজুরড লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে তা না করে সব তাকিয়ে তাকিয়ে ভিড় করে দেখে। কি যে দেখে আল্লাহই জানে!
বলছিলাম চিন্তাভাবনার পরিবর্তন...হুম। সেদিন এক ব্যসিক চিন্তা পুরাপুরি পরিবর্তিত হয়ে গেল। এবং কথায় কথায় ফ্রেন্ডকে সেদিন একথা বলছিলাম, দেখলাম সেও কিছুটা কনফিউসড।
আমরা যারা অন্যদের বদলে দেবার প্রত্যয় নিয়ে সর্বদা চিন্তা করি ভেবেও দেখিনা সবচেয়ে বড় পরিবর্তন নিজেদের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের সমগ্র কাজের ইনসেনসিবল পার্ট হল নিজেকে নিজের জায়গায় ঠিক রেখে অন্যকে বদলে দেয়া। হুম, আমি বলছিনা যে সবসময় আমাকে বদলাতে হবে। তবে যে জিনিসটা আমি অন্যের মধ্যে দেখতে চাই সেটাই কেন নিজের মধ্যে প্রথমেই আয়ত্বে আনার চেষ্টা করিনা?
ইথিক্যাল কথা যদি নিজের মধ্যেই ধারণ করা না গেল তাহলে ইথিকসের কথা না বলাই ভাল। তা না হলে সেটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় কোন একটা অন্যায় কাজ করছি, ক্রমাগত ভুল হচ্ছে। তারপর নিজেদের সেই অন্যায় থেকে নিউট্রাল করার জন্য বলছি “ আমি তো আমার অন্যায় বুঝতে পারছি, কিন্তু অন্যরা তো সেটাও পাচ্ছেনা”। এমন না যে অন্যায় কিংবা ভুল থেকে শুধরানোর চেষ্টা বরং অন্যায় কে নিজেদের ভিতর ধীরে ধীরে ডাইলিউট করা।

এখন আসি যে অন্যায় বুঝতে পারছে সে বেশি ক্ষতগ্রস্থ নাকি যে বুঝতে পারছেনা সে বেশি??

আমার ক্ষেত্রে যেটা হয় যে বেশিরভাগ সময় আমি বুঝতে পারি যে কেন আমার অমুক ভুল বা অন্যায় হল? আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছি তার ক্ষেতেও সেইম। কিন্তু সবশেষ একটাই সান্ত্বনা যে আমরা তো অন্যায় বুঝতে পেরেছি, অন্যরা কি তা পারছে? সুতরাং......
ব্রেইনের সম্মুখ বা ফ্রন্টাল লোবের সাথে অন্যান্য সব অংশের সংযোগ থাকে। ফ্রন্টাল লোব বেসিক্যালি মানুষের বিবেক বুদ্ধি, বিবেচনা, ভাল-মন্দ সেন্স, আবেগ-অনুভূতি, পারসোনালিটি, সামাজিক আচরন ইত্যাদি এসবের জন্য সিগন্যাল দেয়। তাই ভাল-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা জন্ম থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। যদি চুরি কিংবা মিথ্যা কথা বলি তাহলে ফ্রন্টাল লোব সাথে সাথে একটা নেগেটিভ সিগন্যাল দিবে। যদি সেই নেগেটিভ সিগন্যাল কে আমরা ওভারলুক করি তাহলে ফ্রন্টাল লোবের সাথে অন্যান্য অংশের কাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। নাহ! এটা কিছুদিন বা কয়েকমাসের জন্য না। ক্রমাগত দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রন্টাল লোবের নেগেটিভ সিগন্যাল যখন এভয়েড করা হয় তখন সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে যায় একদম অজান্তেই। যে মানুষটা যত বেশি জানে তার ফ্রন্টাল লোবের নেগেটিভ সিগন্যাল যদি বেশি বেশি এভয়েড করা হয় তাহলে ব্রেইনের অন্যান্য অংশের সাথে ভারসাম্য তার বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে আমরা যাকে সচরাচর ভাল মানুষ হিসেবে জানি দেখা যায় সেই এমন একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করে যা কোন সমীকরণেই মেলানো যায়না।
আমরা হয়ত বলে থাকি এরকম একজন ভাল মানুষ সে কিভাবে এই কাজটা করতে পারল যা কিনা একজন সাধারণ মানুষ থেকেও আশা করিনা?? লুক্কায়িত মেসেজ আসলে ফ্রন্টাল লোবের এই থিওরির মধ্যেই লুক্কায়িত।




খুব সুন্দর কিন্তু মারাত্বক বৈজ্ঞানিকভাবে কুরআনে সূরা আ’লাক্বে ১৫-১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

“সে কি জানে না , আল্লাহ দেখছেন ? কখনই নয় , যদি সে বিরত না হয় তাহলে আমি তার কপালের দিকে চুল ধরে তাকে টানবো , সেই কপালের চুল ( ওয়ালা ) যে মিথ্যুক ও কঠিন অপরাধকারী।”

তাই কোন কিছু না জেনে না মানার মধ্যে ক্ষতি যতটা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হল জেনে পালন না করা। তাই অন্তত আজকে একথা জানার পর থেকে ওই কথা বলার সুযোগ আর থাকলনা “আমি তো আমার অন্যায় বুঝতে পারছি, কিন্তু অন্যরা তো সেটাও পাচ্ছেনা”।

লেখার শেষ মুহূর্তে এসে মনে হল আমার লেখার মোরাল লেসন অনেকেই ভেবে বসতে পারেন, যে “যত কম জানা যায় ততই উত্তম”। কিন্তু আমি আসলে যতটুকু জানি ততটা মেনে চলার চেষ্টার তাগিদে এই এলোমেলো লেখাটা শেয়ার করলাম।

মনোরসায়নঃ এলোমেলো আলাপ-৫

জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় অপেক্ষায়। ভবিষ্যত অনিশ্চিত বলেই হয়ত অপেক্ষা করতে খুব একটা খারাপ লাগেনা। এইতো! সামান্য একটা গল্পের বই যখন পড়তে যাই, তখন পূর্বে থেকে গল্প জেনে গেলে সেই বই পড়তে আর ভাল লাগেনা। কি অদ্ভুত, অজানা জিনিস জানার জন্য যে প্রতীক্ষা তা খুব একটা খারাপ না।

মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রবিন্স এর সিক্সথ আর লেটেস্ট এইটথ এডিশান পড়তে গিয়ে মেজাজ চরম খারাপ হল। পুরাপুরি কন্ট্রোভার্সিয়াল সময় পার করতেছি। টিচাররা কেউ কোনদিন এইটথ এডিশান পড়ে নাই। আমরা নিউমার্কেটে সেভেন্থ এডিশান পাচ্ছিনা। অবশেষে আমি ২টা এডিশান নিয়ে পড়া শুরু করলাম। নতুন এডিশানের যে এরকম অভাবনীয় পরিবর্তন হতে পারে তা এবার রবিন্স প্রমাণ করে দিল। একদিক দিয়ে ভাল যে কোন হাইপোথিসিস, প্রস্তাবিত থিওরি, আননোন এটিওলোজি সব বাদ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র যেগুলো প্রমাণিত সেগুলোই রাখা হয়েছে।

ভাবছি বর্তমান লাইফেরও একটা নতুন এডিশান লাগবে। চলছে, চলুক- এভাবে আর কতদিন চলতে দেয়া যায়? কিন্তু সে ভাবনাতেও গুড়ে বালি। ব্যস্ততার মাঝে নিজের কাজের ফিল্টারিং করা ছাড়া নতুন করে এডিট করার মত কিছুই নাই। সুতরাং, ফিল্টারিং শুরু করলাম। প্রায়োরিটি ব্যাসিসে ফিল্টারিং হচ্ছে বর্তমান লাইফ। যা কিছু করছি, যা কিছু ভাবছি সবই ফিল্টারিং এর আওতাভুক্ত।
সুমাইয়ার সাথে লাইব্রেরিতে পড়ার ফাকে, এসব নিয়েই যখন আলোচনা করি তখন অবাক হয়ে ভাবি আসলে আমরা কতটা প্রফেশনাল হয়ে যাচ্ছি দিনের পর দিন। ঠিক প্রফেশনাল বললে ভুল হবে, ম্যাচিউরড হচ্ছি আমরা। এই ম্যাচিউরিটি গ্রো করার জন্য যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হল ডিপ্রেশান। হু! ডিপ্রেশান...
যখন খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করি , যখন চরম হতাশার মধ্যে থাকি তখনি কেবল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার জন্য নিউরন হাইপার একটিভ থাকে। কি করলাম, কি হল, কি হবে- এই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে মন।
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। তার মানে এই না যে নেগেটিভ জিনিস ওভার লুক করতে হবে। বরং নেগেটিভ জিনিস থেকে পজিটিভিটি বের করে আনতে হবে। এই যে ডিপ্রেশান, মারাত্বক একটা মেন্টাল ডিজঅর্ডার কিন্তু এই সিচুয়েশান থেকে পজিটিভিটি বের করে আনতে পারলে মারাত্বক পজিটিভ আউটপুট পাওয়া সম্ভব যা ম্যাচিউরড হবার জন্য খুবই উপকারি। সুতরাং, বার বার নিজেকে বলি, বি পজিটিভ এবং থিঙ্ক পজিটিভ...

পৃথিবীতে কোন সিদ্ধান্ত ১০০% বেনিফিটের উপর নির্ভর করে হয়না। সেখানে অবশ্যই একটা অনুপাত থাকে। হতে পারে ৫০: ৫০ অথবা ৫১: ৪৯। কিন্তু এই অনুপাত থেকেই সিদ্ধান্তে পৌছতে হয়। যদি কোন কাজের বেনিফিট ৫১% হয় তবে বাকি ৪৯% ক্ষতির জন্য সেই কাজ বাদ দেয়া বোকামি ছাড়া কিছুই না। ধরে নিতে হবে সেই ৪৯% কোল্যাটারাল ড্যামেজ। এটা যেকোন কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং কনফিডেন্ট হতে হবে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে। আবেগকে অস্বীকারের কোন উপায় নেই। কিন্তু সেটাকে নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকাও কোন সিদ্ধান্ত হতে পারেনা। তাই আবগকে সাথে নিয়েই কনফিডেন্ট হতে হবে।

প্রতিটা কাজ স্ক্যানিং করতে হবে। ভুল হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভুল না করলে পরে যে আমি সঠিকটাও করতে পারবনা! তাই ভুলের স্বীকার কাউকে কখনও ছোট করেনা, বরং বড় হবার প্রথম ধাপই হল ভুল করে নতুন কিছু শেখা। তাই আরো বেশি প্র্যক্টিক্যাল হতে হবে।

স্বাধীনতা প্রতিটা মানুষের জন্মগত অধিকার। স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও জীবন পরিচালনার জন্যই মায়ের অন্ধকার নিরাপদ প্রকোষ্ঠ হতে এককেটা জীবনের আবির্ভাব ঘটে এই পৃথিবীতে। একজন মানুষকে চেইঞ্জ করার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হল তার চিন্তা ভাবনার জগতে আলোড়ন তৈরি করা। কিন্তু সেজন্য তো আগে নিজের চিন্তা ভাবনার জগতে নিজেকে আলোড়িত করতে হবে। খুব ভালভাবেই খেয়াল করছি, কোন কিছু যখনি আমার চিন্তা ভাবনার জগতকে রুদ্ধ করে দিতে চায় সেটা যত ভালই হোকনা কেন সেখানে আমি একেবারেই বেমানান হয়ে যাই। আমরা অন্যদের বদলে দিতে চাই কিন্তু নিজেদেরকে চিন্তা ভাবনায় প্রতিবন্ধী করে রাখতে চাই। এই এটিচিউড পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে।

আর চরিত্র! সেটা তো সবকিছুর মূলে। মোরালিটি হল সেই জিনিস যা বিশ্বাস ও কাজে একই রকম। একজন ওয়েস্টার্নও অনেক মোরাল হতে পারে আবার একজন ইষ্টার্নও অনেক ডিমোরাল হতে পারে। কিভাবে? ধরেন কেউ বিশ্বাস করে খোদা বলে কেউ নেই, সুতরাং যা করতে হবে তা নিজের যোগ্যতা দিয়েই করতে হবে এবং সেটা সে তাই করে। সে সাকসেসফুল হবে। সে মোরাল, কারণ সে তার বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে কোন কনফ্লিকশান রাখেনাই।
আবার একজন আস্তিক তার বিশ্বাস আছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কিন্তু সে সুযোগ পেলেই অন্যায় করে, ক্ষতিকর কাজ করে, আর সফলতার জন্য ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। সে ডিমোরাল, কারণ তার বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে।
সম্ভবত আমরা বাহ্যিকভাবে সবাই মোরাল কিন্তু বেসিক্যালি ডিমোরাল। তা না হলে চরিত্র যেখানে আমাদের মূলসম্পদ সেখানে চরিত্রের আলো সবক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে হবে। তা না করে আমরা সেই চরিত্র বিনাশের ভয়ে নিজেরাই ভীত সন্ত্রস্ত। তাহলে কিভাবে অন্যদের আমরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি?
হুম, তাই আমি যাই হইনা কেন, আমাকে সত্যিকার ভাবে মোরাল হতে হবে। আমার বিশ্বাস ও কাজের মিলন ঘটাতে হবে।
উমম!! লাইফের নতুন এডিটিং এর কাজ চলছে এভাবেই......এখন কেবল প্রতীক্ষা। তবে সেই প্রতীক্ষা খুব একটা খারাপ না!!

হোস্টেল লাইফ-৫

হলে উঠার পর প্রথম যে ব্যাপারে আমি আর তনিমা উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেটা হল হলের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রতিদিন হল পরিষ্কার করার জন্য একজন বুয়া আসে কিন্তু তারপরও বাথরুম খুব নোংরাই থাকত। কারণ টা ছিল মেয়েরা খুব অসচেতন। দেখা যাচ্ছে শ্যাম্পুর প্যাকেট, প্যাড, বিভিন্ন কাগজ বাথরুমে পড়ে থাকে। এরপর দোতলায় যে পানির ফিল্টার আছে, দেখা যায় সেই ফিল্টার থেকে অনেকেই গ্লাস, বাটি এসব ওয়াস করছে এবং আল্টিমেইটলি পুরা জায়গাটা নোংরা করে রাখতে একটুও দ্বিধা করছেনা। খুব দৃষ্টি কটু হলেও সবাই সেটার সাথে মানিয়ে নিচ্ছে।
একদিন আমি আর তনিমা এব্যাপারে সিনিয়র এক আপু ও আমাদের কিছু ব্যাচমেটের সাথে কথা বললাম। সবাই এব্যাপারে বিরক্ত, কিন্তু কেউ কোন উদ্যোগ নিবেনা এটার বিরুদ্ধে। সুতরাং আমরাই উদ্যোগটা নিলাম। অনেকগুলো কাগজে কতগুলো রুলস এবং রেগুলেশান মানার জন্য সবাইকে নির্দেশনা দিয়ে হলের সবজায়গায় লাগিয়ে দিলাম। অস্বাভাবিক পজিটিভ রেসপন্স পেলাম। দেখলাম পরেরদিন থেকেই সবাই সেই রুলস মেনে পরিবেশ পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে সহায়তা করছে। এটা ছিল আমাদের উদ্যোগের খুব সামান্য একটা দিক, কিন্তু এই সামান্য দিক থেকে বুঝতে পারলাম যে আপামর জনসাধারণ উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকবে, তবু নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করবেনা

এরপর হলের রুমে দেখা যায় যখন তখন একেকটা ফ্রেন্ড সার্কেল খুব জোরে জোরে হাসাহাসি, ঠাট্টা, ফাযলামি করছে, অন্যদিকে কেউ ঘুমাচ্ছে। একদিন একজন খুব বিরক্ত হয়ে এব্যাপারে আমার সাথে কথা বলছিল, অনেকটা অভিযোগের সুরে যে কেন তারা ঘুমানোর সময় এরকম হাসাহাসি করে। আমি আর তনিমা সাথে সাথেই বললাম তাহলে তোমরা সাথে সাথে কেন সেটা নোটিফাই করে দাওনা তাদের? কিন্তু অন্যরা কি মনে করবে, এতজনের একটা ফ্রেন্ড সার্কেলের বিরুদ্ধে সে এটা নিয়ে কথা বলবে কেমন দেখায়? বুঝলাম স্বকীয়তা জ্ঞান অধিকাংশ মেয়ের মধ্যে নাই। অনেকেই অনেক ব্যাপারে চরমভাবে সাফার করছে, কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছেনা। অনেকটা সাইলেন্ট ডিক্টেটরশীপ চলছে কোথায় যেন! সুতরাং একদিন আমি এবং তনিমা অনেক গল্পোচ্ছলে এব্যাপারে অন্য সবার সাথে আলোচনা করে এ ডিসিসানে পৌছলাম যে দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে জোরে জোরে হাসাহাসি, ঠাট্টা, ফাযলামি করা যাবেনা। আমাদের ওই উদ্যোগটাও সেদিন মারাত্বকভাবে কাজে লেগেছিল।
এরপর আরেকদিন সার্জারি ওয়ার্ডে যাব বলে সন্ধ্যার দিকে হল থেকে বের হলাম কয়েকজন একসাথে। জরুরি বিভাগের সামনে দিয়ে যেতেই দেখি একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা খুব ইমার্জেন্সি কন্ডিশানে আছে। কিন্তু কেউ তার ধারে কাছেও ঘেষছেনা, তার সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছেনা। আমরা সেদিন সাথে সাথে সেই মহিলাকে গাইনি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কোন বেড খালি নাই, বলে ফেরত দেয়া হল। রোগীর অবস্থা এমন ছিলনা যে তাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাব। সুতরাং তনিমা আর আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলামনা, বাকিরা আমরা কি করি সেই আশায় আছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই মহিলার চিকিৎসা এই হাসপাতালেই করতে হবে যেভাবেই হোক। সুতরাং অনারারি একজন চিকিৎসক ছিলেন তাকে ব্যাপারটা খুলে বলার পর তিনি রাজি হলেন এই শর্তে যে আমরা যদি মহিলাটার কোন ক্ষতির দায়িত্ব নিতে পারি তাহলে তিনি লেবার রুমে ঢুকাবেন। আমরা কোন কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলাম।

পরবর্তিতে সেই মহিলার ডেলিভারিতে প্রচুর সময় লাগল, এবং একটা সময় পরিস্থিতি এতই খারাপ হল যে গাইনি ডিপার্টমেন্টাল হেড ছাড়া সেই কেইস কেউ আর ডিল করতে পারছেনা। রাত তখন ৯টা বাজে। হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি এম্বুলেন্সে করে মিরপুর গিয়ে সেই হেড ম্যাডাম কে নিয়ে আসা হল, এরমধ্যে আমাদের এক ফ্রেন্ড রক্তের জন্য সন্ধানিতে চলে গেল। সবমিলিয়ে যখন রাত দশটা বাজে তখন লেবার রুমে সব চিকিৎসকরা ঢুকলেন আবার। ততক্ষনে মহিলার অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। যাইহোক এরপর বাচ্চা ডেলিভারি হল, কিন্তু শিশু বিভাগে তখন স্পেশালিস্ট ছিলনা তাই সেই মুহূর্তে বাচ্চাকে নিয়ে আমি, তনিমা আর একজন ফ্রেন্ড চলে গেলাম সিএনজি তে করে মিরপুর শিশু হাসপাতালে। সেখান থেকে আমাদের হাসপাতালে যখন ফিরলাম তখন রাত বারটা বাজে।
জানিনা সেদিন অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজ হঠাৎ ঝোকের মাথায় করেছিলাম, শুধু এই চিন্তা করে যে আমাদের এটা করতে হবে, করা উচিত। বাকিটা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছুইনা, কারণ সেদিনের পর গাইনি চিকিৎসকরা আমাদের ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন এরকম ঝুকিপূর্ণ কাজে আমাদের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এরকম কেইসে ভিন্ন ঘটনাও ঘটে যেতে পারত, নানা ধরনের ঝামেলাতেও আমরা জড়িয়ে পড়তে পারতাম।
রাত সাড়ে বারটায় বাচ্চার বাবা যখন হাসপাতালে আসলেন তখন প্রথমেই বাচ্চার খালাকে জিজ্ঞাসা করলেন ছেলে হয়েছে না মেয়ে হয়েছে? আমি সামনে ছিলাম, খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওই প্রশ্ন শুনে। এতক্ষন কোন খবর ছিলনা, এখন আসছে ছেলে না মেয়ে এই খবর নিতে! মেজাজ সামলে সেই লোকটাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম।

এই হচ্ছে আমাদের সার্বিক পরিবেশের কিছু খন্ডিত চিত্র। যেখানে ভাল কাজে কেউ উদ্যোগ নেয়না, ঝুকিপূর্ণ কাজ বলে সামনে কেউ এগোতে চায়না। তবে সবার উদ্যোগে অনেক ঝুকিপূর্ণ বড় কাজও নিমেষেই করে ফেলা সম্ভব সেটা হলে থেকে প্রথমবারের মত প্র্যাক্টিক্যালি অনুভব করলাম।

( আপাতত চালানোর আর ইচ্ছা নাই...)

হোস্টেল লাইফ-৪

বন্ধুত্বের প্রকৃত সংগা আসলে কি? এই বন্ধুত্ব নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি কনফিউশানে ছিলাম। মেডিকেলে দেখতাম একঝাক গ্রুপ ফ্রেন্ড নিয়ে একেকটা ফ্রেন্ডশীপ গড়ে উঠে। একেকটা গ্রুপে ৩জন থেকে শুরু করে ১০জন পর্যন্ত থাকে। ইন্টারমিডিয়েটে থাকতে আমাদের ৭জনের একটা গ্রুপ সার্কেল ছিল। সেটা কেবলই বন্ধুত্ব ব্যতিত আর কিছু না। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স তিনগ্রুপের মিলে মোট সাতজন। জমজমাট ছিল আমাদের ওই বন্ধুত্ব। এখন আমরা সেই সাত জন সাত জায়গায়। ভাবতেই কষ্ট লাগে।

যাইহোক মেডিকেলেও চারপাশে একেকটা গ্রুপ সার্কেল তৈরি হতে লাগল। আমারও একটা সার্কেল তৈরি হল ৫জন মিলে। কিন্তু কয়েক মাসের ভিতরে সেই সার্কেলে ২জন বের হয়ে গেল, বাকি রইলাম তিনজন। খুব তুচ্ছ এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ছাড়াছাড়ির ঘটনা। আমি কিছুটা শকড। কিন্তু সেবারই বুঝতে পারলাম যে আমি অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করি যেটা অন্যরা করতে পারছেনা।
এরপর তিনজন মিলেই একসাথে হলে উঠা। সাবরিনা যদিও হলে রেগুলার আমাদের সাথে থাকতনা, কিন্তু আমি আর তনিমা রেগুলার থাকতাম। হুম, মেডিকেলে প্রথম আমার যে ঘনিষ্ঠ হয় সে হচ্ছে তনিমা। খুব স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড মেয়ে সে। ওর এই গুনটাই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত। কিন্তু মাঝে মাঝে ওর এই গুণের মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ অন্য সবার জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে যেত। আমিও চরম স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড মেয়ে, কিন্তু ওর কাছে আমার এই গুন কিছুইনা। কারণ আমি পরিবেশ বুঝে ব্যালান্সড আচরন করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ও কোন কিছুকেই কেয়ার করতনা। সুতরাং হলে উঠে অন্য সবার সাথে প্রথমেই তনিমার কিছুটা বিবাদ শুরু হতে লাগল। আমি সবসময় ব্যাপারটা ডাইলিউট করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হতনা। খুব একরোখা ও জেদি টাইপ ছিল তনিমা।
একদিন হলে সিনিয়র এক আপুর সাথে ওর তুমুল আকারে ঝগড়া বেধে গেল। কারণ টা খুব নগন্য। আসলে সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশানে অলিখিত কিছু শর্ত থাকে, তনিমা সেই শর্ত মানতনা বলেই ঝগড়ার সূত্রপাত। আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম সবক্ষেত্রে এক্সট্রিম আচরন করা ঠিক না। কিন্তু এতে তনিমা আমাকে ভুল বুঝে।এরপর মেইন যে কারণে তনিমার সাথে আমার বন্ধুত্ব টিকেনি সেটা নিছক কোন ঝগড়া নয়।
বন্ধুত্বের সংগাতে ফিরে যাই। হলে আমার রুমে ছয়জনের এক সার্কেল আছে। খুব এক্সপ্রেসিভ তারা, ডমিনেটিংও বটে। নিচতলার রুমেও তিনজনের এক সুন্দর ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। এছাড়াও আরো অনেক ফ্রেন্ড সার্কেল ক্যাম্পাসে ছিল,কিন্তু যেহেতু তারা হলে ছিলনা তাই ওদেরটা বিস্তারিত বলবনা।
ছয়জনের ফ্রেন্ডশীপ খুব জটিল ছিল। কিন্তু দেখতাম একজন কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ করে অথবা ভুল পথে যায় অন্যরা কেউ সেটাকে বাধা দেয়না। বরং জেনেশুনে তারা নিজেদের কাছের বন্ধুকে ভুল পথে যেতে সহায়তা করে। এধরনের বন্ধুত্ব আমাকে এবং তনিমাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। একদিন নয় বহুদিন আমি,তনিমা এবং সাবরিনা বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। সারারাত হলের বারান্দায় রাত জেগে এসব নিয়ে অনেক গল্প করেছি। আলোচনার টপিকস ছিল সত্যিকার বন্ধুত্ব আসলে কি?
সবাই আমরা একমত হয়েছিলাম সত্যিকার বন্ধু আসলে সে, যে অপর বন্ধুর দর্পন স্বরূপ। অর্থাৎ দর্পনে যেমন সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায় বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও তাই। আমি যদি অপরাধ, অন্যায়, ভুল করি অন্যজন দর্পনস্বরূপ সেটা দেখিয়ে দিবে, এটাই স্বাভাবিক।
ক্যাম্পাসে তখন হঠাৎ করেই হিন্দু-মুসলিম এফেয়ারের ঘটনা বেড়ে গেল। নিচতলার সেই তিন ফ্রেন্ডের একজন এর মধ্যে ছিল। আমরা এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা করলাম, কিন্তু ওদের ফ্রেন্ডশীপ আসলে কি ছিল জানিনা, তাদের এটা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। এরপর সেই ছয় ফ্রেন্ডের মধ্যেও এরকম কেইস ঘটে গেল, কিন্তু বাকি ফ্রেন্ড তাদের এটা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। বরং যে জিনিস দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম সেটা হল তারা অবলীলায় একটা অন্যায়কে ঢাকতে বন্ধুর জন্য গার্ডিয়ানের কাছে মিথ্যা বলল। যেখানে হবার কথা ছিল এক বন্ধু অন্যের অন্যায়কে শুধরে দিবে সেখানে জাস্ট উলটা হল। একজন অন্যজনের অন্যায় কাজে সহায়তা করল।
আমি জানিনা বন্ধুত্ব কি নিছক আড্ডা মারা, গল্প করা, লাইফ এনজয় করা? নাকি একটা আইডিওলজিক্যাল প্ল্যাটফর্মে সবার একাত্বতা ঘোষণা করা। এই প্ল্যাটফর্মে একজন অপরের দর্পন। অন্তত আমার,তনিমা আর সাবরিনার কাছে ব্যাপারটা এরকমই ছিল।
কিন্তু তনিমার সাথে বন্ধুত্বের এক বছর পরেই আমি ধীরে ধীরে টের পেলাম তনিমা একটা বড় অন্যায় করতে যাচ্ছে যেটা তার জন্য চরম ভুল সিদ্ধান্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি ওকে ওর ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করে দিলাম। ভাল লেগেছিল যে তনিমা সেদিন স্বীকার করেছিল যে সে আসলেই ভুল করতে যাচ্ছিল এবং আমাকে সে ভুল বুঝেনি। কিন্তু আবেগিক ভালবাসার কাছে তনিমার প্রখর যুক্তিবোধ হার মেনেছিল। তাই সে নিজেকে ভুলের স্রোত থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি, নিজেই ভেসে চলে গেছে ভুলের সাগরে।
তনিমার সাথে বন্ধুত্বের গভীরতা সেদিন থেকে ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। কারণ হলে তনিমা বেশি থাকতনা, ওর তখন লাইব্রেরিতে পড়ার আগ্রহ বেশি। একদিন তনিমার বাসা থেকে ওর মা ফোন করে আমার কাছে তনিমার ব্যাপারে জানতে চাইল। আমি মিথ্যা বলতে পারিনি কিছুই। আমি চেয়েছিলাম তনিমা ভুল থেকে ফিরে আসুক যেমন তনিমার মা চায়। কিন্তু সেদিন থেকেই তনিমা আমাকে ভুল বুঝা শুরু করল। কেন জানিনা আমিও তনিমার ভুল ভাঙ্গাতে চাইনি আর। কারন আমাদের ফ্রেন্ডশীপের কমন প্ল্যাটফর্ম ততদিনে ভেঙ্গে গেছে। সাবরিনা এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার কোন মানে নেই। কারণ আমাদের বন্ধুত্ব নিছক লাইফ এনজয় করার জন্য ছিলনা। ইনফ্যাক্ট তনিমাও বুঝে গিয়েছিল যে আমার সাথে ওর ফ্রেন্ডশীপ আর থাকবেনা, কারণ আমরা দুজনই দুজনকে ভালভাবে চিনতাম ও বুঝতাম।

অতঃপর কেবল আমি আর সাবরিনা। সাবরিনা হলে থাকতনা। যদিও খুব খারাপ লেগেছিল তারপরও তনিমার সাথে আমার আর সেভাবে বন্ধুত্ব আর রক্ষা করা গেলনা। আসলে আমি চেয়েছিলাম সবসময় ওর পাশে থাকতে কিন্তু তনিমা নিজেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল, আমি কাছে যাবার প্রেরণা হারিয়ে ফেললাম।
তনিমার সাথে বন্ধুত্ব টিকেছিল ২বছর। এরপর সুমাইয়া, যাকে আমি সবচেয়ে খারাপ মেয়ে বলেই জানতাম। হলে থাকার সুবাদেই আমি বন্ধুত্বের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলাম, নিজেকে চিনতে পেরেছিলাম। অন্যায়কে মেনে নেবার মত কিংবা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার মত বন্ধু আমি হতে পারিনি, এই ব্যাপারটা আমার নিজের কাছে কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরল। এরপর তনিমা ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্বের আসল সংগাতে কেউ এক হতে পারিনি বলেই বন্ধুত্বটা সবসময় সুপারফিশিয়াল থেকে গেছে। কারণ বর্তমান বন্ধুত্ব কেবল নিছক শাব্দিক বন্ধুত্ব শব্দে বন্দী। কেউ কারো দর্পন না এখানে। তাই অবলীলায় এক বন্ধুকে অন্য বন্ধু অন্যায় কাজে সহায়তা করতে পারে।
সুমাইয়ার সাথে একদিন এরকম আলোচনা করছিলাম তনিমাকে নিয়ে। হলে তখন তনিমা ছিলনা। সুমাইয়া আমাকে তনিমার ব্যাপারে প্রশ্ন করাতেই আলোচনার সূত্রপাত। তনিমার সাথে আমার বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের কারণ সুমাইয়া খুব ভালভাবেই বুঝতে পারল। শুধু যে বুঝতে পারল তাই নয়, সুমাইয়া আমাকে সেদিন শান্ত্বনা দিল যে একমাত্র সত্যিকার বন্ধু মাত্রই এরকম অনুভব করতে পারে যেরকম আমি তনিমার জন্য করতাম। হুম, সুমাইয়ার সাথে বন্ধুত্বের শুরু আমার সেদিন থেকেই হল...

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

হোস্টেল লাইফ-৩

বাসার বাইরে হলের জীবনে প্রথম যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা হল নিজের কাজ নিজেই করা। যদিও আমি খুব প্র্যাক্টিক্যাল মেয়ে তবুও বাসায় থাকাকালীন আমার সাধারণত কোন কাজে হাত দেয়া লাগেনি। কিন্তু হলে গিয়ে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছানো, কাপড়-চোপড় ধোয়া, সময়মত খাওয়া-দাওয়া এসব খুব সুন্দর নিয়মিত হয়ে গেল আমার জন্য। ইনফ্যাক্ট আমি যে এরকম সুন্দর গোছানো লাইফ কন্টিনিউ করতে পারি তা আমার কাছে প্রথম প্রকাশিত হল সেখানে গিয়ে।
এই গোছানো লাইফ বাদেও আর যে ব্যাপার আমার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হল বিভিন্ন মানুষের সাথে একত্রে বসবাসের অভিজ্ঞতা। এমএমসি থেকে ঢাকায় আসা পর আমি তখন অনেক রিলাক্স। যদিও হলে থাকি তবুও শান্ত্বনা এই যে, যেকোন মুহূর্তে বাসায় যেতে পারি। আসলে আমার মধ্যে যে হোম সিকনেস আছে সেটা আমি হলে যাবার পূর্বে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। ভাবতাম হলের জীবন না জানি কত মধুর!
যাইহোক সুমাইয়ার সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ প্রথম থেকে ছিলনা,যদিও পরবর্তিতে মেডিকেলে লাইফে ওই আমার সবচেয়ে কাছের একজন হয়ে উঠে।
সুমাইয়া আমার ব্যাচেও ছিলনা, ওর রোল প্রথমদিকে আর আমার শেষের দিকে। এমনকি ও আমার রুমমেটও না। পাশের রুমে থাকত সে। তবে মেডিকেলে প্রথম যাকে নিয়ে আমার খুব কৌতুহল হয় সে হল সুমাইয়া। কারণ ক্যাম্পাসে তখন সে টক অব দ্যা টাইম। অসাধারন সুন্দরী, স্মার্ট। যেকোন ছেলেই একবার দেখলে ২য়বার তাকাতে ভুল করবেনা। সুতরাং ক্যম্পাসের সব ছেলেরাই মোটামুটি তাকে একবার করে হলেও ট্রাই করেছে। ওর নামে অনেক অনেক গুজব তখন ক্যাম্পাসে চলছিল। যেহেতু ও আমার ব্যাচে ছিলনা তাই ওর খুব কাছাকাছি মেশার সুযোগ আমার হয়নি তখন। তবে মাঝে মাঝে ওর সাথে বাসে দেখা হত। হাই,হ্যালো টাইপ কথা দিয়েই শেষ হত আমাদের পরিচয়।
সুমাইয়া সম্পর্কে প্রথম কাছাকাছি মেশার সুযোগ হয় হলে উঠে। ও আমার পাশের রুমেই থাকত। সুমাইয়ার সবচেয়ে যে জিনিস আমার ভাল লাগত সেটা হল ওর ডিসেন্ট চলাফেরা। খুব স্মার্ট ছিল কিন্তু সেই স্মার্টনেসের মধ্যে কখনও উগ্রতা ছিলনা। আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম হলে যখন দেখলাম সুমাইয়া নামাজ পড়ে, বিশেষ করে ফজরের নামাজ। এতদিন ধারণা ছিল নামাজ পড়া তো দূরের কথা নামাজ পড়তে পারে কিনা সেটাই সন্দেহ। মানুষ সম্পর্কে প্রথম অনুমান ভিত্তিক ধাক্কা খেলাম আমি সেদিন। ধাক্কাটা আরো অনেক কারণেই জোরাল ছিল।
ক্লাস শেষে রিডিং রুম বা লাইব্রেরিতে আমার সেরকম করে কখনও পড়া হয়নি। দুইটা কারণ ছিল। প্রথমত; রিডিং রুম/লাইব্রেরির কড়া এসি থেকে বাইরে বের হলে আমার খুব অসুবিধা হত। ২য়ত; সেখানে বেশিরভাগ সময় বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড রা একসাথে পড়াশুনা করত। সুতরাং হলে বসেই আমি পড়াশুনা করতে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করতাম। হলেই আমি লক্ষ্য করলাম একমাত্র সুমাইয়াও আমার মত হলেই পড়াশুনা করে। সেই সুবাদেই ওর সাথে একটু একটু করে কাছে আসা। আমাদের ফ্রেন্ডশীপ এভাবে ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগল।
অত্যধিক সুন্দরী মেয়েরা নাকি পড়াশুনায় ভাল হয়না, সুমাইয়াকে দেখে সেই ধারণাও ভুল প্রমাণিত হল। ওর নামে এতদিন ক্যাম্পাসে যত গুজব শুনে এসেছি তখন সুযোগ হল সেই গুজবগুলো একটু একটু করে যাচাই করার। ততদিনে আমি আমার রুম চেইঞ্জ করে ফেলি। সুমাইয়া আর আমি একই রুম ও বেড পার্টনার। পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া, গল্প সবকিছুই ওর সাথে। ক্রমেই ও আমার রিডিং পার্টনার হয়ে উঠল। এবং বুঝতে পারলাম একজন মানুষ সম্পর্কে বাইরে থেকে অনুমানভিত্তিক যেসব ধারণা আমি করে থাকি তার ৮০% ভুল। সুমাইয়া সাধারণ অন্য মেয়েগুলোর চেয়ে একটু বেশি সাধারণ। বাইরের চাকচিক্যময়তার প্রতি আমার যেমন কোন আকর্ষন নেই, ওরও নেই। দেখতাম হলে মেয়েরা বিকেল হলেই খুব সেজে গুজে বয়ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে বের হয়। অথচ সুমাইয়াকে আমি কখনও আয়না দেখে চুল পর্যন্ত আচড়াতে দেখিনি। ওকেই আমি প্রথম মন্তব্য করি যে তুই আমার থেকেও অনেক বেশি সিম্পল। খুব বন্ধুবৎসল, সামাজিক, অমায়িক সুমাইয়াকে আমার বেশি ভাল লাগতে শুরু করল, কারণ একমাত্র কলেজেই আমি প্রথম যার ব্যাপারে নেগেটিভ মন্তব্য শুনি সে ছিল সুমাইয়া।
এটা ছিল আমার নেগেটিভ ধারণার পজিটিভ দিক। ঠিক উলটা অভিজ্ঞতাও আমাকে দারুনভাবে প্রভাবিত করল। সুমাইয়ার মতই...

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

হোস্টেল লাইফ-২

এমএমসি তে যখন প্রথম ভর্তি হলাম তখনই জীবনের প্রথম বাসার বাইরে হলে থাকার সুযোগ পেলাম। আমার যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সারাজীবন আমি কোনদিন মা কে ছাড়া কোথাও থাকিনি। মেডিকেলে পড়তে গিয়ে প্রথম কোথাও একা থাকব, এই স্বাধীনতা আমাকে অন্যরকম আনন্দ দিয়েছিল। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই স্বাধীনতার স্বরূপ বুঝতে পারলাম। প্রথম যেদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যখন গেলাম দুই মিনিট লেইট। দুই মিনিট কোন ব্যাপার না, কিন্তু সেই দুই মিনিটের জন্য স্যার লেকচার গ্যালারিতে ঢুকতে দিলেননা। শুধু আমাকে নয়, এরকম আরো ১০-১২ জনকে। মনটা প্রথমদিনই মেডিকেলের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেল। এরপরের ক্লাসে ঢুকলাম। সেখানে স্যার যে কি পড়ায়লো আমি তার আগা-মাথা কিছুই বুঝলামনা। সারাটাদিন এভাবেই গেল। রুমে ফিরে এলাম খুব বিষণ্ণ মন নিয়ে।
এরপর রুমে গিয়ে একটা অসহ্য যন্ত্রনার মধ্যে দিন কাটালাম। আসলে বুঝতে পেরেছিলাম স্বাধীনতা তখনই দরকার হয় যখন স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে হয়। কিন্তু এমএমসি হলে আমার স্বাধীনভাবে করার মত কিছু ছিলনা। শুধু পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া আর ক্লাসে যাবার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। সুতরাং কখন ঢাকায় যাব, এই চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন থাকতাম বেশিরভাগ সময়। কিন্তু খুব অবাক হয়েছিলাম, আমাদের দোতলা হলে যারা ছিল তারা সবাই খুব উৎফুল্ল এবং হাসি-খুশি মেজাজে ছিল। কেউ আমার মত বিষণ্ণ ছিলনা। আমার যে রুমমেট সে আমাকে অনেক মোটিভেট করার চেষ্টা করত। কিন্তু একদম অপরিচিত পরিবেশে, কোন বান্ধবি ছাড়া আমার একদম ভাল লাগছিলনা। আমার রুমমেট সে সারাদিনই তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে মোবাইলে গল্প করে কাটাত। কখন ক্লাসে, কখন গোসল, কখন খাওয়া-দাওয়া, এসব আজাইরা নিউজ আপডেট দিতে দিতেই তার সময় কেটে যেত। তাই সে খুব ভালভাবেই হল লাইফ কাটাচ্ছিল।
পাশের রুমের শিমু নামের এক মেয়ে ছিল। কেন জানিনা ওকে আমার খুব ভাল লেগে যায়। অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলত। ওর সাথে গল্প করে এক সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম। ভাবলাম ওর সাথে ভাল একটা ফ্রেন্ডশীপ হলে হয়ত আমিও অন্য সবার মতই হলে লাইফ এনজয় করতে পারব। কিন্তু পরদিনই সেই শিমুকে আর পেলামনা। সে তখন তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাইরে ঘুরতে গিয়েছে। আমি তখন একটা শক খেলাম। কারণ একজনকেও আমি পেলামনা যার বয়ফ্রেন্ড নাই। সবাই কি কারনে এত মজার মধ্যে আছে, ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগলনা। কারণ সবাই এখন স্বাধীনভাবে তাদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে পারে, বাসা থেকে জানাজানির ঝামেলা নাই।
যাইহোক এভাবেই একসপ্তাহ কেটে গেল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলামনা, বুধবার ঢাকায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে মন মেজাজ খুব খারাপ। আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলতেও ভাল লাগছিলনা। এমন একটা ভাব যে মেডিকেলের হলে তারা আমাকে জোর করে পাঠায়ছে। অথচ আমিই কিন্তু হলে থাকার জন্য প্রথম থেকে চরম উত্তেজনায় ছিলাম।
শনিবার ভোরে চলে গেলাম এমএমসি। সেদিনই জানতে পারলাম এমএমসি থেকে মাইগ্রেশান হয়ে গেছে, আমি এখন ঢাকায় এসএইচএসএমসি তে পড়তে পারব। আমি জানিনা, জীবনের যদি কোন ভাল নিউজ পেয়ে থাকি তাহলে সেটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভাল নিউজ। শনিবার দিন হলে গিয়েই আমি সব গুছিয়ে ফেললাম। রবিবার আম্মু-ভাইয়ারা গিয়ে আমাকে নিয়ে আসল।
এই ছিল আমার লাইফের প্রথম হলে থাকা।

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

হোস্টেল লাইফ-১

গ্রুপ স্টাডি মেডিকেল লাইফে খুব সাধারণ একটি ঘটনা। মেডিকেলের পড়াশুনা যত কঠিনই হোকনা কেন এই গ্রুপ স্টাডি পড়াশুনার জন্য অন্যরকম খোরাক যোগায়। সামনে পরীক্ষা, অবশ্য পরীক্ষা সর্বদা সামনেই থাকে! আমি আর আমার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবি সুমাইয়া প্ল্যান করছিলাম কবে থেকে হলে থাকব। বিশাল এক পড়াশুনার প্ল্যান নিয়ে হলে উঠব এরকমই চিন্তা আমাদের। আগে থেকে বলে রাখি আমি কোনদিনও রুটিন মাফিক পড়াশুনা করতে পারিনি। যতবারই পড়াশুনার জন্য প্ল্যান করেছি সব ভেস্তে গেছে নিমেষেই। তাই নিজের উপর বিশ্বাস নেই। সুমাইয়াকে বললাম, তুই প্ল্যান কর। সুমাইয়া খুব কনফিডেন্ট একটি মেয়ে। সে সুন্দর একটি প্ল্যান করে ফেলল। যেদিন আমরা হলে উঠব তার দুইদিন আগে শারমিন সুমাইয়াকে বলে রাখল যে সে আমাদের সাথে পড়বে। খুব ভাল কথা, তিনজন একসাথে পড়ব।
প্ল্যান অনুযায়ী হলে উঠে গেলাম দ্রুত। বিকেল চারটা থেকে সবাই পড়া শুরু করব। ঘুমকাতুরে আমি ঘুম থেকে উঠলাম বিকেল সাড়ে চারটায়। ফ্রেশ হয়ে পড়াশুনা স্টার্ট করতে করতে পাচটা বেজে গেল। প্ল্যান থেকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে গেলাম অলরেডি। যাইহোক বাকি দুজনের গোসল, খাওয়া-দাওয়া,প্রিপারেশান নিতে নিতেই আমার মত পাঁচটা বাজল।
প্যাথলোজি মেইন টেক্সট বই, সাথে তিনটা গাইড, পেন্সিল, পেন, মার্কার নিয়ে তিনজন একসাথে বসে গেলাম। উল্লেখ্য আমাদের তিনজনের বৈশিষ্ট্য পুরাই ভিন্ন। যেমন আমি, যখন পড়তে বসি তখন পড়া বাদ দিয়ে অন্য গল্প করলে খুব বিরক্ত হই। সুতরাং যখনি দেখি তিনজন গল্পে মেতে উঠছি তখনি আমি তাগাদা দেই মেইন বইয়ে মনোযোগ দেবার জন্য। সুমাইয়া, তার বৈশিষ্ট্য হল কিছুক্ষন পর পর চ্যাপ্টার শেষ হতে আর কত পৃষ্ঠা বাকি সেটা কাউন্ট করা। পড়াশুনার ফ্রিকোয়েন্সি যত বাড়তে থাকে তার এই পৃষ্ঠা গুনার ফ্রিকোয়েন্সিও বাড়তে থাকে। আর শারমিন, ওর খুব ইউনিক বৈশিষ্ট্য। পড়তে পড়তে হঠাৎ করে তার মার্কার খুজে পাচ্ছেনা, এই মার্কারের জন্য আধা ঘণ্টা ব্যয় করবে তবুও পড়বেনা।
যাইহোক, আমরা তিনজন খুব ডিটারমাইন্ড, হেপাটোবিলিয়ারি সিস্টেম পড়ে শেষ করতেই হবে। কারণ পরের দিন আইটেম আছে। আইটেম হল মেডিকেলের একটি টার্ম যার মানে কোন একটা নির্দিষ্ট চ্যাপ্টারের উপর দশ নাম্বারের ভাইভা পরীক্ষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার তা হল আইটেমে দশ নাম্বারের জন্য যত বেশি পড়া লাগে তার পুরা ১০০ নাম্বারের জন্য এত বেশি পড়া লাগেনা। কারন আইটেমে নির্দিষ্ট টপিকসের উপর জোর দেয়া হয়।
পড়া শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনজনের বৈশিষ্ট্য প্রকট হতে শুরু করল। বলা বাহুল্য, পড়ছি আধা ঘণ্টা আর বাকি আধা ঘণ্টা গল্প। এভাবেই ঘণ্টার কাটা যেতে লাগল। তিনভাগের একভাগ পড়া শেষ করলামলিভার সিরোসিসে মলিকিউলার মেকানিজম পড়েই চিন্তা করলাম আরে! আমরা তো অনেক পড়ে ফেলেছি। তাহলে এখন একটু গল্প করা যায়। এভাবেই একটু একটু পড়া আর গল্প চলতে লাগল। আমি যদিও গল্প না করার তাগাদা দিচ্ছি তবুও আমিই গল্পে দারুন ভাবে পার্টিসিপেইট করতে লাগলাম।

এভাবে রাত দশটা বেজে গেল। খেতে গেলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে আবার স্টার্ট করলাম। যেভাবেই হোক হেপাটোবিলিয়ারি সিস্টেম শেষ করতে হবে। রাত এগারটা নাগাদ এক ফ্রেন্ডের কাছে খবর পেলাম পরেরদিনের আইটেম ক্যান্সেল করা হয়েছে। ব্যস! পড়ার মুড তখনি দুই ধাপ নিচে নেমে গেল।
উল্লেখ্য,আইটেম হবে কি হবেনা সেটা টিচারের উপর ডিপেন্ড করেনা। ব্যাচের সবার ডিসিসানের উপর আইটেম হয়। অন্তত থার্ড-ফোর্থ ইয়ারে আমরা এরকম ফ্রিডম পেয়ে থাকি। তবে কিছু আতেল ব্যাচ থাকে যারা রেগুলার আইটেম দেয়। আইটেম সবাইকেই কমপ্লিট করা লাগে। তবে রেগুলার আইটেম না দিলে পরে লোড বেশি পড়ে যায়, এই যা! তবে আমরা যারা রেগুলার আইটেম দেইনা তারা মনে করে থাকি মেডিকেল লাইফটাই হচ্ছে ওভার লোড। সুতরাং এসব আইটেমের লোড কোন ব্যাপারনা। সুতরাং পুরা ব্যাচ বেশিরভাগ সময়ই সিদ্ধান্ত নেই রেগুলার আইটেম দিবনা, পরে সেগুলো বেশি করে আইটেম নিয়ে কাভার করে দিব।পরের দিন আইটেম হবেনা এই নিউজে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। কারণ এখন হাজার চেষ্টা করেও পড়ার মুড দুইধাপ উপরে নিতে পারবনা।

এরমধ্যে আমার ভাইএর কাছে ফোন করলাম। ওরা গেছে সুন্দরবন ট্যুরে। ব্যাপক মজা করতেছে। এটা শুনে মেজাজ আরো খারাপ হতে লাগল। ধুর! মেয়ে হয়েছি বলে কি ওদের মত আমরা লাইফে মজা করতে পারবনা? এসব আজাইরা চিন্তা করতে করতে পড়ার মুড একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এল।
বাকি দুজন এতক্ষন জ্বীন-ভূতের গল্প করতেছিল। আমি এসব মারাত্বক ভয় পাই। যদিও বিশ্বাস করিনা, কিন্তু ভয় নামক ব্যাপারটা আমার পুরা অন্তর জুড়ে ব্যপৃত থাকে। ওরাও যে ভয় পায়না তা না। কিন্তু সেই ভয়কে ওরা বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। যেহেতু ভয় আমার কাছে ভয়ই তাই বিনোদন হিসাবে নিতে পারিনি। ওদের বললাম টপিকস চেইঞ্জ করতে। কিন্তু ওরা আমার অবস্থা দেখে পূর্ণ উদ্যোমে নতুন করে জ্বীন-ভূতের গল্প শুরু করল। এই আলোচনা চলল রাত দুইটা পর্যন্ত। আমি ইতোমধ্যে ভয়ে অস্থির। ওরা আমাকে দেখে খুব মজা পাচ্ছে। পরে সেই ভয়ার্ত মন নিয়েই রাত তিনটার দিকে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমানোর সময় অবশ্য সুমাইয়া আমার পাশেই ঘুমাল, তাই ভয় কিছুটা কম পেলাম।
এভাবে মহা প্ল্যানের একটি দিন ভয়ের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেল।

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

পৃথিবী, আজ আমার ছেলে প্রথম স্কুলে যাচ্ছে ( world, my son starts school today!)

আত্মসম্মানবোধের মূলকথা আব্রাহাম লিঙ্কনের নিচের এই লেখাটাতে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার থেকে ভাল করে প্রকাশ করা যায়না...

হে পৃথিবী, আমার সন্তানের হাত ধর, সে আজ তার স্কুলের পাঠ শুরু করল। কিছুদিন তার কাছে সবই নতুন ও বিস্ময়কর মনে হবে, এবং আমার আশা তুমি তার সঙ্গে সদয়
ব্যবহার করবে। দেখ, এ পর্যন্ত সে কাটিয়েছে এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই, মুরগীর ঘরগুলিতে ছিল তার আধিপত্য, বাড়ির পিছনের বাগানের সে ছিল মালিক। তার ক্ষতে ওষুধ লাগাতে আমি সবসময়ে কাছাকাছি ছিলাম, এবং যখন সে মনে আঘাত পেয়েছে আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়েছি।

কিন্তু এখন অবস্থা অন্য রকম হবে। আজ সকালে বাড়ির সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়বে, তারপর শুরু হবে সেই মহৎ অভিযান, যা তাকে নিয়ে যাবে অনেক যুদ্ধ, বিচ্ছেদ এবং দুঃখের মধ্য দিয়ে।

পৃথিবীতে বাঁচতে হলে বিশ্বাস, ভালবাসা ও সাহসের প্রয়োজন। সুতরাং হে পৃথিবী, আমার বাসনা তুমি তার তরুণ হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে চল, এবং জীবনে যা শেখার প্রয়োজন তা তাকে শিখিয়ে দিও।

আমি জানি, ওকে জানতে হবে যে সব মানুষই ন্যয়পরায়ণ নয়, সব নারী-পুরুষই সৎ নয়, তাকে শিখিয়ে দিও যে সংসারে দুর্বৃত্ত যেমন আছে তেমনি বিরচিত গুনাবলীর মানুষও আছে; শত্রু যেমন আছে তেমনি মিত্রও আছে। প্রথমদিকেই তাকে শিখিয়ে দিও যে উৎপীড়নকারীরা সহজেই পদানত হয়।

বইয়ের পাতায় যে অত্যাশ্চর্য ভান্ডার আছে তা ওকে চিনিয়ে দিও। ওকে কিছু নির্জনতা দিও, যখন ও আকাশে পাখির ওড়া, সূর্যের আলোয় মৌমাছিদের ঘোরাফেরা কিংবা সবুজ পাহাড়ে ফুলের সমারোহ দেখে ভাবতে পারবে। ওকে শিখিও, অসৎ উপায় অবলম্বন করার থেকে অসফল হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। ওকে শিক্ষা দিও, যদি অন্য সকলে বলে যে ওর ধারণাগুলি ভুল তবুও যেন ও নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে। আমার ছেলেকে শক্তি দিও। অন্য সকলে যখন ঠেলাঠেলি করে কোনও প্রত্যাশায় গাড়িতে ওঠে, তখন ও যেন জনতাকে অনুসরন না করে। শিক্ষা দিও যেন অন্যের কথা শোনে, কিন্তু যা শোনে তা যেন সত্যের ছাঁকুনিতে ছেঁকে নিয়ে যে সারটুকু থাকে তাই গ্রহণ করে।

শিক্ষা দিও, কখনও নিজের হ্রদয় ও আত্বাকে বিক্রয়যোগ্য না করে। শিক্ষা দিও যেন উচ্ছৃংখল জনতার চিৎকারে কান না দিয়ে নিজে যা সঠিক মনে করে তার জন্য লড়াই করতে পারে।
সহ্রদয়ভাবে শিক্ষা দিও, পৃথিবী, কিন্তু অধিক প্রশ্রয় দিওনা; কারণ আগুনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেলেই উত্তম ইস্পাত তৈরি হয়।
এটি খুবই দীর্ঘ প্রত্যাশা, কিন্তু দেখ কতটা করা যায়। ও এত ভালো ছেলে...

আব্রাহাম লিঙ্কন

আসুন, প্রযুক্তির অপব্যবহারের ভয়াল গ্রাস থেকে আমাদের কচি প্রাণ শিশুদের বাচাই!!

একটা মুভি দেখছিলাম “ফাইনাল ডেসটিনেশান”। আমি, ফাহিম, যুথী, মহিমা, আনিকা সবাই মিলে। ইনফ্যাক্ট মুভি আমরা দেখছিলামনা, রায়হান দেখাচ্ছিল। সে আমাদের মুভির ফোকাসিং পার্টগুলো দেখাচ্ছিল। এরকম প্রায়ই আমরা সব কাজিনরা মিলে মুভি দেখি। কিছুদিন ধরে কয়েকটা ব্যাপার মাথার মধ্যে খুব ঘুরপাক খাচ্ছিল। থ্রিতে পড়া ফাহিমের সাথে মুভি দেখতে গিয়ে ভাবনাটা আরো বেশি সিভিয়ার হল। মুভিটাতে যাইহোক না কেন, যুথী সেগুলো দেখে ভয়ে অস্থির। আমি নরম্যালি যেকোন ভূতের ছবি দেখলে ভয় পাব কিন্তু বাস্তব কিছু দেখলে সেরকম ভয় পাইনা। একারনে রক্তারক্তি, খুনোখুনি দেখতে আমার ভাল না লাগলেও আমি কখনও ভয় পাইনা। সুতরাং খুব আগ্রহ নিয়ে ফাইনাল ডেস্টিনেশান দেখছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, মুভিতে যতবারই কেউ মারা যাচ্ছে, কিংবা মারা যাবার দৃশ্য যত ভয়ংকর হচ্ছে ফাহিম তত বেশি এক্সাইটেড হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট কেউ মারা গেলে আমি ভয় না পেলেও, যে মারা যাচ্ছে তার জন্য খুব দুঃখ লাগতেছে। কিন্তু ফাহিম দুঃখ তো পাচ্ছেইনা বরং, আনন্দিত হচ্ছে। আরে! আমি ফাহিম কে বললাম,- ভাইয়া তোমার এত্ত আনন্দের তো কিছুই নাই। এত্ত এক্সাইটেড কেন? সে জবাবে খুব অবাক হয়ে বলল,--আনন্দিত হবনা? এত্ত ফাটাফাটি একশানধর্মী ছবি! জোস!

ঠিক একইধরনের ঘটনা ঘটেছিল তার দুই দিন আগে। দুই ভাগ্নে এসেছিল বাসায়। একজন ক্লাস টু তে আরেকজন ক্লাস সেভেনে। চরম উদ্যমে তারা কম্পিউটারে গেইম খেলছিল। আমি কখনও কম্পউটারে গেইম খেলিনি। আসলে হয়ত পারিনা বলে খেলিনা। তো সেদিন তারা খেলছিল “ভাইস সিটি” নামে একটা গেইম। আমি ওদের খেলা একটু পর্যবেক্ষন করলাম। আসলে আগ্রহ ছিল কিভাবে এত ছোট বাচ্চারা গেইম খেলে, যা কিনা আমিও পারিনা। ওদের খেলা দেখে তো মাথা গরম হবার মত অবস্থা। গেইমের থিম হচ্ছে , একজনকে খুন করতে হবে, বিনিময়ে টাকা পাওয়া যাবে। এরপর শুরু হল মিশন। যখন তখন কারো গাড়ি ছিনতাই করা, পুলিশ কে ঘুশ দিয়ে ম্যানেজ করা, নিয়ম ভায়োলেইট করা, রাস্তা-ঘাটে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বিনা কারণে ছিনিয়ে নেওয়া, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা, পার্টি-ক্লাবে যাওয়া, অনিয়মের মাধ্যমে টাকা ইনকাম করা, মোটকথা বাই হুক অর ক্রুক; মিশন সাকসেসফুল হওয়া। আমি ওদের মুখে ভার্চুয়াল বিভিন্ন অস্ত্রের নাম ও ব্যবহার শুনে পুরাই তাজ্জব হয়ে গেলাম। ক্লাস টু তে পড়ে যে ভাগ্নে তার ছোট ভাই যে এখনও স্কুলে যায়না, সেও এই গেইম ভাল খেলতে পারে। জানিনা পাঠকের কাছে হয়ত ব্যাপারটা খুব হালকা লাগছে। কিন্তু আমার কাছে খুব ভয়ঙ্কর লাগছে ব্যাপারটা।

একটি বাচ্চা জন্মের পর থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা সব কিছু নিয়ম ভংগ করে খেলাতে জয়ী হওয়াকে বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। আর কার্টুন তো সাথে আছেই। কার্টুনেও সেইম কেইস হচ্ছে। একটা বাচ্চার সাইকোলোজিতে একদম ছোটবেলা থেকেই অন্যায় টা বিনোদন হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে বিনোদন তাই নয়, বাবা-মায়েরাও সেই বিনোদনে উৎসাহ দিচ্ছে। তারা ভাবছে, --বাচ্চা মানুষ খেলছে, এ আর এমন কি!

এতদিন তো আমি যে বিষয় নিয়ে চিন্তায় ছিলাম তা হল, বড়দের কথার মধ্যে বাচ্চারা আছে কিনা সেটা খেয়াল রাখা, কিংবা টিভিতে তারা কি দেখছে সেটা খেয়াল রাখা। এখন দেখছি তারা কি খেলে, কি কার্টুন দেখে সেটাও চিন্তার বিষয়।উফ! আমাদের পূর্বের যুগের বাবা-মায়েরা কি শান্তিতেই তা না ছিল। তাদের তো এত কিছু চিন্তা করত হয়নাই। তখন কম্পিউটার এত এভেয়লেবল ছিলনা, ভাইস সিটির মত গেইম ছিলনা।

চারপাশের ফ্যাক্টর বর্তমান যুগে বাচ্চাদের জন্য কতটা হুমকি স্বরূপ। টিভি, বিজ্ঞাপন, কার্টুন, গেইম সর্বোপরি বাচ্চারা যেসব জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে তা কতটা ভয়াবহ খারাপের দিকে লিড করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অজান্তে। নীরবে দূষন করে দিচ্ছে আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের কোমল, নিষ্পাপ মন কে। একটু ও কি ভেবে দেখছি ব্যাপারটা আমরা?

প্রযুক্তির বিরুদ্ধে আমি কখনও নই। এসব নিরব পয়জনিং থাকা সত্বেও আমি চাইনা যে বাচ্চারা কম্পিউটার থেকে দূরে থাকুক, গেইম না খেলুক, কার্টুন না দেখুক। এসব আমার দাবি না। ইনফ্যাক্ট আমি এই দাবি করলেও খুব হাস্যকর লাগবে। কারণ আমাদের বাবা-মায়েরা রাতের বেলা শুধু গল্প শুনিয়ে মন ভুলিয়ে রাখত, আমরা দাদী/নানীর কাছে রূপকথার গল্প শুনেই বড় হয়েছি। কিংবা টিভিতে মীনা কার্টুন দেখেছি, আর বিকেল হলেই খেলতে গিয়েছি। কিন্তু এখন তো বাচ্চাদের বিনোদনের ডাইমেনশান অনেক বড় হয়ে গেছে। তাদের শুধু গল্প শুনিয়ে তাদের ডিমান্ড পূরন করা যাবেনা। কারণ আপনি হয়ত একা চেষ্টা করবেন, কিন্তু চারপাশের আবহাওয়াকে আপনি থামাবেন কিভাবে? আপনার বাচ্চা এসে যখন বলবে --তার সব ফ্রেন্ডরা কম্পিউটারে গেইম খেলে, কার্টুন দেখে, তাকে কেন দেখতে দেওয়া হয়না? তখন আপনি একা কিভাবে আপনার বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রন করবেন?

এবার আসি, কিভাবে বাচ্চাদের এই স্রোত থামানো যায়ঃ


আমার কিছু আইডিয়া এসেছে। আপনাদের মতামত প্রত্যাশা করি।
যারা ইঞ্জিনিয়ার, ইনফ্যাক্ট যারা গেইম বানাতে পারে তারা উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। আমি যতদূর শুনেছি কম্পিউটার সায়েন্স হচ্ছে সেই সাবজেক্ট যেখানে স্টুডেন্টরা গেইম বানাতে পারে। সুতরাং কম্পিউটার সায়েন্স যেসব ভাইয়া-আপুরা পড়াশুনা করছেন তারা প্লিজ এটা নিয়ে একটু ভাবুন। আর যারা এনিমেটর আছেন তারাও দয়া করে যদি এগিয়ে আসতেন বাচ্চাদের সুন্দর ভবিষ্যত রক্ষায়। আর আমরা যারা যেভাবে পারি এব্যাপারে সচেষ্ট হই, সচেতনতা বাড়াই। হয়ত এটা আপনার ক্যারিয়ারে খুব কাজে আসবেনা ডিরেক্টলি, কিন্তু এটা শিউর যে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের সাইকোলোজি ডেভেলপ করতে অনেক দূর কাজে লাগবে। আমরা যত আধুনিক হচ্ছি তত রিস্কি হয়ে পড়ছে আমাদের চারপাশ। বাচ্চাদের জগত আরো বেশি রিস্কি হয়ে পড়ছে। তাই আপু এবং ভাইয়া রা প্লিজ আপনারাই পারেন কিছু করতে এখানে, কিছু অবদান ইচ্ছা করলেই রাখতে পারেন। দেখেন না, পারেন কিনা বাচ্চাদের জন্য কোন সুন্দর, শিক্ষনীয় গেইম বানাতে। যেখানে নিয়ম ভংগ করলে জরিমানা, অবৈধ টাকা ইনকাম করলে পয়েন্ট কাটা, সাধারণ মানুষের কোন ক্ষয় ক্ষতি করা যাবেনা, নিয়ম মেনে চললে বোনাস ইত্যাদি এরকম। এতে করে বাচ্চাদের সাইকোলোজি সুন্দর ভাবে ছোটবেলা থেকেই তৈরি হবে, তাদের কাছে কোন মানুষের করুণভাবে মৃত্যু জোস লাগবেনা, তাদের ছোট ছোট অনুভূতিগুলো যেন একশানধর্মী ফাটাফাটি মারামারির মধ্যে বিনোদন হয়েই শেষ না হয়ে যায়। এরকম ধংসাত্বক বিনোদন হতে তাদের দূরে রাখার প্রয়াসে আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। 
তাই, আসুন, প্রযুক্তির ভয়াল গ্রাস থেকে আমাদের কচি প্রাণ শিশুদের বাচাই!! সবাই মিলে...

ফিরে দেখা ২০১০ : প্রেম

ব্যাপারটা দুঃখজনক কিনা জানিনা, তবে আমার বেশিরভাগ ফ্রেন্ডের বয় ফ্রেন্ড আছে। সো তাদের কাছে আমি ভয়াবহ এক আজব জিনিস। একদিন তারা এই প্রেম বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালাল। মেইন টার্গেট ছিলাম আসলে আমি। কেন আমি প্রেম করিনা। আমি কোন কিছুই কারণ ছাড়া ব্যাখ্যা করিনা। যদি কেবল ইসলামিক ভিউ থেকেও বলতে হয় তাহলেও আমাকে লজিক্যাল কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। ইনফ্যাক্ট তারা কেউই অত ধর্মের ধার ধারেনা। সুতরাং খুব ক্রিটিক্যাল মুহূর্ত ছিল সেটা আমার জন্য, কারণ আমি ওদের কাছে ধর্মের দোহাই দিয়ে পার পাবনা। আমাকে কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে।
যাইহোক সেই মুহুর্তে আমি পার পেয়ে গেলাম। কারণ আমার যুক্তি তাদের ভয়াবহ পছন্দ হয়েছে। যদিও খুব সাধারণ একটি কথা বলেছিলাম। খুব স্মার্টলি বলেছিলাম---“দেখ, আমি তোদের মত অতটা ডিটারমাইন্ড না। যার সাথে আজ আমি কমিটমেন্টে গেলাম, (ইনফ্যাক্ট রিলেশান বলতে আমি কমিটমেন্টকেই বুঝি) পরবর্তিতে আমি সেই কমিটমেন্ট রাখতে পারব কিনা আমি জানিনা। কারণ আমার পরিবার, তার পরিবার, পরিবেশ, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যত সবকিছুই অনিশ্চিত। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি কি করে এত বড় একটা মেজর কমিটমেন্টে যাই!! আমি তোদের মত এতটা ডিটারমাইন্ড আসলে না”।
তারা আমার এই জবাবে খুব খুশি। কিন্তু এই খুশিও যে বেশিদিন টিকবেনা কে জানত!!

আরো কয়েকমাস পর আবার সেই প্রেম বিষয়ক আলোচনা। বরাবরের মত এবারও টার্গেট আমি। কারণ ইতোমধ্যেই আমার পূর্বের জবাবের বিরুদ্ধে শক্ত এক লজিক টেনে এনেছে তারা। হুম, আমি বলেছিলাম ভবিষ্যত অনিশ্চিত, তাই রিলেশানের কমিটমেন্ট হয়ত রাখা সম্ভব না। কিন্তু সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতকেও তারা এবার নিশ্চিত করেছে। কিভাবে? ওকে, শুনেন তাদের লজিক... “ শোন তুই যাকে পছন্দ করবি অর্থাৎ যার সাথে তোর রিলেশান থাকবে তার সাথে তুই পালিয়ে বিয়ে করবি। তাহলে তোর কমিটমেন্ট তুই সহজেই রাখতি পারলি। আর পরিবারের ব্যাপারেও সমাধান আছে। যখন তোর বাবা-মা দেখবে যে মেয়েটা তাদের বিয়ে করেই ফেলেছে তখন তারাও অগত্যা মেনে নিতে রাজি হবে। সুতরাং দুইদিক থেকেই তুই সেইফ থাকলি। কোন কিছুই আর অনিশ্চিত থাকলনা”।
বুঝেন এবার তাদের যুক্তি, কোথায় এপ্লাই করেছে!! আমি তো কিছুক্ষন তাদের লজিক শুনে মিউট হয়ে গেছিলাম। কিন্তু তারপরও খুব সাধারণভাবে এবারও যা বললাম সেটাও তারা মেনে নিল। কি বললাম, জানেন? ---“ দেখ, বছরের পর বছর যার সাথে প্রেম করব তাকে আমার সত্যি খুব বোরিং লাগবে পরে। এমনিতেও প্রেম না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গল্প করা ক্লাসের ছেলেদেরও আমার খুব বোরিং লাগে। যে আমার লাইফ পার্টনার হবে তার সবকিছুই যদি আমি বিয়ের আগেই জেনে যাই, শেয়ারিং,কেয়ারিং,ভালবাসা এসবের মেইন স্পিরিট শেষ হয়ে যাবে তাহলে। আর বিয়ের পর যাকে আমি প্রথম চিনব তাকে চিনতেই চিনতেই তো রিলেশান অনেক স্ট্যাবল হয়ে যাবে। তাই না? সো অসব প্রেম আমাকে দিয়ে হবেনা।”
উফ!! এই জবাবটাও তাদের পছন্দ হল। কারণ ইতোমধ্যে তাদের প্রেম জমে বরফ হতে শুরু করেছে। একজন তো বলেই ফেলল, তার নাকি এখন বয়ফ্রেন্ড কে খুব বোরিং লাগে। অনেকবার ট্রাই করেই ব্রেক আপ করতে পারছেনা। কিভাবে যেন প্রতিবারই ব্রেক আপ মিস হয়ে যাচ্ছে। একেই বলে মনে হয় আজকালকার প্রেম! যদিও জানিনা ভবিষ্যতে তারা আবার কি লজিক নিয়ে আমার কাছে আবার আসবে?

বছরের শুরু থেকেই একজনের প্রেম শুরু হল, যেখানে আমিই নাকি ছিলাম ভিলেন। একসময় এই প্রেমের সূত্র ধরে তার সাথে বন্ধুত্বও শীতল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সেই শীতল সম্পর্ক উষ্ণ করতে পারিনি। পরে ওটা গন কেইস হিসেবে রেখে দিলাম। আরেকজনের সাথে রিডিং পার্টনার হিসেবে পড়তে পড়তেই দুজনে চরম ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। ধরে নিলাম তার নাম নীলা। উল্লেখ্য আমরা কেউই কিন্তু লাইব্রেরিতে পড়িনা, হলের রুমে বসেই পড়তে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করি। কারণ আমরা কলেজের রিডিং রুম ও লাইব্রেরি রুমগুলো বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের জন্য ছেড়ে দিয়েছি। তারা নিশ্চিন্তে ওখানে প্রেম-স্টাডি দুটাই চালাতে পারে। যেহেতু আমরা সেরকম কিছু না, তাই নিজেদের রুমেই স্টাডি করি।

ঘটনাক্রমে নীলার যে বয়ফ্রেন্ড তার সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়া শুরু করল। কারণ হচ্ছে আমি। নীলার বয়ফ্রেন্ডের অভিযোগ নীলা নাকি আমাকে বেশি টাইম দেয়, আমার সাথে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। আর যেহেতু নীলা ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে লাইব্রেরিতে স্টাডি করেনা, সুতরাং তাদের রিলেশান খুব খারাপের দিকে যেতে লাগল। আমি তো কিছুটা টেনসানে ছিলাম, কারণ এখানে আমি কিছুই করছিনা, তারপরেও ভিলেন হয়ে যাচ্ছি আমি। নীলার যদি আমার সাথে গল্প করতেই বেশি ভাল লাগে সেটা কি আমার দোষ নাকি! আজব!! পরে নীলার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার কথা হল। তাকে খুব সহজেই বললাম যে-- দোস্ত, তুমি আসলে প্রেম করতে জাননা। তা না হলে, তোমাদের প্রেমের মধ্যে আমি কেমনে থার্ড পারসন হই? আমি তো আর ছেলে না যে তোমার প্রেমিকার সাথে প্রেম করব।
এই কথাগুলো সে খুব সিরিয়াসলি নিল। পরে আমাকে বলল যে, আসলেই সে বুঝতেছেনা কিভাবে নীলার সাথে সম্পর্ক ভাল করা যায়। আমার কাছে টিপস চাইল। আমি তো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম, ওসব প্রেমের ব্যাপার আমি বুঝিনা বাপু! তোমাকে কেমনে টিপস দেই বল...!!
জানিনা শেষ পর্যন্ত এই প্রেমে কোথায় গিয়ে গড়ায়। কারণ এটা এখনও কন্টিনিউয়াস প্রসেস। তবে আর যাইহোক শেষ পর্যন্ত আমি যেন কোন ঝামেলায় নাই পড়ি সেই চেষ্টা করে যাব।

আর নিজের প্রেম? আসলে আমি জানিনা প্রেমের ডেফিনিশান টা আসলে কি। এইতো দুইদিন আগে দুলাভাই বাসায় বেড়াতে আসলেন। ভাইয়ার সাথে আমরা সব ভাই-বোন, কাজিনরা অনেক মজা করছিলাম। কথায় কথায় দুলাভাই তার এক বান্ধবির কথা বলছিলেন ঠিক এভাবে--- “ ......সেই বান্ধবির নাম ছিল পাতা। তার সাথে আমার সম্পর্ক আসলে ভালই ছিল। আমি জানতামনা প্রেম বলতে আসলে কি বুঝায়। তবে আজকে এত বছর তার কথা মনে করতে গিয়ে মনে হল আসলে তার সাথে আমার মনে হয় প্রেম ছিল...”। সবাই একযোগে হেসে ফেললাম।

এখন আমিও ঠিক বলতে পারছিনা, কারো সাথে সত্যি আমার প্রেম আছে কিনা। তবে হয়তবা দুলাভাইয়ের মত অনেক বছর পর ব্যাপারটা আমি ঠিকই ধরতে পারব। আমি আশাবাদি।

ফিরে দেখা ২০১০: মোবাইল

মোবাইল নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ ছিলনা এবছরে। প্রচলিত অর্থে বিড়ম্বনা না এটা। কারণ মোবাইল ক্রাইম যেভাবে বেড়েছে সেখানে মোবাইল নিয়ে বিড়ম্বনারও মানুষের শেষ নাই। কিন্তু আমার টা ভিন্ন। আসলে কেউ কখনও আমাকে মোবাইলে বিরক্ত করতে পারেনি এপর্যন্ত। কারণ বিরক্ত করবে কি করে? আমি বিরক্ত হলেই না আমি বিরক্ত হব! আচ্ছা ঘটনা খুলে বলি তাহলে।

পারসোনাল মোবাইল আমি প্রথম ব্যবহার করি ২০০৬ সাল থেকে। সো তখন থেকেই অপরিচিত নাম্বার থেকে প্রচুর কল, মিসডকল আসতে থাকে। এই বছরের মাঝামাঝি তে একবার প্রচুর অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসতে থাকে। যেহেতু আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। তাই খেয়াল থাকেনা কে কখন ফোন দেয়। তাই কে কখন কি মেসেজ দিল, কে মিসডকল দিল এসব নিয়ে কখনই মাথা ব্যথার সময় থাকেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার, এক শুক্রবারে একজন অপরিচিত লোক আমাকে ফোন দিয়ে বলে- “ আচ্ছা আপু আপনি কি একটুও ডিস্টার্বড হন না? গত এক সপ্তাহ ধরে আমি আপনাকে কন্টিনিউয়াস মিসডকল দিয়ে যাচ্ছি। দিনে কমপক্ষে ২০ বার করে। আপনার কি একটুও জানতে ইচ্ছা করে না যে এক আমাকে এরকম মিসডকল দিচ্ছে?”
আমি তো পুরাই অবাক। কি বলে এই লোক। আমি বললাম “ স্যরি, ভাইয়া আসলে মোবাইল চেক করা হয়না আমার সেরকম। তাই দেখিনি আপনি আমাকে কতদিন ধরে কতবার মিসডকল দিচ্ছেন।“
এই হচ্ছে ব্যাপার। কিন্তু এই সমস্যার আরেকটি ভয়াবহ দিক আছে। পরিবারের অনেকেই আমাকে ফোন করে ঠিক যখন আমি ক্লাসে থাকি। পরে ক্লাস শেষে বাসায় যেতে যেতে বিকাল হয়ে যায় তখন আর খেয়াল থাকেনা যে কে আমাকে ফোন করেছিল। সুতরাং আমার নামে প্রচুর কমপ্লেইন আসে আমার আম্মার কাছে। কিন্তু কি আর করা! তাদের কে তো ব্যাপারটা বুঝানো যাবেনা।
মোবাইলের আরেকটা ব্যাপার আছে সেটা হল, আমি সবসময় মোবাইল ভাইব্রেইট করে রাখি। যেকোন সময় যদি ক্লাসে ফোনে রিং হয় তাহলে তো সমস্যা হতে পারে। আর তাছাড়া যেকোন পাবলিক প্লেইসেও আমি মোবাইল ভাইব্রেইট করে রাখতেই পছন্দ করি। অযথা মোবাইলের রিংটোন অন্যের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু এই ভাইব্রেইট করা নিয়েও বাসায় একদিন প্রচুর বকা দেওয়া হল আমাকে। আমি নাকি ভাইব্রেইট করে রাখি যেন কারো ফোন রিসিভ করতে না হয় এজন্য। যাইহোক বকাবকি শুনে আমি মোবাইলে রিংটোন মোড দিলাম।

পরেরদিন সকাল বেলা ছিল আমার পরীক্ষা। রিংটোন অফ করতে মনে নাই। পরীক্ষার হলেই আমার মোবাইল বেজে উঠল। এপ্রনের পকেটেই ছিল মোবাইল। কিন্তু পরীক্ষার টেনসান এত বেশি ছিল যে আমি নিজেই টের পাইনি যে আসলে মোবাইলে রিং হচ্ছে। আমার পাশে বসা ফ্রেন্ড যদি না বলে দিত যে আমার এপ্রনের পকেটেই মোবাইল বাজছে তাহলে হয়তবা সেই পরীক্ষা আর আমার দেওয়া হতনা। অনেক কৃতজ্ঞ সেই ফ্রেন্ডের প্রতি আজও।
এরপর আরেকদিন প্যাথোলজি ভাইভা দিচ্ছি। ঠিক ভাইভার টেবিলেই আমার ফোন বেজে উঠল। খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ম্যাডাম অনেক ভাল ছিলেন বলে আমার দিকে কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, হয়ত ভাবছিলেন আমার এত বড় সাহস কি করে হল যে ভাইভার টেবিলে মোবাইল অফ না করে চলে আসি। ম্যাডামের ওই দৃষ্টি আর ভাবতে ভাবতেই আমি মোবাইল অফ করে ফেলে খুব সুন্দর করে করুণ চোখে স্যরি বললাম। কাজ হল। বেচে গেলাম সেবার ও।
এরপর আরেকদিন মাইক্রোবায়োলোজি লেকচার ক্লাস, স্যার সেদিন মোবাইল নিয়ে নসিহত দিচ্ছিলেন। স্যার বলছিলেন, যে উনি একজন টিচার হয়েও ক্লাসে মোবাইল অফ করে আসে, ক্লাস চলাকালীন সময় কোন ফোন কল রিসিভ করেননা। আর আমরা কিনা স্টুডেন্ট হয়ে মোবাইল অফ করিনা, বরং জোরে জোরে রিংটোন বেজে উঠে ক্লাসের ফাকেই। হাউ ডেয়ার ইউ!! ঠিক তখনি আমার ফোন বেজে উঠল। একেবারেই অন দ্যা স্পট। স্যার তখন আমাকে কি করবেন একচুয়ালি সেটা বুঝতেছিলেননা। কারণ এই মোবাইল নসিহতের মধ্যেও কারো ফোন বেজে উঠতে পারে সেটা উনার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। সম্ভবত স্যার মেয়ে বলেই আমাকে সেদিন আর কিছু বলেননি, জাস্ট আমাকে টাইম দিলেন মোবাইল অফ করার জন্য। কিন্তু ছেলে হলে সেদিন যে আমার বারোটা বেজে যেত কোন সন্দেহ ছিলনা। সেদিনই কেন যেন মেয়ে হিসেবে নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব অনুভব করছিলাম। থ্যাঙ্কস আল্লাহ ফর ক্রিয়েটিং মি এজ এ গার্ল!!!!

ফিরে দেখা ২০১০ : টাকা

টাকার ব্যপারে আমি খুবই অসচেতন। এটা যে ইচ্ছা করে তা নয়, বরং আমি বহুবার চেষ্টা করেছি সচেতন হবার। কিন্তু পারিনি। কত টাকা যে আমার হারিয়ে গেছে, আমি টেরই পাইনি। কিংবা আমার ব্যাগ থেকে কত টাকা যে আমার ভাই সরিয়েছে তাও কোনদিন টের পাইনি। কারণ কত টাকা আমার কাছে আছে তা আমি নিজেও জানিনা। এবছর টাকা নিয়েও কিছু মজার ঘটনা ঘটে গেল।
একবার রিকশা করে যাচ্ছিলাম আমার ফ্রেন্ডের বাসায়। যাবার পথে একটা ওভার ব্রিজ পার হয়ে আবার রিকশা নিতে হয়। তো ওভার ব্রিজের সামনে নেমে আমি ভাড়া দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার ব্যাগে কোন টাকা নাই। অথচ আমি দিব্যি ভেবে নিয়েছি যে আমার ব্যাগে টাকা আছে। এরপর আর কি করা! নিকটস্থ এক পরিচিতার বাসা ছিল কাছেই। কিন্তু হেটে যেতে হয় অনেকদূর। রিকশাওয়ালাকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। বেচারা তো আমার উপর খুবই বিরক্ত। যাইহোক আমার বিনয় দেখে কিছু আর বলেনি। পরে অনেকদূর হেটে যেতে এবং আসতে প্রায় আধা ঘণ্টা পর ভাড়া মিটালাম।
বছরের শুরুতেই প্ল্যান করেছিলাম যে মোবাইলে আমার এক্সাক্টলি কত খরচ হয় এখন থেকে সেভাবে খেয়াল করব। কিন্তু সেই হিসাব একসপ্তাহ থাকে। পরে ভুলে যাই। ইনফ্যাক্ট এখনও আমি জানিনা যে মোবাইলে আসলেই আমার খরচ কত হয়। তো একবার এক সিনিয়র ভাইয়ার কাছে একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্য ফোন করেছি। ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার মোবাইলে টাকা আছে কিনা। আমি বলে দিলাম যে আছে। কারণ আমার মনে হচ্ছিল, কিছুদিন আগেই আমি রিচার্জ করেছি। সুতরাং মোবাইলে এখন যথেষ্ট ব্যালান্স আছে। কিন্তু মাত্র দুই মিনিট কথা বলার পর দেখি লাইন কেটে গেছে। ব্যালান্স শেষ!
নীলক্ষেত গিয়েছি বই কিনতে। আমার এই একটা ব্যাপারে দারুন ফ্যাসিনেশান আছে। বলা যায় আমার বই কেনার বিলাসিতা আছে চরম। কিছু বই আমার পড়া আছে, তারপরও দেখা গেছে সেই বই আমি কিনে নিয়ে চলে এসেছি। কারণ বই চোখের সামনে দেখাও আমার জন্য ভাল লাগার ব্যাপার, সেটা যতই পড়া হোক না কেন। লাইব্রেরিতে গিয়ে অনেক বই সিলেক্ট করলাম কেনার জন্য। এরপর ক্যাশ মেমো করতে গিয়ে ১৫০০ টাকা হয়েছে বিল। আমি তখনও জানিনা, আমার কাছে কত টাকা আছে। পরে বিল পে করতে গিয়ে দেখলাম যে ১২০০ টাকা আছে। খুব লজ্জাজনক ব্যাপার। এরপর দুইটা বই কমিয়ে ১২০০ এর কাছাকাছি বিল দিয়ে বাসায় আসলাম। শেষ পর্যন্ত এরকম হল যে বাসায় এসে দেখি ০ পয়সাও নাই।
এটাতো একটা ঘটনা। অন্য আরেকদিন বই কিনতে গিয়েছিলাম। মেডিকেলের বই অনেক দামী। একটা বই কিনলাম, যার দাম ৫০০ টাকা। আমি দোকানদারকে ১০০০ টাকার নোট দিয়ে দিব্যি চলে আসছি। কিছুদূর আসার পর মনে হল কেউ আমাকে পিছন থেকে ডাকছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি আমাকে বাকি ৫০০ টাকা নিয়ে যাবার জন্য ডাকছে। খুবই হাস্যকর ঘটনা। দোকানদার তো আমার দিকে তাকিয়ে দিব্যি হাসতেছিল। যদি সেই দোকানদার আমাকে না ডাকত আমার টাকার কথা মনেই থাকতনা।

কোথাও গেলে আমি ভিড় সবসময় খুব এড়িয়ে চলি। ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বইমেলাতে গিয়েছিলাম বই কিনতে। সেখানে গিয়ে তো মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা। সবাই কত্ত বই পাগল না হলে এরকম মারাত্বক ভিড় হয়। তারপরও চেষ্টা করলাম ঢুকার। ঢুকার পর দেখি বের হবার মত পথ নাই। যাইহোক বহুক্ষন দাঁড়িয়ে আছি, সবার বই কেনা দেখছি। জাফর ইকবালের ইকারাস বইটা যেভাবে বিক্রি হচ্ছে আমার তো মনে হচ্ছিল না জানি এটা কি! দেখলাম সবাই আর কিছু কিনুক আর না কিনুক ইকারাস একটা করে কিনছে। আমিও একটু আগ্রহী হলাম। অল্প কয়েক পেইজে চোখ বুলালাম। আহামরি কিছু না যে এরকম মহামারি আকারে বিক্রি হচ্ছে। সাথে আমার কাজিন ছিল সেতো রীতিমত তখন ইকারাস কেনার জন্য প্রায় কান্নাকাটি শুরু করেছে। কিনে দিলাম। কত দাম ছিল মনে পড়ছেনা। তবে ঘটনা যা ঘটল তা হল আমি টাকা না দিয়েই চলে আসতে যাচ্ছিলাম। সেবার ই মনে হয় এরকম উল্টা ঘটনা ঘটল। যাইহোক সেই লজ্জাকর অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এখনও লজ্জা লাগে।
টাকা ধারের ব্যাপারেও একই ঘটনা। কাকে কত টাকা দিয়েছি তা আমার কখনই মনে থাকবেনা। কয়েকমাস আগে একজন ফ্রেন্ড আমাকে ২৫০ টাকা দিচ্ছে। আমি বললাম, কি জন্য। বলল, ধারের টাকা ফেরত দিচ্ছে। আমি তো অবাক! কবে ধার দিয়েছি আমি? সে বলল ৫/৬ মাস আগে নাকি ওকে ধার দিয়েছিলাম। সেটা ফেরত দিচ্ছে। যাক বাবা! ফেরত তো দিয়েছে।
আর কারো কাছে টাকা ধার নিলে তো আমি বলেই দেই যে প্লিজ আমাকে মনে করিয়ে দিও। আমার মত খুব কমই আছে, তাই যথাসময়ে আমি অন্যের টাকা ফেরত দেই, কারণ তারা আমাকে মনে করিয়ে দেই......

ফিরে দেখা ২০১০ : জুতা

জুতা নিয়ে সমস্যা আমার অনেক আগে থেকে। তবে এবছর সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করল। আমার এক কাজিন, যে সবসময় তার জুতা নেই বলে রীতিমত আক্ষেপ করতে থাকে। অথচ এমন কোন অকেশান নাই যে অকেশানে সে নতুন জুতা নেয়নি। এমনিতেই আমি সবসময় জুতা নিয়ে সমস্যায় থাকি। সেদিন তো বিরক্ত হয়ে গেলাম ওর জুতা আক্ষেপ নিয়ে। কতগুলো জুতা আছে দেখতে চাইলাম ওর কাছে। প্রথম তো সে বলে তার কোন জুতা নেই, কি দেখাবে। আমি বললাম যা আছে তাই দেখাও। একটা একটা করে জুতা দেখাতে দেখাতে মোট ১১জোড়া জুতা দেখাল। তাকে বললাম, বাহ! ভালই তো তোমার জুতা না থাকাই ভাল। না থেকেই ১১জোড়া, থাকলে না জানি কত হত!

এই জুতা ব্যাপারটা কেন জানি আমার একদমই সয়না। প্রতি মাসেই নতুন জুতা কিনতে হয়। এমন না যে বিলাসিতা। সমস্যা আমার জুতা ছিড়ে যায়। সর্বোচ্চ দেড় থেকে তিন মাস জুতা লাস্টিং করে। ইনফ্যাক্ট বর্তমানে কেউ জুতা দেখতে চাইলে আমি মাত্র একজোড়া দেখাতে পারব। কারণ সত্যি আমার এই একজোড়া ছাড়া আর নাই। মেয়েদের নাকি কিছু স্বভাব থাকে। প্রচুর শপিং, কেনা-কাটা, সৌখিন, ফ্যাশন সচেতন ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। কেন জানিনা এই ব্যাপারগুলোতে আমি খুব মিতব্যয়ি। প্রয়োজন আর সৌখিনতার মধ্যে আমি সবসময় প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাই অতিরিক্ত কোন ব্যবহার্য জিনিস আমি রাখিনা। তারউপর যদি সৌখিন জিনিস হয় তাহলে তো একেবারেই না।
গত মাসে আমার কাজিন একটা সুন্দর কানের দুল গিফট করল। সেই কানের দুল নিয়ে আমি এখনও অস্বস্তিতে আছি। যেহেতু জিনিসটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় তাই এই কানের দুল নিয়ে কি করব তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। অবশেষে ভাবলাম কারও যদি এটা পছন্দ হয়ে যায় তাহলে ওকে সেটা দিয়ে দিব।

যাইহোক জুতা প্রসঙ্গে আসি। জুতা ছেড়ার কাহিনী আর কি বলব। ক্যাম্পাস হলে তো মোটামুটি সবাই জানে যে আর কারো জুতা না ছিড়লেও আমার জুতা ছিড়বেই। এজন্য অতিরিক্ত জুতা সবসময় আমার ফ্রেন্ড রা আমাকে প্রোভাইড করে। আশ্চর্য ব্যাপার, বাটা কোম্পানির জুতা নাকি খুব স্থায়ী হয়। সেই জুতাও আমার কাছে তিন মাসের বেশি লাস্টিং করে নাই। আব্বু-আম্মু তো খুব বিরক্ত আমার উপর। আমি নাকি জুতা পরার উপযুক্ত না। আচ্ছা আমার কি দোষ?
জুতা নিয়ে কাহিনী ছেড়া পর্যন্ত শেষ হলেও কিছু বলতামনা। অবশেষে জুতা থেকে আমার পায়ের স্কিনে এলার্জির সমস্যা হল। স্যারের কাছে দেখাইলাম। স্যার বলল জুতা চেইঞ্জ করতে। স্যারের কথামত জুতা চেইঞ্জ করলাম। কিন্তু সমস্যা আর কমেনা। এখন শুধু এই জুতা সমস্যার জন্য স্যারের কাছে বার বার যেতেও ভাল লাগেনা। পরে ঠিক করলাম, জুতার জন্য পায়ে যাইহোক স্যারের কাছে যাবনা। পারলে ইন্টার্নি করছে এক কাজিনের কাছে ফোনে এডভাইস চেয়েছি, প্যাথলোজি বই পড়েছি, ফার্মাকোলোজি থেকে ড্রাগস এর নাম জেনে নিজের চিকিৎসা করেছি তবুও স্যারের কাছে যাইনি। একসময় পায়ের অবস্থা এমন দাড়াল যে আমি আর জুতাই পরতে পারিনা।
এরপর শুরু হল ব্যান্ডেজ চিকিৎসা। পায়ে সুন্দর করে ব্যান্ডেজ পরে জুতা পরতাম। সবাই প্রথমেই জিজ্ঞেস করে আমার কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে কিনা। ফ্রেন্ডদের বুঝানো গেলেও বাইরের কাউকেই বুঝানো যায়নি যে এটা আমার নিছক জুতা সমস্যা। সবাই মনে করে না জানি কত সিরিয়াস! ব্যান্ডেজ চিকিৎসা দুইমাস চলল। মোটামুটি ব্যান্ডেজ চিকিৎসা আমার জন্য উপকারি হল। ব্যান্ডেজ খুলার পর যখন আবার খালি পায়ে জুতা পরলাম আমার মনে হল যে আমি এতদিন পা ছাড়াই চলেছিলাম। ব্যান্ডেজ এর পর জুতা পরে পায়ের অনুভূতি দুই মাস টের পাইনি।

ভাবলাম এবার থেকে নিশ্চয় জুতা নিয়ে আমার আর সমস্যা হবেনা। কিন্তু এবার জুতা নিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি হল। এতদিন জুতা ছিড়ে যেত, এখন আর ছিড়ে যায়না ঠিকই। কিন্তু এমন পিচ্ছিল হয়ে যায় যে আমি জুতা পরে হাটার সময় বেশিরভাগ সময় পড়ে যায়। আরে! এটা কি ধরনের সমস্যা...? কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সিরিয়াস। যেকোন জুতাই এখন আমি পায়ে দেবার কিছুদিনের মধ্যে খুব মসৃন ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে সেটা পরে হাটতে সমস্যা হয়। যাইহোক এই সমস্যা দূর করতে খুব শক্ত সোলযুক্ত জুতা কেনা শুরু করলাম। কিন্তু সমস্যা একই থাকে।

অবশেষে বছরের শেষে এসে হিসাব করলাম এই বছরে আমার কতগুলো জুতা কেনা হয়েছে। দশ জোড়ার বেশি জুতা আমি কিনেছি, কিন্তু একটাও এখন পরার উপযুক্ত না।সর্বশেষ সাতদিন আগে দুইজোড়া জুতা কিনেছি। ইতিমধ্যে একজোড়া জুতায় কিছু সমস্যা অনুভব করছি। আল্লাহই জানে, কি অপেক্ষা করছে এই জুতা নিয়ে।
সামনে ২০১১। প্লিজ আমার জুতা ভাগ্য যেন এটলিস্ট সুপ্রসন্ন হয়ে যায় সেই দোয়া চেয়ে আমার এই জুতা কাহিনী শেষ করছি।