রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

এক সত্তায় বহুভুবনঃ কানেক্টিং স্টক


ঢাকা ১২১ কি.মি.......সন্ধ্যা ৬.৩০

নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আসামীর কাঠগড়ায় বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চারপাশে থমথমে পরিবেশ। কেউ কোন কথা বলছেনা। নিরব, নিথর। গাড়ির গ্লাস থেকে হালকা বাতাস আসছে। হালকা হালকা শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু সেটা মনের গরম আবহের কাছে পাত্তা পাচ্ছেনা।
কখনও কোনও কিছু নিয়ে আমার ফিলিংস মাত্রাতিরিক্ত হয়না। আমি নিজে সেখানে লিমিটেশান টেনে দিই। কিন্তু এবার আমি সেটা করতে পারছিনা। জগতের সবচেয়ে ভালবাসার জিনিস থেকে আমি ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি। তাশফিনকে এবার প্রথম কোলে নিলাম। অপলক অয়নে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি মায়াবী সে চাহনি! মনে হল সারাজীবন যদি এভাবে ওকে কোলে করে রাখতে পারতাম তাহলে আমার আর জীবনে কিছুই লাগবেনা। জানিনা তাশফিনকে নিয়ে মিতু আপুর ফিলিংস কেমন ছিল। সেই অসীম ভালবাসার ফিলিংস অকল্পনীয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে মিতু আপুর পারসোনাল ডায়েরীতে তার দুই ছেলে ফারদীন ও তাশফিন নিয়ে লেখা অপ্রকাশ্য ফিলিংসগুলো আমাকে বার বার ভাইব্রেইট করে। মা! মাতৃ্ত্ব! এক অদ্ভুত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক নিয়ে লেখার সাহস আমি পাচ্ছিনা।

কিন্তু আজই ঢাকা যেতে হবে? শিডিউল টাইমের আগে ঢাকা ত্যাগ করলাম একটু বেশি করে ভালবাসার কাছাকাছি সময় কাটাব। সব প্ল্যান ভ্যানিশ!!

ঢাকা ১১০ কি.মি....

মনের গরম আবহ ধীরে ধীরে শিতল হয়ে যাচ্ছে। ধীর মোশনে গাড়ি চলছে। জানালা দিয়ে ঝিরি ঝিরি বাতাস আসছে। বাইরে নিকষ গাঢ় অন্ধকারের দৃশ্য দেখতে ভাল লাগছে। এই পরিবেশে খুব স্বপ্ন বিলাসী হতে ইচ্ছা করছে। স্মৃতির এলবামে ভেসে আসছে রূপন্তির কথা। এক স্বপ্নবিলাসী মেয়ে...ওর সাথে পরিচয় ক্লাস নাইনের শেষ দিকে। আমি সায়েন্সে আর রূপন্তি কমার্সে। সবাই নতুনদের স্বাগতম জানাতে পারেনা। আমি পেরেছিলাম। খুব কাছের করে নিয়েছিলাম ওকে। ভাল লাগত ওর অসম্ভব বাস্তববাদি কথা। খুব অবাক হয়ে যেতাম কিভাবে একটা মানুষের মধ্যে স্বপ্ন বিলাসী ও বাস্তববাদীতার সমন্বয় ঘটে। কিন্তু ওর সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হয়েছিল হঠাৎ এবং শেষ হয়েছিল হঠাৎ করে। নাহ! শেষ বললে ভুল হবে। শেষ যোগাযোগ হয়েছিল হঠাৎ করে। এসএসসি পরীক্ষার কয়েক মাস আগে মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি হলুদ গোলাপের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়ে ছোট একটা মেইল। হঠাৎ মেইল দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। পরে ফোন ,মেইলের রিপ্লাই দিয়েও তার কোন রিপ্লাই পাইনি। পুরা গায়েব!!! বন্ধু তোমার জন্য শুভকামনা আমারও...

মাওয়া ফেরী ঘাট...

জোরে একটা ব্রেক! সামনে ঝুকে পড়লাম। রূপন্তির কল্পনার জগত থেকেও ব্রেক টানলাম। গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাস দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক অসীম রাস্তা। চারপাশে গাছপালা। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সব কিছু স্বপ্নীল মনে হচ্ছে। সেই স্বপ্নের জগতে ভেসে উঠল এবার তিশার ছবি। একজন অলরাউন্ডার। ছোটবেলায় যদি কাউকে ঈর্ষা করতাম তাহলে সেই ছিল প্রথম ও শেষ। যদিও সেই ঈর্ষা মনের গহীন কোন থেকে কখনও বাস্তবে আসেনি। সেই তিশার সাথে দেখা হল দশ বছর পর। অবিকল আগের মত চেহারা। শুধু মাত্র লম্বা হয়েছে। সেই আগের মত হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, আকর্ষণীয় চাহনি। চট্টগ্রাম ভ্রমনের সুপ্ত কারণ পূর্ন হল এবার। প্রথম কয়েক মিনিট আমাকে দেখে সে নির্বাক ছিল। পরে জোরে এক চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোনদিন কল্পনাও করেনি আমি এভাবে ওর সামনে হাজির হব। খুব ভাল লাগল আমি ওর অকল্পনীয় কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করেছি। আমি ওর রুমের চারপাশ দেখতেছি। পুরা রুম জুড়ে শুধু তিশা। ওর হাতে আকা ছবি, ওয়ালমেট, হাজারো পুরস্কারের ক্রেস্ট পুরা রুম জুড়ে আছে। শুধু মাঝখান থেকে ঝরে গেছে তার সেই প্রতিভা যা ওকে করত পুরা স্কুল ফার্স্ট। এফেয়ার জনিত সমস্যার কারণে জীবনের ক্যারিইয়ারে অনেক পিছনে পড়ে গেছে। কিছু কিছু শুনলাম ওর সমস্যা । শুধুই স্বান্তনা দেওয়া আর চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু সংবরন ছাড়া কিছুই করার ছিলনা সেদিন...


ঢাকা ৩৩ কি.মি.....

কোন এক মন্ত্রীর জন্য দুই ঘণ্টা লেইট হল। চাচার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ‘এই দেশের যে কি হবে? সবকিছুতেই আনডিসিপ্লিন্ড।‘ দেশের ব্যপারে রাগ প্রকাশ করতেই প্রসংগ চলে গেল রাজনীতির দিকে। দেশের এই বর্তমান অরাজক পরিস্থিতিতে কিইবা বলার আছে। শুধু এইটুকুই মনে করছিলাম যে ঢাকার বাইরে দুইদিন কৃত্তিম শান্তিতে কাটাব। কোন খবর শুনবনা, টিভি দেখবনা,ইন্টারনেটে যাবনা। কিন্তু সেটা আর হয়নি। বড় মামার সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা হল রাজনীতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতার গল্প তাই বহুবার শুনেছি উনার কাছে। এবার শুরু হল মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার দের অপকর্মের কাহিনী। শিবির এর উত্থানের ইতিহাস। শিবির নিধনের এই কাজকে মামা প্রশংসা করলেন। বাহ! এসব শুনে আমি এটাই বললাম যে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান হলে সরকারের এই কাজকে আমিও সাধুবাদ জানাই। রাবি তে যে ফারুক নিহত হল সে যেমন আমার ভাই তেমনি আবু বকর, মহিউদ্দিনও আমার ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে এই সংঘাত আমি মেনে নিতে পারছিনা। ব্যক্তি বিশেষের অন্যায়কে পুরা সংগঠনের উপর চাপিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ের সংঘাতকে আমি আরো উস্কে দিতে পারিনা। রাজনীতি কেন সবসময় প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়?? আর গণতান্ত্রিক সরকারের এই কাজ কে আমি কখনই সাপোর্ট দিতে পারছিনা। নিরপেক্ষ বিচার হলে সেখানে আমার আপন কেউ দোষী হলে আমি মেনে নিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কেন এই পক্ষপাতিত্ব?? লীগ কি একদম সাধু? তাদের কি কোন দোষ নাই? এই প্রশ্নের জবাব মামা দ্রুত দিলেন। বললেন লীগও চরম খারাপ, তবে শিবির থেকে ভাল। মানে খারাপের ভাল। তাহলে কিভাবে আপনি এই খারাপে খারাপের সংঘাতকে উস্কে দেবার জন্য সরকারকে প্রশংসা দিচ্ছেন। লীগ হোক আর শিবির হোক আমার ভাই তো তারা। তাদের মধ্যে হানাহানিকে আপনি কেন ভাল চোখে দেখছেন। তুই তো ইতিহাস জানিসনা। তাই এসব বলছিস। মামার এই কথার প্রেক্ষিতে বললাম মামা বর্তমান যা দেখছি ইতিহাস কি আদৌ দেখার প্রয়োজন আছে আমার?? ইতিহাসের পুনারবৃত্তি হচ্ছে বারবার...

মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি নেক্সট জেনারেশান কে আমরা অনেক জিনিস উপহার দিতে পারব। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের আমরা সুন্দর সুন্দর ইতিহাসের কাহিনী শোনাতে পারব। ইনফ্যাক্ট যুগের পরিবর্তনে ততদিনে নিশ্চয় জ্বীন-ভূতের কাহিনী তাদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা হারাবে, তারা হয়ত দাদী-নানীর কোলে শুনে এসব শুনতে চাইবেনা। তখন তাদের কি বলে গল্প শোনাব...হয়ত গল্প হবে এরকম...

.....এক সময় ছিল ডিজিটাল যুগ। সেসময় যদি কেউ খুন হত তাহলে খুব রহস্যজনক ভাবে সেই খুনের কোন কিনারা পাওয়া যেতনা। হোটেলে রহস্যজনকভাবে কোন এক হতভাগ্য নারীর গলা কাটা লাশ পাওয়া যেত। রহস্যজনকভাবে কিছু খুন হত বিচ্ছিন্ন ঘটনা, আর কিছু খুন হত মহা গুরুত্বপূর্ণ। সেই খুনের দাবানল রহস্যজঙ্কভাবে পুরা দেশে ছড়িয়ে যেত। যদি কেউ কোন খুনের কিনারা করতে যেত তাহলে সে আরো রহস্যের অক্টোপাসে জড়িয়ে যেত। সেই ডিজিটাল যুগে ছিল শুধুই রহস্য আর রহস্য...জানিনা এই গল্প কতটুকু গ্রহণযোগ্য পাবে তার কাছে।চিন্তায় আছি...

ওয়েলকাম টু ঢাকা......রাত ২.৩০

কিছুটা নিদ্রা ভঙ্গের পর জেগে দেখি ঢাকায় চলে এসেছি। রাতের ঢাকাকে দেখতে অসাধারণ লাগছিল। কিন্তু আবার যান্ত্রিক জীবনে ফিরে যাচ্ছি এটা চিন্তা করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেই ক্যাম্পাস, সেই পড়াশুনা, সেই ব্যস্ততম দিন। আমার এক ফ্রেন্ডের সবসময় ইচ্ছা সে লাইফে শুধু একজন চিকিৎসকই হবেনা, সে মানবতার জন্য কাজ করবে। আরো অনেক স্বপ্ন তার। কিন্তু এখন তার চিন্তা শুধুই নিজেকে নিয়ে। কারণ সে নিজের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একজনকে ভালবাসে। সেই ভালবাসাই তার জী্বনের মটো চেইঞ্জ করে দিয়েছে। ভালবাসা কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সে এখন তার ফ্যামিলিকেও ত্যাগ করতে রাজি। আর মানবতা??? সে তো অপরিপক্ক আবেগের কথা। সবাই পারসোনাল সমস্যা নিয়ে এত বিজি, মানবতাকে নিয়ে চিন্তা করার টাইম কই? ক্যাম্পাসে আড্ডা, গল্প খুব বেশি ভাল লাগেনা। একই টপিকস নিয়ে ডিসকাসন ভাল লাগেনা। তারপরও সেই বিরক্তিকর ভুবনটাও মেইন্টেইন করতে হয় অনেক বেশি টাইম।
পরিবারের সান্নিধ্য খুব বেশি ভাল লাগে। এখনও দাদী-নানীর কোলে শুয়ে গল্প শুনতে ইচ্ছা করে। এই ভুবনে ইচ্ছা করলেও বেশি টাইম দেওয়া যায়না। ভার্চুয়াল জগতে পুরা বিশ্বের সাথে কানেকশান আমাকে গতিশীল রাখে। নিজের সত্তা আর বাইরের সত্তার সাথে মিলানোর চেষ্টা এই ভার্চুয়াল জগতে। এই ভুবনটাও আমার অনেক কাছের। কিন্তু এখানেও বেশিক্ষন থাকতে পারিনা। আর সম্পূর্ণ নিজের একটা ভুবন আছে যেখানে আমি সবকিছুতেই রাজা। স্বাধীনভাবে চিন্তা করি, কারো কোন হস্তক্ষেপ নাই। নিজের মত কল্পনা জগতে ঘুড়ি ওড়াতে পারি। ইচ্ছা করলেই পাখির মত আকাশে উড়ে যেতে পারি, কিংবা সবুজ মাঠ ধরে গ্রাম্য কিশোরীর মত দূর-বহুদূর হেটে যেতে পারি। কিংবা শরতের বিকালে সাদা মেঘের মত ভাসতে পারি, কিংবা সাগরের নীল ঢেউয়ে নিজেকে একাত্ব করতে পারি ডুবে যাওয়া রক্তিম সূর্যের সাথে...... কিন্তু ,কিন্তু এখানেও বেশি বিচরন করা যায়না। ব্যস্ততম জীবন কি দিল আমাকে! এক সত্তায় বহু ভুবনের জুগপৎ বসবাস...নিজেকে একটি কানেক্টিং স্টকের মত ভাবতে সাহায্য করছে। জগতের নিয়ম মনে হয় প্রতিনিয়ত নিজেকে শুধুই বহু ভুবনের সাথে কানেক্ট করে যাওয়া...


* ছবিতে ফারদিন ও তাশফিন।