শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০১০

তুমি নারী বলেই এই লেখা তোমার জন্য উৎসর্গিত !!!

লেখাটা শুরুর করার পূর্বেই বলে নেই এই চিন্তা ভাবনার প্রেরণা পেয়েছি আমার সবচেয়ে প্রিয় আপুর কাছ থেকে। নারী কেন্দ্রিক লেখাটা খুব সাহস করেই লিখে ফেললাম যেহেতু আমি নিজেও একজন নারী। তাই একজন নারী হিসাবে নিজেকে যেভাবে দেখতে চাই ও অন্য নারীদের প্রতি প্রত্যাশা করি সেটাই অকপটে বলে ফেললাম। কেউ এটা পড়ে যদি মাইন্ড করেন তবে সেটার দায় দায়িত্ব তার উপর পড়বে, লেখকের উপর নয়।

নিজ পরিবার, সমাজ ও দেশের সীমানা পেরিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির এই বিশ্বে একজন নারী যখন উন্নত বিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করে তখন এক জটিল সমস্যা অনুভব করে সে। একদিকে নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার পাবার চরম আকাঙ্ক্ষা অন্যদিকে নিজ অস্তিত্ব সংকট। সবকিছুর সংমিশ্রন একজন নারীর চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

যাইহোক হাজার নেগেটিভিটি, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এক নারী যখন নিজেকে নিয়ে প্রচলিত ট্রেডিশান বা ঐতিহ্যের বাইরে নিজেকে নিয়ে ভিন্নরকম চিন্তা শুরু করে এবং বাস্তব জগতে তার প্রতিফলন ঘটাতে চায় তখনই তাকে সম্মুখিন হতে হয় বিভিন্নমুখী পারিবারিক ও সামাজিক বিপত্তির। অবশ্য আজকাল পারিবারিক ও সামাজিক বিপত্তির মাত্রা কিছুটা হলেও কমে গেছে। এজন্যই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নারীকে কেবল আমরা ঘরের ঘরনী হিসাবে দেখিনা। বরং চিকিৎসক, আর্কিটেক্ট, টিচার, সংবাদ পাঠিকা, জার্নালিস্ট, মিডিয়া ওয়ার্কার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রফেশানে একজন নারী নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। এসব যত দেখি তত ভাল লাগে, নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগে, সমাজে নারী হিসাবে কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। আসলে নারী-পুরুষের সমান পার্টিসিপেশান নিশ্চিত করে সমাজের চাকা গতিশীল রাখতে। কিন্তু, কিন্তু এত কিছুর পরেও কোথায় যেন একটা সমস্যা দেখতে পাই।

সেদিন আমার এক স্টুডেন্টের সাথে কথা বলছিলাম, সে খুব আফসোস করে বাংলাদেশের ছেলেদের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে বলল, নিউজিল্যান্ড থেকে একজন চিকিৎসক এদেশের গরীব মানুষের সেবা দেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কতটা মানবদরদী না হলে সে তার নিজের দেশের উন্নত ব্যবস্থা বাদ দিয়ে, নিজের আরাম-আয়েশ ভুলে গিয়ে অন্য দেশের গরীব মানুষের জন্য নিজেকে এভাবে উৎসর্গ করতে পারে? অথচ বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পক্ষে কি এটা সম্ভব? এরা তো নিজের দেশের গরীব মানুষকে কিভাবে তিলে তিলে শেষ করতে পারে এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে! কথা বলার সময়ই আমার মধ্যে ভিন্ন একধরনের চিন্তা শুরু হল......একটা পরিবারের পুরা ভরনপোষণের দায়িত্ব থাকে সেই পরিবারের পুরুষের উপর। গৃহকর্ত্রী বাইরে জব করলেও পরিবারের ভরনপোষণের জন্য বিন্দুমাত্র কোন মাথা-ব্যাথা তার উপর বর্তায় না, যতটা বর্তায় একজন পুরুষের উপর। চিন্তা ভাবনাটাকে আরো একটু এক্সটেন্ড করে দেখলাম যে, পরিবারের সেই পুরুষ যদি তার নিজের জীবন নিউজিল্যান্ডের সেই চিকিৎসকের মত মানবতার উদ্দেশ্যে স্যক্রিফাইস করে তাহলে তো মহা সর্বনাশ!! তাই পুরুষরা কেন মানবতাবাদী হয়ে সেই নিউজিল্যান্ডের চিকিৎসকের মত হয়না একথাটা বাইর থেকে বলা যতটা সহজ বাস্তব জীবনে এটার প্র্যাক্টিক্যাল প্রয়োগ ততটাই কঠিন।

ভাবতে ভাল লাগে যে নারীরা আজ শিক্ষার অবাধ সুযোগ পেয়েছে।পরিবারেও নারীকেশিক্ষার ব্যাপারে প্রচুর সহযোগিতা করা হয়। ফলে সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি নারীর দৃড় পদচারনা আমাকে স্বপ্ন দেখায় একটি সুখি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু যে শিক্ষার সুযোগ পাবার জন্য নারীরা এত সংগ্রাম করল সেই শিক্ষার আলো পেয়ে কতজন নারী তাদের চিন্তা ভাবনার জগতকে আলোকিত করতে পেরেছেন? খুব দূরে যাবনা, আমার ফ্রেন্ড সার্কেলেই যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, যারা ভবিষ্যৎ চিকিৎসক তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তুমুল আলোচনা করেছিলাম। কারও ইচ্ছা প্রচুর টাকা ইনকাম করার, কারও শুধুই গাড়ি,বাড়ি,শপিং, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর, কারও ইচ্ছা সোস্যাল স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য বড় বড় ডিগ্রি নেবার, কারও ইচ্ছা শখের মেডিক্যাল শেষে একদম ঘরোয়া হয়ে যাবার। কেন জানি অসামঞ্জস্য লাগছিল তাদের এই ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাগুলো। নিজের প্রতি, নিজ পরিবার,সমাজ ও দেশের প্রতি নারী হিসাবে কি কোন দায়বদ্ধতা নেই? আবার সেই নারী তাহলে কিভাবে পুরুষের কাছ থেকে পারিবারিক ও সামাজিক সকল দায়িত্বের পূর্ণ প্রয়োগ প্রত্যাশা করে??

তাই একজন নারী হিসাবে সকল নারীর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসা জানিয়ে কিছু অনুরোধ করতে চাই...

অবিবাহিত নারীর প্রতিঃ
নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য আপ্রানচেষ্টা করতে হবে। উচ্চ শিক্ষায় পারে সংকীর্ণ চিন্তার গন্ডি থেকে মুক্তি দিতে। নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি সচতন হোন। সমাজে আপনার ভূমিকা কি হবে এটা ক্যালকুলেইট করেন। নিছক উচ্চ শিক্ষা নারী মুক্তি আনবেনা বরং শিক্ষার সাথে নিজের চারপাশ, পরিবেশ ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। শুধু শপিং, পার্লার, ঘুরাঘুরি করে নয় বরং অবসর সময়ে নিজেকে ক্রিয়েটিভ ও প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখুন। একটা ব্যাপার বিয়ের পর সংসার বা দাম্পত্য ঝামেলা, মনোমালিন্য এড়াতে আজকাল এফেয়ারের যে নতুন ট্রেডিশান শুরু হয়েছে এতে করে ঝামেলা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। একে অপরকে চেনার জন্য বিয়ের পূর্বে প্রেম এই থিওরিটা এখন চরম আকারে ধ্বসের সম্মুখিন হচ্ছে। কারণ সিটি কর্পোরেশানের এক জরীপের মতে বর্তমানে ভালবাসাজনিত বিয়ের ডিভোর্সের সংখ্যা আনুপাতিকহারে বেড়েই চলেছে। তাই বিয়ের আগে এফেয়ার জনিত কেইসে সময় না দিয়ে সর্বোপরি জীবনমুখী বাস্তব চিন্তা করুন। বিয়ের পূর্বে নিজের দাবি, অধিকার, স্বাধীনতা ও কাজের ব্যাপারে হবু বরের নিকট পরিষ্কার জানিয়ে রাখুন। পরস্পর মিউচুয়ালের মাধ্যমে একটা লিখিত ডকুমেন্টে আসুন। এতে করে পরে ঝামেলা হলেও সেটা সলিউশান করা খুব বেশি কষ্টের হবেনা আশা করি। আর যেটা অনিশ্চিত সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করে নিশ্চিত যেটা আপনি করতে পারবেন সেটা নিয়ে রিসার্চ করেন। আপনি পারবেন ভবিষ্যত একটি পরিবারকে নেতৃত্ব দেবার, নিজের অবস্থানকে সুদৃড় করে সামাজিকভাবে নিজেকে অধিক গ্রহনযোগ্য করে তুলতে।

বিবাহিত নারীর প্রতিঃ
খুব সাধারণ কিন্তু ভুল একটি ধারণা বর্তমান আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে আর সেটা হল একটা মেয়ে পড়াশুনা করবে অথচ বাইরে জব করবেনা তাই কি হয়!! এতে করে মনে করা হয় নারীর সমস্ত শিক্ষায় বৃথা, নারী নিজের প্রতি এব্যাপারে খুব হীনমন্যতায়ও ভুগে। অথচ একজন শিক্ষিত নারী যদি বাইরে জব নাও করে তার সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ জব করতে হয় ঘরের ভিতরে। একজন নারী ঘরে বসে বিশ্ব পরি্চালনায় অংশগহন করে। এই বিশ্ব পরিচালনার কাজ
নিশ্চয় এত সহজ না যতটা একজন নারী ভাবে! আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। আগামী ভবিষ্যতের দায়ভার একজন নারীকে নিতে হয়, কোন পুরুষকে নয়। তাদের পারিবারিক আবহে সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চয়তা দেওয়া, মানসিক ও শারিরীক বিকাশে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি এসব কাজের জন্য যদি কোন প্রতিষ্ঠান খোলা হয় আমি নিশ্চিত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ও প্রেস্টিজিয়াস প্রতিষ্ঠান হবে সেটা। একটা শিশুর মনে মায়ের প্রভাব কিভাবে বিস্তার করে সেটা নিয়ে গবেষণা করলে সেই গবেষণার পেপার এতখানি গুরুত্ব পাবে পুরা বিশ্বে যে সবাই একথা
একবাক্যে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে যে এক মায়ের জন্যই পুরা পৃথিবী টিকে আছে। তাই ঘরে বসে বাইরে জব না করার আক্ষেপ না করে বিশ্ব পরিচালনায় অংশ নেবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। একথা আমি হলফ করে বলতে পারি কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক ঘরে বসে এই বিশ্বপরিচালনার কাজ পৃথিবীর হাজার শ্রেষ্ঠ কাজের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। একজন পুরুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেবল একজন নারী। তাই সাধ্যের অতিরিক্ত প্রত্যাশা করে নিজের স্বামীকে খারাপ পথে ইনকাম করতে বাধ্য করবেননা, অন্ধকার জগতে পা বাড়াতে দিবেননা। নিজেদের মধ্যে সামান্য ব্যাপারে দাম্পত্য কলহ না করে সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করুন। আপনাদের এই কলহ বাচ্চার মনে যে গভীর খারাপ ইফেক্ট ফেলবে সেটার ক্ষতি পূরণ সহজে হবেনা।

আর যেসব নারী বিবাহিত এবং বাইরে জব করছেন , কিংবা যারা নিছক ঘরনী হতে চাননা আবার বাইরেও জব করেননা তাদের প্রতি অনুরোধ আমি জানি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনি অবস্থান করছেন। যেহেতু পারিবারিক ফাইন্যান্সিয়াল ব্যাপারের দায়ভার আপনার উপর নেই তাই আপনি খুব দারুন ভূমিকা রাখতে পারেন সোস্যাল ওয়ার্কে। যেহেতু আপনার দক্ষতা আছে নেতৃত্ব দেবার, সময় আছে নিজেকে অন্যরকমভাবে রিপ্রেজেন্ট করার তাই কেবল শখের জব নয় পাশাপাশি সামাজিক ও মানবতাবাদী কাজে সময় দিন। যে দায়িত্ব পুরুষের পক্ষে নেওয়া কিছুটা কষ্টকর সেই দায়িত্ব আপনি নিয়ে নেন। নারীদের জন্য উপকারি কোন কিছু করার পরিকল্পনা নেন। কিংবা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সামাজিক ও মানবতাবাদি কাজে নিযুক্ত করুন ও সমাজে নারীর অবস্থান, প্রাপ্য অধিকার, স্বাধীনতার ক্ষেত্র এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষিত নারীর দুর্ভোগ নিয়ে গবেষনার কাজে নিযুক্ত থাকুন। বাইরে জব করা মানেই নিছক টাকা ইনকাম করা কিংবা কেবল চাকরির উদ্দেশ্যে চাকরি নয় বরং সমাজে নিজের উপস্থিতি প্রমান করা এইভাবে যে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নারীরাও এগিয়ে। এখনই সময় এসেছে নারীর সমান অধিকারের নামে যুক্তিহীন সংগ্রামে পুরুষের সাথে না ঝাপিয়ে নিজেদের ব্যাপারে সচেতন হোন, নিজেদের প্রাপ্য অধিকারের ব্যাপারে সংগ্রামী হোন। পুরুষরা আপনাদের প্রতিযোগী নয়, আবার আপনারাও পুরুষদের প্রতিযোগী নন, তাই নারী-পুরুষ সমান এটা প্রমাণের উদ্দেশ্যে বাইরে জব করা নারীর জন্য বোকামী ছাড়া কিছুইনা। তাই একজন প্রফেশনাল নারীর প্রতি এই অনুরোধ আপনারা এই বোকামী ছেড়ে নিজের ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রেখে সাথে পরিবারকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে খুব স্মার্টভাবে রিপ্রেজেন্ট করুন।

শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

ইভটিজিংঃ নেপথ্যের আড়ালে ও আমাদের দায়বদ্ধতা।

অনেকদিন ধরে ভাবছি কিছু লিখব। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ, সাম্প্রতিক ঘটনা সব মিলিয়ে চিন্তা-ভাবনা গুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা ও দুর্যোগের এমন এক চেইন রিএ্যকশানের মধ্যে পড়ে গেছি , যে, চিন্তা ভাবনার জট একটি খুলার পর দেখি আরেকটিতে জট লেগে গেছে। তারপরও কী-বোর্ড হাতে নিলাম। নিজের একদম ভিতরের স্বত্তার জোরেই কিছু লেখার সাহস খুজে পেলাম।


ফার্মগেট হতে রিক্সা করে আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড বাসায় ফিরছিলাম। তখন সম্ভবত এইচ.এস.সি পরীক্ষা চলছিল। যাইহোক পরীক্ষার্থীদের ভিড় ছিল চারপাশে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের ঠিক সামনের রিক্সাতে দুইজন কলেজ ইউনিফর্ম পরা মেয়েকে একটি ছেলে খুব বাজে মন্তব্য করতেছে। ছেলেটি রিক্সার পাশে পাশে দৌড়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটা আরো বেশি নজরে আসল তখন দেখি ছেলেটি তার হাতে কোমল পানীয়ের একটি বোতল মেয়েগুলোর দিকে সজোরে ছুড়ে মারে। সাথে কিছু কথা “ তুমি আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ। আমি তোমাকে ছাড়বোনা।এভাবে তুমি আমাকে রেখে ওই ছেলের সাথে প্রেম করলে আমি দেখে নিব...............”

ঘটনাটা ক্রমেই খুব মারাত্বক আকার ধারণ করছিল। ছেলেটা কে আমার খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। মনে হল ছেলেটাকে আমার কিছু বলা উচিৎ। কিন্তু পাশ থেকে আমার ফ্রেন্ড আমাকে খুব স্ট্রঙ্গলি বাঁধা দিল। এতক্ষন ধরে যে ছেলেটিকে আমার অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তখন আমার চারপাশের মানুষকে আরো বেশি অস্বাভাবিক মনে হল। রাস্তা ভর্তি মানুষ, সবাই ঘটনাটা মনে হল খুব উপভোগ করছিল। কেউ ছিলনা ওখানে ছেলেটাকে বাঁধা দেবার। নিজের চোখের সামনে সংঘটিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে মন খুব খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। বাসায় পত্রিকা খুলতেই দেখি, ইভটিজিং খুব মারাত্বক আকার ধারণ করেছে...
রেগুলার বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম পড়ে বুঝার চেষ্টা করলাম আসলে ইভটিজিংকে কে কিভাবে ব্যাখ্যা করছে। কে বা কারা দায়ী এটা বিশ্লেষণ করার আগে কি জন্য এরকম হচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তিত হলাম।

ছেলে এবং মেয়ের প্রতি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আকর্ষন আছে। সুতরাং কোন সুন্দর ড্রেস আপ, গেট আপের কোন মেয়ে দেখলে যেকোন ছেলে আকর্ষিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েদের প্রতি ছেলেদের এই আকর্ষনের প্রকাশ ভঙ্গি যখন কোন মেয়েকে সামাজিকভাবে হেয় করে, বিব্রত করে সেটাই ইভটিজিং এর পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে। খুব সহজভাবে পর্যবেক্ষন করলে বুঝা যায় যে ইভটিজিং এর জন্য ছেলে
এবং মেয়ে উভয়ই দায়ী। কোন মেয়ে যদি বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষিত করার জন্য অশালীন পোশাকে রাস্তায় বের হয় সেক্ষেত্রে ছেলেরাতো ইভটিজিং করবেই। আর ছেলেদের যদি এই নৈতিক ও মানবিকবোধ না থাকে যে যাকে সে টিজ করছে সে হতে পারত তারই বোন। আল্টিমেইটলি যা হছে মেডিকেলের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ইভটিজিং এর সাফারার হচ্ছে মেয়েরা আর ক্যারিয়ার হল ছেলেরা।
কে বা কারা দায়ী এই প্রশ্নে আসলে আমি যেটা খুব স্ট্রঙ্গলি ফিল করি সেটা হল আমরা নিজেরা, আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্র। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা যখন নারীদের সমান অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমেছিলাম তখন আমরা কি একবারও ভেবেছিলাম যে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুন্দর প্ল্যাটফর্ম লাগবে যেটা নিশ্চিত করবে নারীর নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের সুন্দরতম সমন্বয়। যে নারীরা শিক্ষা ও বাইরে চাকরি থেকে বঞ্চিত ছিল তারাই পেল শিক্ষার অধিকার, ঘরের বাইরে পুরুষের সহকর্মী হিসাবে চাকরি করার অধিকার। নারীরা যখন অশিক্ষিত ছিল তখন তারা অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত হত ঘরের ভিতরে আর যখন নারী শিক্ষিত হয়ে বাইরের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রকাশের সুযোগ পেল তখন তারা লাঞ্চিত ও অপমানিত হল সর্বত্র। যেখানেই নারীরা সদর্পে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নেমে এল ঠিক তখনি নারীর সমঅধিকার আদায়ের কর্ণধার পুরুষরা তাদের বিভিন্নক্ষেত্রে লাঞ্চিত করল। তাই শুরুতেই ছিল একটি বিরাট ভুল। যতক্ষন পর্যন্ত এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ ও বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রসেস বন্ধ রাখাই ভাল। নারীরা নিজেদের অবস্থান নিজেরা বুঝতে পারেনি। শুধুই কি তাই? আজকাল রাস্তার বিলবোর্ড বা টিভি খুললেই দেখি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারীরাও খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজেদের পণ্য হিসাবে প্রচার করে। কর্পোরেট মিডিয়া এই নারী পণ্যকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন নতুন আইডিয়া জেনারেট করছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফ্যাশান শো অনুষ্ঠানের নামে নারী সৌন্দর্যের নামে যে নগ্ন প্রচারণা চলছে তা দেখে এই প্রজন্ম কি শিখবে? নারীরা কেবল ভোগ্যবস্তু ব্যতীত কিছুইনা!! ফলে রাস্তা ঘাটে মেয়েদের প্রতিটি ছেলে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখছে এবং ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে নারীরা। এর জন্য দায়ী কারা পাঠক বিবেচনা করুন।
আর আমদের রাষ্ট্রের ভূমিকা আর কি বা বলব! আইনের শাসন যদি কড়া না হয় এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিটি ছেলের নৈতিক শিক্ষা ও মেয়েদের ধর্মীয় অনুশাসনে গড়ে তোলা না হয় তাহলে ইভটিজিং এর করাল গ্রাস কখনই বন্ধ হবেনা। ভেবেছিলাম যে ইভটিসিং এর জন্য এই সংকটময় মুহুর্তে সরকারের অবস্থান হবে খুব দৃঢ়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যা হল তা দেখে মনে হল লোকদেখানো দৃঢ়তা প্রদর্শনীর ছলনা মাত্র!
তাই ভাবতে ভয় লাগে, চিন্তা করতে শিহরিত হই , আমরা নিজেরা, আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্র যদি এখনও এব্যাপারে সচেতন পদক্ষেপ না নেই হয়তবা আরো হাজার হাজার মেয়েকে ইভটিজিং এর স্বীকার হতে হবে। জীবন ও সমাজের প্রতি ঘৃণা থেকে হয়ত অনেক নারীকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আত্বহননের পথ বেছে নিতে হবে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন নিরবে নিভৃতে কাঁদে। কিন্তু বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সরকার দেশ শাসন করে পাঁচ বছর আর দেশের সুশীল সমাজ,সাংবাদিক,লেখক বা যাদের বিবেক বলে কিছু আছে তারা সত্য প্রকাশ করে, নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তার কথা না ভেবে,  দেশ শাসন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই কিছু লিখে নিজেকে দায়মুক্ত করার এক কৃত্তিম প্রচেষ্টা চালালাম।