শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০০৯

শুধুই ভালবাসা...


ভালবাসা শব্দটার মানে কি? প্রশ্ন করেছিলাম খুব কাছের কিছু বন্ধুদের। ভালবাসা মানে ফিলিংস,অপ্রকাশ্য অনুভুতি। কেউ বলে ভালবাসা সীমাহীন তাই একে ডিফাইন করা যাবেনা এক শব্দে। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসা বুঝতে হলে তোকে প্রেম করতে হবে। ফিলিংস কি কখনও শেয়ার করা যায়? এটা হচ্ছে উপলব্ধির ব্যাপার। আর সেই উপলব্ধি তখনি আসবে যখন তুই প্রেমে পড়বি। এভাবে অনেকভাবে তারা আমাকে ভালবাসার মানে বোঝাতে চেষ্টা করে।
খুব ভাল লাগে যখন দেখি এই ভালবাসার জন্য কেউ তার ফ্যামিলি ত্যাগ করে, বন্ধুদের ত্যাগ করে। ভাললাগে এই কারনে যে ভালবাসার শক্তি আসলে অপরিসীম। তা না হলে সবচেয়ে কাছের মানুষদের কিভাবে ত্যাগ করা যায় শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষনে? এই ভালবাসা নিয়ে আছে ভালবাসা দিবস। প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এই দিবসের গুরুত্ব ভয়াবহ। আর যারা ভালবাসা কনসেপ্টকে পছন্দ করেনা তাদের নিকট ভালবাসা দিবস শুধুমাত্রই বানিজ্যিক,বাহ্যিক। আমি অবশ্য এই দুই দলের কোনটার মধ্যেই পড়িনা। কারন ভালবাসা ব্যাপারটা আমার কাছে খুব একটা খারাপ লাগেনা। এই কারনে ভালবাসা দিবসের মানে আমি এই বুঝিনা যে শুধু এই দিন ভালবাসার দিন,বাকি দিন নয়। আসলে দিনটা একটা উপলক্ষ্য, তবে এই উপলক্ষ্যের কার্যাবলী সারাবছর ব্যাপি থাকবে,এটাই স্বাভাবিক। তাই ভালবাসা দিবসকে আমি বাকা চোখে নেইনা। যদিও ভালবাসা দিবসের শুরুর কাহিনী আমাকে ইন্সপায়ার করেনা ভালবাসার জন্য বাট ভালবাসা আমাকে ইন্সপায়ার করে ভাল কিছু করার জন্য।
প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসা আমার কাছে কিছুটা আজব মনে হয়। একজনের প্রতি ভাললাগা আসতেই পারে কিন্তু তার জন্য আমার সারাটা দিন ব্যয় করা, তার সাথে ভালবাসার ফিলিংস শেয়ার করা, রাত জেগে মোবাইলে কথা বলা,ছুটির দিনে ঘুরতে বের হওয়া ইত্যাদি এসব কনসেপ্ট আমার ভাল লাগেনা। সবচেয়ে যে ব্যাপারটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন তা হল অন্যের প্রতি আমার ফিলিংস কিভাবে আসতেছে? আমি কি তার ক্যারিয়ার ,স্মার্টনেস, আউটলুক দেখে ভালবাসার প্রতি ইন্সপায়ার হচ্ছি? নাকি অন্য কিছু? যদিও যারা প্রেম করে তাদের কাছে এই প্রশ্ন করলে তারা বলে , ওর মনটা অনেক ভাল,তাই ওকে আমি অনেক ভালবাসি। কিন্তু তাদের প্রেমে পড়ার কাহিনী শুনলে দেখে যায় তারা কখনও মন দেখে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। তাদের প্রেমে পড়ার ইতিহাস থেকে দেখা যায় কেউ কোন অনুষ্ঠানে গিয়েছে সেখানে প্রথম দেখাতেই প্রেম। কিংবা একি সাথে লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করে সেই থেকেই প্রেম। কিংবা আননোন মোবাইল থেকে ম্যাসেজ/ভয়েস শুনে প্রেম।

এভাবেই বেসিক্যালি আজকের যুগে ভালবাসা শুরু হয়। সেখানে দুইজন মানুষের আদর্শিক মিল খুব কমই হয়। তাই প্রেমিক-প্রেমিকার মন কষা-কষি লেগেই থাকে। পরে অবশ্য তারা বলে যে এই মন কষা-কষি নাকি তাদের ভালবাসার ফিলিংস আরো বাড়িয়ে দেয়। একজন আমাকে খুব আফসোস করে বলতেছিল যে তার জিন্স ও ফতুয়া পরার খুব শখ কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড এটা খুব অপছন্দ করে। তাই সে পরতে পারেনা। আমি তাকে সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোমার এমন আর কি কি শখ আছে যা তোমার বয়ফ্রেন্ড অপছন্দ করে? সে বলল অনেক কিছুই। এই যেমন আমি খুব ভাল গান পারি বাট আমার বয়ফ্রেন্ড চায়না যে আমি কোন প্রোগ্রামে গান করি। এরকম আরো বহু কিছু। তখন তাকে বললাম তাহলে কেন তুমি তাকে ভালবাস যে তোমার পছন্দের কোন মূল্য দেয়না? সে খুব সহজ সরলভাবে বলল ‘আসলে জান ও আমাকে অনেক ভালবাসে তাই ও চায়না যে আমি খুব বেশি এক্সপোসড হই।‘’ তোমার কি মনে হয় এতে কি তুমি নিজেকে বেশি এক্সপোসড করতে চাও? আরে কি যে বল! আমি তো শুধু চাই আমার শখ পূরন করতে অন্য কিছুনা। ওর খুব দ্রুত জবাব। তাহলে কেন তুমি শুধুমাত্র তোমার বয়ফ্রেন্ড এর জন্য তুমি এসব মেনে নিচ্ছ? কারন আমি যে তাকে অনেক ভালবাসি তাই। ভালবাসার মানুষের জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করা যায়,তুমি এসব বুঝবানা…..আমি আর বুঝতেও চাইনা।
প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে আইডিওলজিক্যাল কনসেপ্ট এর মিল খুব একটা গুরুত্ব বহন করেনা। তাই তো তারা একে অন্যের জন্য নিজের সব শখ,ভাললাগাকে বিসর্জন করতে পারে অনায়াসেই। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম নাও হতে পারত। হতে পারত ভালবাসার জন্য নিজের কোন কিছু বিসর্জন করা লাগবেনা বরং সেটাকে গ্রো করার জন্য একে অপরের সহযোগীতার হাত প্রসারিত হবে। তাহলে কেন এই সংকীর্ণতা?
বিশ্বাস। হ্যা বিশ্বাসের অভাব। আজকাল ভালবাসার মধ্যে কোন বিশ্বাস নাই। তাই তো একে অপরের প্রতি সন্দিহান সর্বদা। কোথায় গেল,কি করল, কার সাথে মোবাইলে কথা বলল, কার সাথে কলেজে মেলামেশা করে ইত্যাদি হাজারো রকম সন্দেহ।
যদি বিশ্বাস অর্জন না করা যায় তাহলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা আসেনা। তাই আজকাল ভালবাসা খুব সংকীর্ন হয়ে গেছে। ভালবাসা মানেই কেবল ঘোরাঘুরি,রাত জেগে কথা,চ্যাটিং,সন্দেহ আর মন কষা-কষি। এই সার্কেলেই চলছে বর্তমান ভালবাসা। খুব অবাক হই এক্ষেত্রে চিন্তার ম্যাচিউরিটি খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে। ম্যাচিউরিটি আজকাল শুধু বয়স দ্বারা হিসাব করা হয়। ছেলে-মেয়েরা চিন্তা করে তারা এখন বড় হয়েছে, যথেষ্ট মাচিউরড সো তারা ভালবাসতেই পারে!
সত্যি কথা বলতে কি চিন্তার ম্যাচিউরিটি ধর্মীর অনুশাসন ছাড়া পূর্ণতা পায়না। এতে অনেকেই আমার সাথে আপত্তি জানাতে পারে। কিন্তু আমি দেখেছি খুব সচেতন মানুষ যে মৌলিক গুনাবলি সম্পন্ন তার সচেনতা অনেক সময় তার পরিবার,তার আত্মীয়,বন্ধুদের জন্য কোন উপকার আনেনা। বরং সেই মানুষও কোন এক সময় এমন ভুল করে যা তার দ্বারা অসম্ভব ছিল। মানুষ ভুলের ঊর্দ্ধে নয় কিন্তু এই ভুল তার অপুর্ণ ম্যাচিউরিটির সাক্ষ্য বহন করে।
বলছিলাম ধর্মীয় অনুশাসনের কথা। আমার খুব কাছের একজন বান্ধবি এক হিন্দু ছেলের প্রেমে পড়ে। প্রেম তো প্রেম একেবারে মহামারি অবস্থা। কেউ কাউকে ছাড়া বাচবেনা। ফ্যামিলি থেকে যখন ব্যাপারটা জানাজানি হল তখন আমার ফ্রেন্ড এর মা বলল যে আমি যেন ওকে খুব ভালভাবে ইসলামের গুরুত্ব বুঝিয়ে ওই হিন্দু ছেলের কাছ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনি। এখন কেন তাকে আমি ইসলামের গুরুত্ব আলাদাভাবে বুঝাব? যে ফ্যামিলি থেকে কখনও ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্বসহকারে দেওয়া হয়নি তারাই কোন এক সময় ধর্মের আশ্রয় নিয়ে সমাজে নিজের প্রেস্টিজ রক্ষা করতে উঠে পড়ে লাগে। তারপর আর কি! খুব দ্রুত মেয়ের ফ্যামিলি থেকে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
আজকাল ছেলে-মেয়েদের অবসর সময় কাটে লাভারের সাথে গল্প করে,আড্ডা দিয়ে। ভালবাসার মানে যে কেবল এগুলো নয় এটা তাদের চিন্তায় ঢুকেনা। এফ.এম রেডিও শুনলে দেখা যায় ইয়াং জেনেরেশান এর খুব কঠিন সমস্যা হচ্ছে এসব এফেয়ার জনিত সমস্যা। অথচ এখনও পৃথিবীতে মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে, প্রতিদিন হাসপাতালে মানুষ মৃত্যু যন্ত্রনায় কষ্ট পাচ্ছে, কেউবা অভাবের তাড়নায় খারাপ পথে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, কত ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশু হাতে বই-খাতার বদলে ফুল নিয়ে রাস্তায় বিক্রি করতে পথে নামছে এসব সমস্যা যেন তাদের ভালবাসার সমস্যার কাছে কিছুই না। তাদের ভালবাসার ভাগিদার কেবল বয়/গার্লফ্রেন্ড। ভালবাসার মানুষের সাথে গল্প করার বিষয় কেবল কখন কি করল, কি দিয়ে খাইল, কে কাকে কতটুকু ভালবাসে ইত্যাদি।
কেন একটু ভালবাসা কি আমরা সেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য রাখতে পারিনা? আমরা কি পারিনা ভালবাসা দিবসে তাদের সাথে আমাদের ভালবাসা শেয়ার করতে? সংকীর্ণ ভালবাসাকে আকাশের মত উদার করতে আমরা কেন এত কার্পণ্য করি? কেন আমরা আদর্শিক কনসেপ্ট এর মিল না খুজে শুধুমাত্র আউটলুক দেখে অন্যের প্রতি ভালবাসায় ইন্সপায়ারড হই?
আদর্শিক কনসেপ্ট এর মিল থাকলে ভালবাসার মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়,একে অন্যের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ডেভেলপ করে। একটা নির্দিষ্ট আইডিওলজিকে এস্টাবলিস করতে দুইজনের আপ্রান চেষ্টা ভালবাসার গভীরতা আরো বাড়িয়ে দেয়।
আমার ফ্রেন্ড আমাকে প্রায় বলে আমার মধ্যে নাকি এক ধরনের ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে ভালবাসার বিরুদ্ধে। আমি সো কলড বর্তমান যুগের ছেলে-মেয়েদের ভালবাসাকে খুব অপছন্দ করি। তাদের ভালবাসা দিবসে নিছক ফুল দিয়ে ভালবাসা উদযাপনকে খুব ঘৃণা করি। ভালবাসার নামে অনর্থক অপব্যয়কে ভালবাসার অবমূল্যায়ন মনে করি। তাই এর বিরুদ্ধে এক ধরনের ইমিউনিটি আমার সত্যি সত্যি তৈরি হয়েছে। কারো প্রেমে পড়িনি কিন্তু তাই বলে ভালবাসার মূল্যায়ন যে কেবল প্রেমিক-প্রেমিকারাই করতে পারে এটা বিশ্বাস করিনা।
বিয়ের আগে প্রেমকে আমি কখনই সাপোর্ট করিনা। সেক্ষেত্রে আমার লজিক হচ্ছে আমি কেন এমন কারো সাথে আমার ফিলিংস শেয়ার করব যে সেই ফিলিংস শেয়ার করার অধিকার রাখেনা? আমার ফিলিংস তো এত সস্তা না যে শুধুমাত্র বিশ্বাস দিয়ে হ্রদয় সংযোগ ঘটাব? আর তারপরে ভালবাসার সাগরে হাবুডুবু খাব। হা..হা..


মানুষের মৌলিক গুনাবলিকে সুন্দর একটা শেইপ এনে দেয় ধর্মীয় অনুশাসন। কারন ভালবাসার ফিলিংস এই মৌলিক গুনাবলি সবার মধ্যেই থাকে কিন্তু সেই ফিলিংসটা কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া পূর্ণতা পায়না। যদি আমাদের ভালবাসা হত সমাজের নিরীহ,সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি তাহলে চিন্তা করে দেখুনতো এই ভালবাসা হত বিরাট এক শক্তি যা পারমানবিক শক্তিকেও হার মানাত।ডিজিটাল সমাজের ভিত্তি হতে পারত এই ভালবাসা। অথচ আজ সমাজে ভালবাসাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার তরুনি আত্বহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে,কেউ মাদকাসক্ত হচ্ছে, কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু ভালবাসা তো শুধুই সৃষ্টির জন্য ধংসের জন্য না! কে তাদের শিখাল যে ভালবাসা কেবল ছেলে-মেয়ের মধ্যেই হতে পারে? কারা সমাজের তরুন প্রজন্মকে ভালবাসার ভুল অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে ধীরে ধীরে চিন্তাশূন্য করে গড়ে তুলতেছে?

বিশ্বাসহীন,একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধশুণ্য ভালবাসার শক্তি আজ সমাজে তাই চরম বিভিষিকা। এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি ? প্রয়োজন আমাদের চিন্তাশক্তির ম্যাচিউরিটি,প্রয়োজন ভালবাসার সঠিক ক্ষেত্র উপলব্ধি তার সাথে সাথে এসবকে সুন্দরভাবে শেইপ করার জন্য দরকার ধর্মীয় অনুশাসন যা সর্বদা চার্জের মত কাজ করে। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিনিয়ত প্রাক্টিক্যাল চার্জ ভালবাসাকে নিয়ে যায় সুন্দর কোন প্রান্তে যা কখনও বিভিষিকা ছড়ায়না......