শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

ইভটিজিংঃ নেপথ্যের আড়ালে ও আমাদের দায়বদ্ধতা।

অনেকদিন ধরে ভাবছি কিছু লিখব। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ, সাম্প্রতিক ঘটনা সব মিলিয়ে চিন্তা-ভাবনা গুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা ও দুর্যোগের এমন এক চেইন রিএ্যকশানের মধ্যে পড়ে গেছি , যে, চিন্তা ভাবনার জট একটি খুলার পর দেখি আরেকটিতে জট লেগে গেছে। তারপরও কী-বোর্ড হাতে নিলাম। নিজের একদম ভিতরের স্বত্তার জোরেই কিছু লেখার সাহস খুজে পেলাম।


ফার্মগেট হতে রিক্সা করে আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড বাসায় ফিরছিলাম। তখন সম্ভবত এইচ.এস.সি পরীক্ষা চলছিল। যাইহোক পরীক্ষার্থীদের ভিড় ছিল চারপাশে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের ঠিক সামনের রিক্সাতে দুইজন কলেজ ইউনিফর্ম পরা মেয়েকে একটি ছেলে খুব বাজে মন্তব্য করতেছে। ছেলেটি রিক্সার পাশে পাশে দৌড়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটা আরো বেশি নজরে আসল তখন দেখি ছেলেটি তার হাতে কোমল পানীয়ের একটি বোতল মেয়েগুলোর দিকে সজোরে ছুড়ে মারে। সাথে কিছু কথা “ তুমি আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ। আমি তোমাকে ছাড়বোনা।এভাবে তুমি আমাকে রেখে ওই ছেলের সাথে প্রেম করলে আমি দেখে নিব...............”

ঘটনাটা ক্রমেই খুব মারাত্বক আকার ধারণ করছিল। ছেলেটা কে আমার খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। মনে হল ছেলেটাকে আমার কিছু বলা উচিৎ। কিন্তু পাশ থেকে আমার ফ্রেন্ড আমাকে খুব স্ট্রঙ্গলি বাঁধা দিল। এতক্ষন ধরে যে ছেলেটিকে আমার অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তখন আমার চারপাশের মানুষকে আরো বেশি অস্বাভাবিক মনে হল। রাস্তা ভর্তি মানুষ, সবাই ঘটনাটা মনে হল খুব উপভোগ করছিল। কেউ ছিলনা ওখানে ছেলেটাকে বাঁধা দেবার। নিজের চোখের সামনে সংঘটিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে মন খুব খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। বাসায় পত্রিকা খুলতেই দেখি, ইভটিজিং খুব মারাত্বক আকার ধারণ করেছে...
রেগুলার বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম পড়ে বুঝার চেষ্টা করলাম আসলে ইভটিজিংকে কে কিভাবে ব্যাখ্যা করছে। কে বা কারা দায়ী এটা বিশ্লেষণ করার আগে কি জন্য এরকম হচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তিত হলাম।

ছেলে এবং মেয়ের প্রতি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আকর্ষন আছে। সুতরাং কোন সুন্দর ড্রেস আপ, গেট আপের কোন মেয়ে দেখলে যেকোন ছেলে আকর্ষিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েদের প্রতি ছেলেদের এই আকর্ষনের প্রকাশ ভঙ্গি যখন কোন মেয়েকে সামাজিকভাবে হেয় করে, বিব্রত করে সেটাই ইভটিজিং এর পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে। খুব সহজভাবে পর্যবেক্ষন করলে বুঝা যায় যে ইভটিজিং এর জন্য ছেলে
এবং মেয়ে উভয়ই দায়ী। কোন মেয়ে যদি বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষিত করার জন্য অশালীন পোশাকে রাস্তায় বের হয় সেক্ষেত্রে ছেলেরাতো ইভটিজিং করবেই। আর ছেলেদের যদি এই নৈতিক ও মানবিকবোধ না থাকে যে যাকে সে টিজ করছে সে হতে পারত তারই বোন। আল্টিমেইটলি যা হছে মেডিকেলের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় ইভটিজিং এর সাফারার হচ্ছে মেয়েরা আর ক্যারিয়ার হল ছেলেরা।
কে বা কারা দায়ী এই প্রশ্নে আসলে আমি যেটা খুব স্ট্রঙ্গলি ফিল করি সেটা হল আমরা নিজেরা, আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্র। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা যখন নারীদের সমান অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমেছিলাম তখন আমরা কি একবারও ভেবেছিলাম যে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুন্দর প্ল্যাটফর্ম লাগবে যেটা নিশ্চিত করবে নারীর নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের সুন্দরতম সমন্বয়। যে নারীরা শিক্ষা ও বাইরে চাকরি থেকে বঞ্চিত ছিল তারাই পেল শিক্ষার অধিকার, ঘরের বাইরে পুরুষের সহকর্মী হিসাবে চাকরি করার অধিকার। নারীরা যখন অশিক্ষিত ছিল তখন তারা অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত হত ঘরের ভিতরে আর যখন নারী শিক্ষিত হয়ে বাইরের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রকাশের সুযোগ পেল তখন তারা লাঞ্চিত ও অপমানিত হল সর্বত্র। যেখানেই নারীরা সদর্পে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নেমে এল ঠিক তখনি নারীর সমঅধিকার আদায়ের কর্ণধার পুরুষরা তাদের বিভিন্নক্ষেত্রে লাঞ্চিত করল। তাই শুরুতেই ছিল একটি বিরাট ভুল। যতক্ষন পর্যন্ত এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ ও বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রসেস বন্ধ রাখাই ভাল। নারীরা নিজেদের অবস্থান নিজেরা বুঝতে পারেনি। শুধুই কি তাই? আজকাল রাস্তার বিলবোর্ড বা টিভি খুললেই দেখি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারীরাও খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজেদের পণ্য হিসাবে প্রচার করে। কর্পোরেট মিডিয়া এই নারী পণ্যকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন নতুন আইডিয়া জেনারেট করছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফ্যাশান শো অনুষ্ঠানের নামে নারী সৌন্দর্যের নামে যে নগ্ন প্রচারণা চলছে তা দেখে এই প্রজন্ম কি শিখবে? নারীরা কেবল ভোগ্যবস্তু ব্যতীত কিছুইনা!! ফলে রাস্তা ঘাটে মেয়েদের প্রতিটি ছেলে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখছে এবং ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে নারীরা। এর জন্য দায়ী কারা পাঠক বিবেচনা করুন।
আর আমদের রাষ্ট্রের ভূমিকা আর কি বা বলব! আইনের শাসন যদি কড়া না হয় এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিটি ছেলের নৈতিক শিক্ষা ও মেয়েদের ধর্মীয় অনুশাসনে গড়ে তোলা না হয় তাহলে ইভটিজিং এর করাল গ্রাস কখনই বন্ধ হবেনা। ভেবেছিলাম যে ইভটিসিং এর জন্য এই সংকটময় মুহুর্তে সরকারের অবস্থান হবে খুব দৃঢ়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যা হল তা দেখে মনে হল লোকদেখানো দৃঢ়তা প্রদর্শনীর ছলনা মাত্র!
তাই ভাবতে ভয় লাগে, চিন্তা করতে শিহরিত হই , আমরা নিজেরা, আমাদের সমাজ ও আমাদের রাষ্ট্র যদি এখনও এব্যাপারে সচেতন পদক্ষেপ না নেই হয়তবা আরো হাজার হাজার মেয়েকে ইভটিজিং এর স্বীকার হতে হবে। জীবন ও সমাজের প্রতি ঘৃণা থেকে হয়ত অনেক নারীকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আত্বহননের পথ বেছে নিতে হবে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন নিরবে নিভৃতে কাঁদে। কিন্তু বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সরকার দেশ শাসন করে পাঁচ বছর আর দেশের সুশীল সমাজ,সাংবাদিক,লেখক বা যাদের বিবেক বলে কিছু আছে তারা সত্য প্রকাশ করে, নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তার কথা না ভেবে,  দেশ শাসন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই কিছু লিখে নিজেকে দায়মুক্ত করার এক কৃত্তিম প্রচেষ্টা চালালাম।
 

কোন মন্তব্য নেই: