শনিবার, ১১ জুলাই, ২০০৯


একটু চিন্তা করেন তো এমন একটি আদালত(কোন জনমানবহীন কুঠুরি নয়) যেখানে আপনার মা,আপনার বোন বা আপনারই স্ত্রী কে একজন ছুরিকাঘাতে হত্যা করছে...কেমন লাগবে এটা জেনে যদি আপনার সেই মা,বোন কিংবা স্ত্রী যদি হয় ৩ মাসের অন্তঃসত্তা?? কিন্তু ঠিক এরকমই একটা ঘটনা ঘটে গেল জার্মানিতে।৩২ বছর বয়সী এক মুসলিম মহিলাকে জীবন দিতে হল শুধুমাত্র হিজাবের কারনে।জানিনা তখন ২ বছর শিশু মুস্তফার কেমন লেগেছিল চোখের সামনে মাকে নির্মমভাবে নিহত হত দেখে।উফ! আমি চিন্তা করতেই পারছিনা।একেই কি বলে মানবতা! পাশ্চাত্য সমাজ যেখানে মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার,যারা দাবি করে তারাই মানবাধিকার রক্ষার দাবিদার তারা এটাকে কিভাবে বিশ্লেষন করবে??
ঘটনার সূত্রে জানা যায় সম্প্রতি জার্মানির ড্রেসডেন শহরের একটি আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে, এক মুসলিম বিদ্বেষীর হাতে নিহত হন ৩২ বছর বয়স্ক এক মিশরীয় যুবতী শেরবিনি। মৃত্যুর সময় তিনি ৩ মাসের অন্ত:সত্বা ছিলেন এবং রেখে গেলেন ২ বছরের ছেলে মুস্তাফাকে।

১৮ বার ছুরিকাঘাতে শেরবিনিকে নৃশংসভাবে যে হত্যা করে, সে মামলার আসামী স্বয়ং অ্যাক্সেল। রাশিয়ান বংশোদ্ভূত এক জার্মান নাগরিক। ছয় বছর ধরে সে জার্মানিতে আছে। আদালত কক্ষে বিচারকদের সামনেই হত্যা করে শেরবিনিকে।এখানেই শেষ নয়। শেরবিনির স্বামী আলবি আলি ওকাজ স্ত্রীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাঁকেও ৩ বার ছুরিকাঘাত করে অ্যাক্সেল। তদুপরি ঘাতক মনে করে আলবির পায়েই ভুল করে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০০৮ সালে,যখন আক্সেল শেরবিনিকে সন্ত্রাসী,ইসলামপন্থী বলে টিজ করে।শুধু তাই নয়,শেরবিনির হিজাব খুলে ফেলার চেষ্টা করে।শেরবিনি আক্সেলের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে।কিন্তু আক্সেলও ছাড়বার পাত্র নয়।তারই ফলশ্রুতুতে ১ লা জুলাই এই নৃশংস ঘটনার শিকার হতে হয় শেরবিনিকে।
ইতিহাস সাক্ষী,বিশ্বে কোন আদালতে শেরবিনির মত ঘটনার শিকার কেউ নেই।বিচারক,পুলিশের সামনে শেরবিনির এই মৃত্যু যেন সাক্ষী হয়ে গেল পশ্চিমাদের আসল চেহারার নগ্ন প্রতিচ্ছবি।কিন্তু মিডিয়া আজ এত নিরব কেন?মুসলিম দেশের কোথাও কোন ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিডিয়া সরব হয়ে যায়।ফলাও ভাবে প্রচার করা হয়।বছরের পর বছর টক অফ দা টাইমে থাকে মুসলিম বিদ্বেষী সংবাদ।ধিক্কার জানাই তোমাদের।ধিক্কার।

শেরবিনির কথা যখন লিখতেছি,তখন মনে পড়ে গেল পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার ন্যাক্কারজনক ঘটনার কথা।এই ঘটনা আর কোথাও নয়,বাংলাদেশের,আমার দেশের।যেখানে ৮০% এর বেশি মুসলমানের বসবাস।ঘটনা শুনলে মনে হবে না এটা আমার দেশের কোন ঘটনা।ফ্রান্স,ইউরোপ বা জার্মানি নয়।আমার দেশ,বাংলাদেশের ঘটনা।তিন জন বোরকা পরা নারীকে অপমানিত,লাঞ্চিত হতে হয় বখাটে যুবকদের নিকট।পরবর্তীতে জঙ্গি হিসাবে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে ওই বখাটেদের তথ্য অনুযায়ী।শুধু কি তাই? তাদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে,যেটা মুসলিম মেয়ের সবচেয়ে বড় যে আইডেন্টিটি ।ছিঃ ছিঃ ভাবতেই কষ্ট লাগতেছে আমি বাংলাদেশের মেয়ে।সরকারের নিরব ভূমিকা যেন প্রকাশ করছে ইসলামবিদ্বেষি মনোভাব।কি অপরাধে জেলে গেল তারা? তাদের কে সার্চ করে তো কিছুই পাওয়া যায়নি।তাহলে কি সরকার বলতে চায় ইসলাম শুধুমাত্র জঙ্গিদের প্রতিনিধিত্ব করতেছে?নাকি সরকারি দলের ওই বখাটেদের বাচাতে সরকারের ইসলামের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান? মুসলিম প্রধান এই দেশের হাজার হাজার,লক্ষ লক্ষ মেয়ে হিজাব পরে।তাহলে তো বলতেই হয় এদেশে হাজার হাজার,লক্ষ লক্ষ জঙ্গি ঘুরে বেড়াচ্ছে।বখাটেদের বাচাতে ডিজিটাল সরকারের এই উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়!!!!!!!!চায়না এই ডিজিটাল প্রতিচ্ছিবি,যেখানে মুসলিম হয়ে,হিজাব পরিধান করাকে জঙ্গি আক্ষ্যায়িত করা হয়।আর চায়না,চায়না...
সারাবিশ্বে শেরবিনিকে নিয়ে উত্তাল।কিন্তু আমি আমার দেশের এই লজ্জাজনক ঘটনা কিভাবে প্রকাশ করব? নিজেক খুব ছোট মনে হচ্ছে।খুব ইচ্ছা করছে মারওয়া আল-শেরবিনির মত সাহসী হতে।সে মরনেও মনে হয় এক অনন্ত সুখ আছে...!!





একটি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস সিন্ড্রোম......

আজকাল যখন রাস্তায় চলাফেরা করি তখন মাঝে মাঝে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা আমি কোথায় আছি?কোথায় যাচ্ছি? ইনফ্যাক্ট আমার চারপাশের পরিবেশ আমার কাছে প্রতিদিনই নতুন লাগে...পহেলা বৈশাখে কিছু কাজের জন্য বাইরে বের হলাম দেখি আমারই পাশের এক মডার্ন(প্রচলিত অর্থে) মেয়ে সুন্দর শাড়ি পরে,সেজে গুজে রিক্সা করে যাচ্ছে।অথচ তাকে আমি খুব কম দিনই দেখেছি ফতুয়া-জিন্স ছাড়া সে বাইরে বের হয়েছে।সেদিন খুব অবাক হলাম তাকে দেখার পর...বাসায় এসে একদিন বিকালে তার সাথে যখন কথা হচ্ছিল তখন আমি তাকে বললাম সেদিন তোমাকে শাড়িতে খুব দারুন মানিয়েছিল।সে বলল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সে ওই শাড়িটা রঙ থেকে কিনে এনেছে।আমিও যখন কিনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম তখন সে আমাকে বলল তুমি কিনে কি করবা? তুমি তো হিজাব ছাড়া বাইরে বের হউনা।তারপর আমাকে একটা পরমর্শ দিল যে একদিন বাঙ্গালী হিসাবে শাড়ি পরে বের হলে কিছু হবেনা।হাজার হোক এটা আমাদের বাঙ্গালী কালচার।বুঝতে পারছিলাম সে আমাকে একটু আন্ডারএস্টিমেট করার চেষ্টা করছে হিজাব নিয়ে।
বললাম আমি একজন বাঙ্গালী মুসলিম মেয়ে।তাই আমার নিজস্ব একটা কালচার আছে যেটা আমি সর্বদা মানার চেষ্টা করি।আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বলতে কি বুঝ তুমি? আইডেন্টিটি ক্রাইসিস?? খুব তাচ্ছিল্যভাবে জবাব তার।এই যে বছরের একদিন শাড়ি পরে বাংগালি হউয়া আর বাকি দিন পরগাছার মত অন্যের কালচারকে ধারন করা,আর সর্বদা নিজেকে বাংগালি বলে এক কৃত্তিম গর্ব অনুভব করাকে কি বলবা তুমি?নাহ! আমি আমার কথা আর এক্সটেন্ড করিনাই সেদিন...খুব বেশি তিক্ত শুনাচ্ছিল তার কাছে তাই দ্রুত সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম।
যেটা বলছিলাম আইডেন্টিটি ক্রাইসিস।রাস্তা-ঘাটে চলা ফেরা করলে বুঝতে পারি আমরা যে আইডেন্টিটি হারায়ছি ১৭৫৭ সালে তা আর ১৯৭১ এর মাধ্যমে ফেরত আনতে পারিনি।বাংগালি জাতির আইডেন্টিটি আজ কেবল অনুষ্ঠান স্বর্বস্ব ব্যাপারে পরিনত হয়েছে।আর মুসলিম?? হাঃহাঃ সে তো তথাকথিত বাংগালি জাতি একদিন পুরা ইসলাম কে বিক্রি করে দিয়েছে রাজাকারদের নিকট।তাই ইসলাম এর কথা বললেই যুদ্ধাপরাধী,হিজাবের কথা বললেই রাজাকার।এই তো বাংগালি জাতির আইডেন্টিটি।!অথচ ইসলাম নিছক ধর্ম নয়,বরং জীবনবিধান।আর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নয়।নিজেদের তৈরী আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে আজ নিজেরাই সাফার করতেছি।

এবার আসি আরেকটু ভিন্নভাবে।নারী সমাজের উন্নতিকল্পে আমাদের পুরুষ সমাজের চিন্তার কোন শেষ নাই।সাধুবাদ জানাই তাদের।আমাদের কথা তারা চিন্তা না করলে কে করবে? তাই নারী সমাজ কে তারা ঘরের আবদ্ধ গন্ডি থেকে বের করে নিয়ে আসল।উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুজোগ দিল।পর্দা প্রথাকে সেকেলে বলে ছুড়ে ফেলে দিল।আর সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর আবাধ বিচরনও নিশ্চিত করল।কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট কি? এখনও সিমির মত মেধাবী মেয়েকে জীবন দিতে হচ্ছে,তৃষার মত নিষ্পাপ মেয়েকে অকালে ঝরে যেতে হচ্ছে...এরকম হাজার ঘটনা অহরহ ঘটছে।আর কত???

সেই আবহমান কাল থেকে নারী সমাজ উপেক্ষিত,নির্যাতিত,বঞ্চিত।আগে নারী উপেক্ষিত হত নিজের ঘরে।আজ হয় সমাজে...নারীমুক্তির আন্দোলন কি আসলেই কোন সুফল বয়ে আনছে? নাহ! আমি একজন নারী,তাই নারী মুক্তিই আমার কাম্য।কিন্তু মুক্তি পাবার জন্য আমি আমার আইডেন্টিটি হারাতে চায়না।খারাপ লাগে যখন দেখি আমারি মত মেয়ে সংসার করা,ছেলে-মেয়ে লালন-পালন করা কে ঘৃনার চোখে দেখে।নারী অধিকার আদায় করতে গিয়ে আমরা আমাদের মর্যাদা হতে বঞ্চিত হচ্ছিনা তো? হ্যা আমরা না পারছি প্রকৃতির অমোঘ বিধানকে ইগনোর করতে আর না পারছি প্রকৃ্তির দেয়া বিধানকে মেনে নিতে...তারপরও অনন্তর চেষ্টা একটু মুক্তির আশা।আজ এখানে সেমিনার,কাল সেখানে আলোচনা।কিসের জন্য? নারী স্বাধীনতার জন্য।

অথচ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোন সেমিনার হয়না,আলোচনা হয়না।যে পুরুষ ঘরে নারীর সম্মান দিতে জানেনা,সে কিভাবে কর্মক্ষেত্রে অন্য নারীকে সম্মান দিবে?অথচ এই সব পুরুষের লোকদেখানো নারী মুক্তির আন্দোলনে আজ মেয়েরাই এদের সাথে হাত মেলাচ্ছে।ফলে সমাজে আবির্ভুত হচ্ছে নিত্য নতুন নীল ভ্রমরার যারা নারীকে এক নতুন মুক্তির স্বপ্ন দেখাচ্ছে।নারী হচ্ছে আরো বেশি উপেক্ষিত,লাঞ্চিত,বঞ্চিত।

নারী হিসাবে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করি।তাই একটু খানি মুক্তির আশায় রনাংগনে ঝাপিয়ে পড়ি।ইসলাম নারীকে যে মুক্তি সেই শত শত বছর পূর্বে দিয়ে গেছে তা ভুলে আমরা আজ খুজতেছি নতুন মুক্তির ঠিকানা।হিজাব ছেড়েছি,প্রগতিশিল হয়েছি,উচ্চশিক্ষিত হয়েছি,পুরুষের সহকর্মী হয়েছি...পাইনি স্বাধীনতা।আমি শিক্ষার বিপক্ষে নই,বাইরে চাকরী করে পুরুষের সহকর্মী হবার বিপক্ষেও নই।আমি নিজেকে একজন মুসলিম বাংগালি মেয়ে হিসাবে মনে করতে ভালবাসি।তাই আজীবন বাঙ্গালী।কেবল আচার স্বর্বস্ব বাঙ্গালি নই।আমি মুসলিম তাই হিজাব আমার স্বাধীনতার প্রতীক।আমি নারী তাই একটা সংসার এর প্রধান দায়িত্ব আমার।যে ঘরে থেকে বিশ্ব পরিচালনায় অংশ গ্রহন করবে,জন্ম দিবে হাজার হাজার সেই বলিষ্ঠ সন্তানদের যারা বুকের তাজা খুন বিলিয়ে দিবে মানবতার তরে,দেশের তরে,পৃথিবীর তরে।আর আমাদের শিক্ষা? সেটা তো আমাদের মৌলিক অধিকার।তাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হব,নিজেদের মর্যাদা আদায় করে নিব।

তাই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আর নয়।আমরা নারীরা প্রকৃত বাঙ্গালি হতে চাই।হতে চাই একজন আদর্শ নারী।আর ধারন করতে চাই ইসলামীক জীবনবিধান।আইডেন্টিটি ক্রাইসিস সিন্ড্রোম এর সমাধান চাই এভাবেই...


লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ;