শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০

আমার স্টুডেন্ট !

টেনশনে আছি রুহিত কে নিয়ে। রুহিত আমার স্টুডেন্ট। উহু, শুধু আমার না। আমার ভাইয়েরও। দুজনই পার্ট টাইম পড়ায় ওকে। যখন আমার পরীক্ষা থাকে তখন আমার ভাই আর আমার ভাইয়ের যখন অন্য কাজ থাকে তখন আমি। এভাবেই চলছে আজ চার মাস। আসলে বাড়িওয়ালা আন্টির সাথে এরকমই কথা হয়েছিল যে আমি বিজি থাকলে আমার ভাই পড়াবে। তো সেভাবেই চলছে...
এই পর্যন্ত খুব বেশি যে স্টুডেন্ট পড়িয়েছি তা না। তবে যাদের পড়িয়েছি তাদের থেকে রুহিত আলাদা। কি রকম আলাদা?
যদিও আমি শুধু ম্যাথ আর বিজ্ঞান পড়াই তারপরও আমি মাঝে মাঝে রুহিতের সাথে গল্প করার জন্য অন্য সাবজেক্টের আলোচনাও করি। একদিন রুহিতকে বললাম,
- আচ্ছা রুহিত, হাজার বছর ধরে উপন্যাস কেমন লাগে তোমার?
- ভালই তো লাগে, আপু।
- একটু বলবা হাজার বছর ধরে উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনী?
- (কিছুক্ষন চুপ থেকে শুরু করল) মকবুল বুড়া খুব খারাপ একটা লোক। একদিন করল কি জানেন আপু?
- কি করল?
- সে রাতে তার বৌ দের দিয়ে সবার অগোচরে অনেক অনেক কষ্টের কাজ করাল যা কিনা কেবল গরুই করতে পারে, মানুষ না।
- আচ্ছা, কাহিনী টা আমি জানতে চাইছি...
- এটাই তো কাহিনী!
- হুম, বুঝেছি। তাহলে আমাকে একটু বলতো হাজার বছর ধরে উপন্যাসের সামারি কি?
- আমি আসলে আপু বুঝতেছিনা কিভাবে মানুষ হাজার বছর বেচে থাকে? এই নাম দেয়ার মানে বুঝতেছিনা, তাই সামারি আমার ব্রেইনে আসতেছেনা।
- ওকে বলা লাগবেনা। তুমি পরের ম্যাথটা কর।

এই হচ্ছে রুহিত। যে কোন উপন্যাস বা গল্পের কাহিনী বা সামারি বলতে বললে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কাহিনী শেষ করে। গত রোজার ঈদের পরে রুহিত কে বললাম
- তোমার দেখা সবচেয়ে প্রিয় মুভি কোনটি?
- আমি তো মুভি দেখেছি একটা। ভালই লেগেছে
- মাত্র একটা?
- জি। কারণ পড়ার চাপে আমি মুভি দেখার টাইম পাইনা।
- আচ্ছা, কোন মুভি দেখেছ?
- থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
- হুম। এই মুভির কাহিনী কি?
- এত বড় কাহিনী কিভাবে বলি!
- না না, সংক্ষিপ্ত করে বললেও হবে।
- আচ্ছা। একদিন রুবা সন্ধায় তার স্বামীর সাথে হাটছিল। হঠাৎ পুলিশ ওদের ধরে থানায় নিয়ে গেল। এরপর ওদের বহু প্রশ্ন করতে লাগল। এরকম করে কাহিনি এগিয়ে যায়...
- আচ্ছা বুঝেছি। মুভিটার সামারি কি?
- মুভিটার সামারি তার নামের মধ্যেই আছে। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। মানুষ হচ্ছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। তাই তার আরো মানুষ দরকার যেন সে প্লুরাল হতে পারে। হাজার হলেও মানুষ হচ্ছে সামাজিক জীব।
- গুড। দারুন বলেছ তো!

আমার পরে যখন একদিন আমার ভাই পড়াতে গেল সেতো রীতিমত বিরক্ত। মেজাজ খারাপ করে সে আমাকে বলল “ আচ্ছা তুই রুহিতকে পড়াস কি করে? আজকে ওকে আমি চার ঘণ্টা ধরে সাইন থিটা=লম্ব/ অতিভুজ, কস থিটা= ভূমি/অতিভূজ পড়ালাম। অথচ সে বার বারই ভুল লিখে যাচ্ছে। ধ্যাৎ আজকে আমার সারাদিন নষ্ট ওর জন্য।“
আমার ভাইকে বললাম, “ রুহিত হচ্ছে যান্ত্রিক টাইপ বুঝেছিস। তুই ওকে সাইন থিটা, কস থিটা ২০ বার করে মোট ৪০ বার লেখা। দেখবি পরে ঠিক হয়ে যাবে। কারণ বার বার লিখতে লিখতে সেটা ওর ব্রেইনে সেট হয়ে যাবে।“ সত্যি সত্যি আমার ভাই ওকে ২০ বার করে মোট ৪০বার লেখানোর পর রুহিত ঠিকভাবে বলতে পারে।
যাইহোক ইদানিং আমি রুহিত কে নিয়ে খুব বেশি টেনশনে আছি। ২০১১ তে ওর এসএসসি পরীক্ষা। ম্যাথ ওকে রিভাইস করাচ্ছি। রুহিতের আরেকজন টিচার আছে যে ম্যাথ ও বিজ্ঞান ঠিকমত পড়া হচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করে। সেই টিচার রিভাইস করা ম্যাথ থেকে ওকে আটটা অংক করতে দিয়েছে সেদিন, রুহিত ৩ঘণ্টা পর একটা অংক মিলাতে পেরেছে। সেই খাতা পরে দেখে আমার তো মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা। আমি রুহিত কে এবার বললাম
- রুহিত, তোমার এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে কি টেনশন হয়?
- জি আপু হয়।
- তাহলে পড়াশুনা বাদ দিয়ে টেনশান কর।
- মানে?
- মানে হল, তুমি যখন টেনশান কর তখন তোমার ব্রেইনের যে পার্ট পড়াশুনা মেইন্টেইন করে সেটা ব্লক হয়ে যায়। তাই তুমি যদি সত্যি সত্যি পরীক্ষায় পাশ করতে চাও তাহলে টেনশান বাদ দিয়ে পড়াশুনা কর।
- আপু, আমার মনে হচ্ছে আমি ছিটকে পড়ে যাব।
- হুম, যাবা তো! কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তুমি তো সর্বোচ্চ ফেইল করবা। তাহলে টেনশান কিসের?
- ফেইল করলে তো আমি পানিতে ডুবে যাব।
- মানে?
- মানে পরীক্ষা হল পানির মত। পাশ করতে না পারলে সেই পানিতে আমি ডুবে যাব।
- হুম। তো কি হয়েছে? তোমাকে সেই পানি থেকে উঠিয়ে সাতার শেখাব। তারপর আবার পরের বছর তোমাকে পানিতে নামিয়ে দিব। তখন ডুবে যাবানা। তাহলে টেনশান কিসের???
- একবার যদি ডুবে যায়, তাহলে কি আর আমি পানি থেকে উঠতে পারব?
- আচ্ছা, রুহিত আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে...
- ঠিক আছে আপু, আপনি টেনশান কইরেননা। আমি দেখি কি করা যায়...

উফ! বাসায় এসে মনে হল, ছেড়ে দে মা কেন্দে বাচি টাইপ অবস্থা। আহারে! ওর জন্য খুব খারাপও লাগে আবার। পাশ করতে পারলেই ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে মাথায় করে রাখবে। কিন্তু সেই পাসই ওর জন্য ভয়াবহ কঠিন ব্যাপার। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আমি অপেক্ষা করছি। রুহিত যদি পাশ করে তাহলে আমি যতটা খুশি হব তা মনে হয় আমার নিজের পরীক্ষার ভাল রেজাল্টের জন্য তত খুশি হবনা………

একটু খানি জীবন চাই...!!

হাতের মুঠো ফোনের দিকে যখন তাকায় তখন খুউব অবাক হয়ে যাই। কি এক আজব জিনিস যা আমাকে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে নিয়ে যায় নিমেষেই। প্রতি মুহূর্তে প্রিয়জনের সাথে ইচ্ছা হলেই যোগাযোগ করতে পারি। অপেক্ষা করতে হয়না একটুও। অন্তর্জালের মোহনীয় শক্তিতে ইচ্ছা হলেই মনের কথা অন্যের কাছে পৌছে দিতে পারি। তাই ডাকপিয়নের অপেক্ষায় আজ কারো প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে হয়না। কিন্তু আজ খুব অপেক্ষা করতে ইচ্ছা হচ্ছে কারো হাতে লেখা চিঠি পেতে। যে চিঠির পরতে পরতে হাতের লেখার সাথে আবেগের উঠা-নামা অনুভব করতে পারব। মনের যত আকুলতা সেটাকে নিজের মনের আকুলতার সাথে একাকার করে ফেলতে পারব। ছোটবেলায় খালামনিকে একবার চিঠি লিখেছিলাম। চিঠির শেষে নিজের হাতের একটা ছাপ দিয়ে ছবিও একে দিয়েছিলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করেছিল কেন এই ছবি আকা? শিশুসুলভ মন নিয়ে বলেছিলাম যে হাত দিয়ে খালামনিকে চিঠি লিখছি সেই হাতের ছবিও নিশ্চয় খালামনির দেখতে মন চাইবে, তাই এই ছবি আকা। এখন সেই স্মৃতি রোমন্থন করলে খুব হাসি পায়, কি হাস্যকর রকম মানসিকতা ছিল তখন। কিন্তু আজ আমি শিশুসুলভ সেই মানসিকতাকে খুব বেশি অনুভব করছি, খুব মিস করছি। আমাকে কেউ হয়তবা কখনও হাতে লিখে চিঠি পাঠাবেনা। তাই কারো আবেগ,ভালবাসা ও স্নেহের উষ্ণতা আমাকে আর শিহরিত করবেনা। যান্ত্রিকতার এই যুগে সবকিছু হাতের মুঠোয় থাকা সত্ত্বেও আমি আজও খুজে ফিরি বারবার আদিম সেই প্রাচীন সম্পর্ক যা বার বার আবেগে আমাকে প্রকম্পিত করবে।

নস্টালজিক আমি কখনই সেরকম ছিলামনা। হতেও চাইনি। দৃষ্টিতে শুধু ভবিষ্যত দেখি। অতীত আমাকে প্রেরণা যোগায় কিন্তু কখনও অতীতে ফিরে যেতে চাইনি। অতীতের দুঃখ বর্তমানে আমাকে ব্যথিত করেনা, বরং ভবিষ্যতের জন্য পাথেয় যোগায়। কিন্তু তাহলে আজ কেন বার বার ব্যতিক্রম হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে যাবার পথে হাইওয়ের পাশে সবুজের মাঝে ছোট ছোট ঘর,পাশে বয়ে যাওয়া নদী,মাথার উপর অন্তিম আকাশ আর রাতের বেলায় ঘরের উঠোনে বসে জ্যোৎস্না স্নান করতে আজ খুব মন চাইছে। হোক না সাদা-মাটা জীবন তাতে কি! সেখানে আর কিছু না থাকুক অন্তত পরস্পরের প্রতি ভালবাসার কোন অভাব থাকতনা। ঠিক কবির মত আজ আমারও বলতে ইচ্ছা করছে ভালবাসাহীন হাজার বছর আমি চাইনা। চাই একটুখানি জীবন কিন্তু ভালবাসা, মায়া-মমতা,স্নেহের আবেগে পরিপূর্ণ এক সুন্দর পৃথিবী।

পৃথিবী আজ আমার ভাল লাগেনা। ভাল লাগেনা অপরের সাথে শুধুই যান্ত্রিক কোন সম্পর্ক। না, কোন অভিমানে নয় চরম বাস্তবতায় আজ আর আমার সত্যি পৃথিবী ভাল লাগেনা। এখানে কি আছে? হয়তবা হাতের মুঠোয় আমার পুরা পৃথিবী আছে কিন্তু কি লাভ সেই পৃথিবী দিয়ে? যেখানে মায়ের পরকীয়ার বলি হয় ভালবাসার সন্তানের। নিজ অস্তিত্ব কি আজ হুমকির সম্মুখিন? দশ মাস দশ দিন সুগভীর নিরাপত্তার মধ্যে থেকে শিশুটি যখন নিরাপত্তাহীন পৃথিবীতে পদার্পন করে তখন তার একমাত্র নিরাপত্তা তার মা। সেই নিরাপত্তার স্থানও আজ নিরাপত্তাবিহীন। এরকম পরকীয়ার বলি কেবল একজন নয়, হয়ত আরো বেশি। ভবিষ্যতে কি হবে ভাবতে ভয় পাচ্ছি...

প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার গভীরতাও আজ আর নেই। থাকবে কি করে? এখন বয়ফ্রেন্ড কিংবা গার্লফ্রেন্ড থাকা একটা স্ট্যাটাস। তাই ভালবেসে বিয়ে করে অতি দ্রুত বিচ্ছেদ হওয়া যেন অতি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। ঠিক কোথায় যেন আমরা সবাই ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছি। যেখানে আমাদের ভালবাসা, বিশ্বাস, আস্থা সব হারিয়ে যাচ্ছে। জীবনে দুঃখ আসবে, দুর্দশা আসবে, বাধা আসবে, বিপত্তি আসবে কিন্তু তাতে কি? কারো ভালবাসার টানে, কারো আস্থার প্রতি আস্থা রেখে সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাব। নাহ! আজ সেই প্রেরণাও নাই। কারো প্রতি আজ আর আস্থা রাখতে পারিনা।

সন্তানের হাতে বাবা খুন কিংবা বাবার হাতে সন্তান খুন, এটা তো নিছক একটা দুঃসংবাদ এখন। পত্রিকার হাজারো দুঃসংবাদের মধ্যে এই দুঃসংবাদ এখন নিয়মিত প্রকাশিত হয়। শুধু এই নয়, আরো আছে। দুঃসংবাদের প্রকারভেদ শুনতে চান? প্রতিনিয়ত কোন না কোন মেয়েকে আত্বহত্যা করতে হচ্ছে ইভটিজিং এর কারণে। আজকাল কোন ছেলে আর মেয়েদের বোন হিসেবে সম্মান জানায়না। হয়ত বোনরাও আজকাল ভাইদের ভাই হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেনা। সবই সম্ভাবনা...কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পাচ্ছি চারপাশ থেকে ভালবাসা, বিশ্বাস আর আস্থা রা হারিয়ে যাচ্ছে।

পত্রিকার পাতা উল্টায়না আজকাল। বাতাসেই খবর যেভাবে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তাতে আর পত্রিকার পাতা পড়া লাগেনা। তবুও মাঝে মাঝে একটু খুজে ফিরি, কোন ভাল কিছু পাওয়া যায় কিনা! একটু ভালবাসার ছিটেফোটা দেখা যায় কিনা! বার বার হতাশ হই। বার বার চোখের মাঝে ভাসে আবু বকরের মত নিরীহ কোন ছেলে কিংবা দেশের হাজার হাজার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষারত সেইসব ভাইদের কথা যাদের মনে কতইনা স্বপ্ন ছিল দেশকে কিছু দেবার, দশের জন্য কিছু করার। ভালবাসাহীন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তাদের থাকতে দেয়নি। আমি কোন রাজনীতি করিনা, চাইনা কোন ক্ষমতা, করিনা কোন দল, করিনা কারো পক্ষপাতিত্ব। শুধু একটুখানি ভালবাসা চাই, ভালবাসায় পরিপূর্ণ একটা ছোট পৃথিবী চাই। দরকার নেই মুঠো ফোন কিংবা অন্তর্জালের মত কোন যাদুকরি জিনিস। সেই পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায়, যেখানে আর কিছু না থাকুক মায়ের ভালবাসার মত অটুট আস্থা মাথার উপর সর্বক্ষন থাকবে অন্তত।

উন্নয়নের দিক থেকে আজো আমরা পিছিয়ে আছি। তাই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসার জন্য পরিবর্তন হয় সরকার, আমরা স্বপ্ন দেখি। হয়ত এবার আমরা কিছু একটা পাব, আর কিছু না হোক অন্তত বিশ্বাস আর ভালবাসা। কিন্তু হতাশ ও পিপাসার্ত মন বার বার হতাশ হয়, পিপাসায় গলা শুকিয়ে যায়। মনের পিপাসা মেটানোর জন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে পাশে পাইনা। প্রধাণমন্ত্রী নাকি একটা গণতান্ত্রিক দেশের জন্য অভিভাবক, সেটাই জানতাম সব সময়। কিন্তু কই? প্রতিবারই কোন নৃশংস ঘটনার জন্য একটা নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠন কিংবা বিরোধী দল বারবার আমাদের অভিভাবকের চক্ষুশূল হয়! মা স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী আজ তার জনগনরূপ সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। হায়রে মা! হায়রে সন্তান! সব ভালবাসার স্থান আজ বিষে ভরা, দূষিত হয়ে গিয়েছে। কেউ কাউকে আমরা ক্ষমা করিনা, কেউ কাউকে ভালবাসিনা। তাই ট্রেন দুর্ঘটনায় খুব সহজেই অবলিলায় আমাদের দেশের অভিভাবক বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে সস্তি খুজে পান। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য নির্বিশেষে বিরোধী দলকে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে উল্লেখ করে। কি যে এই সস্তি তিনি পান আমরা জানিনা তবে আমরা বার বার আস্থা হারিয়ে ভবঘুরে হয়ে যাই।

শিক্ষা ব্যবস্থার চরম উন্নতি দরকার। এজন্য প্রয়োজন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিশীলন। সেই লক্ষ্যেই যে শিক্ষা নীতির রূপ দেখলাম সেখানেও আবার আস্থা হারালাম। যান্ত্রিকতার এই যুগে প্রযুক্তির সাথে শিক্ষাকে সংযোগ ঘটানোর জন্য আমাদের অভিভাবকের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এখানেও মন ও মানসিকতা গঠনের উপকরনকে অবলিলায় ছুড়ে ফেলা হল। ধর্ম নিছক কোন ধর্মীয় ব্যাপার না যে এটা প্রযুক্তিগত শিক্ষার জন্য বাধাস্বরূপ। যা দিয়ে আমরা এই পৃথিবী গড়ে তুলব তা কিন্তু ওই প্রযুক্তির মধ্যে নেই কিংবা ওই প্রযুক্তি আমাদের শেখাবেনা কিন্তু ধর্ম শেখাবে। আবার যে শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করে আমরা উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলতা চাইছি সেই পৃথিবীতে কিন্তু আমরা নিজেরাই আর বসবাস করতে চাইবনা। বিশ্বাস, আস্থা,ভালবাসা,মূল্যবোধ বিহীন প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিয়ে যে পৃথিবী গড়তে চাইছি সেখানে হয়ত কেবল রোবটই বাস করতে পারবে, কোন মানুষ নয়। অথবা এরকম হতে পারে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমাদের মন-মগজের বিবর্তন হয়ে যাবে ফলে মানুষ আর ভালবাসা চাইবেনা, কারো প্রতি বিশ্বাস রাখবেনা, কোন স্বপ্ন দেখবেনা, কোন আস্থার সম্পর্ক চাইবেনা, কোন আবেগ থাকবেনা, অনুভুতিগুলো দুমড়ে মুচড়ে ভোতা করে ফেলবে...কেউ আর তখন কারো জন্য পরম ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষা করবেনা, কোন মা তার সন্তানের জন্য ভালবাসার ছিটে-ফোটাও মনের গহীনে পোষণ করবেনা, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা হবে কেবল জৈবিক...

জানিনা এই দুঃস্বপ্নের প্রহর কখন শেষ হবে। নাকি এই দুঃস্বপ্নই সত্যিকারভাবে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে কোন একদিন। তাহলে আমি আবার বলতে চাই ভালবাসাহীন এই পৃথিবীতে চাইনা আমি হাজার বছর, একটুখানি জীবন চাই যেখানে আস্থা, আবেগ,ভালবাসা আর বিশ্বাস আমাকে নতুন করে প্রাণে জোয়ার জোগাবে...একটুখানি জীবনের এই স্বপ্ন কি আমি দেখতে পারিনা?? নাকি এই স্বপ্নও অন্য কোন দুঃস্বপ্নের ভিন্ন রূপ!! 

প্রকৃত সুখের সন্ধান...

মানব মনের প্রকৃতি বড়ই বিচিত্র। কিসে সে কষ্ট পায় কিসে সে সুখী হয় তা সে নিজেই জানেইনা। হয়ত বিচিত্র মনের বৈচিত্রতায় আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। রাতের আকাশের যে মোহনীয় চাঁদ দেখে মন আনন্দে উদ্বেলিত হয় সেই একই চাঁদ দেখে চোখের কোণে জমে দুঃখের অশ্রুবিন্দু। সমুদ্রের বিশালতা কখনও এনে দেয় অসীম শূণ্যতা কখনওবা পূর্ণতা। বহুরূপী মনের এই সত্তা তাই বিশ্লেষণ করা খুব সহজ না।
কতটা অভিজ্ঞতা অর্জন করলে একজন নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবতে পারে? হঠাৎ এই প্রশ্নে চিন্তার জগতে ছেদ ধরল। আসলেই কি মানুষ কখনও পরিপূর্ণ হতে পারে? খুব চিরন্তন ও আদি প্রশ্ন। অভিজ্ঞতা অর্জনের মাপকাঠি নাকি বয়স! কিন্তু বয়সই কি সবসময় সেই মাপকাঠি হতে পারে?
আট/দশ বছরের কোন ছেলের অভিজ্ঞতার পরিসীমা কতটুকু? সাথে সাথে একটি চিত্র মনের পর্দায় ভেসে আসল । সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিভাবে স্কুল ফাঁকি দেওয়া যায়, কিভাবে আজ বিকালে ক্রিকেট খেলায় জেতা যায় কিংবা বাবাকে যে নতুন গাড়ি,ক্যাটবেরি কিনতে বলা হয়েছে তা আনতে ভুলে যাবেনাতো! মাকে কিভাবে কনভিন্স করে কম্পিউটারে “মোস্ট ওয়ান্টেড’’ গেইমস খেলা যায়...এইরকম হাজারো চিন্তায় ছেলেটির মন বিভোর থাকে। একই বয়সের যে ছেলে গাড়িতে হেল্পার এর কাজ করে তার চিন্তা জুড়ে থাকে কিভাবে যাত্রী বেশি উঠানো যায়, কিভাবে বেশি টাকা আয় করে পরিবারের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়া যায়। সারাদিন কাজের ফাঁকে হয়ত সে চিন্তা করে তার মা চুলার পাশে বসে আছে এই অপেক্ষায় যে তার ছেলে কখন বাজার নিয়ে আসবে! আরো যে ছোট ভাই-বোন আছে তারাও সারাদিন বড় ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকে। স্কুল ফাঁকি দেওয়া দূরে থাক পড়াশুনার চিন্তায় সেখানে বিলাসিতা মাত্র। চিন্তার এই অভিজ্ঞতা তার বয়সকেও হার মানিয়েছে। হয়ত অস্বাভাবিক কিন্তু বাস্তব...
এই অভিজ্ঞতা যেহেতু আমাদের নাই তাই এগুলো দেখতে দেখতেই আমরা অভিজ্ঞ। চারপাশে এত্ত অস্বাভাবিকতার ছড়াছড়ি মাঝে মাঝেই স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের মধ্যে পার্থক্য করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
সুখের সন্ধানে আজ মানুষ দিশেহারা। সুখের আসল সংজ্ঞা কেঊ দিতে পারেনি।কিন্তু আইন্সটাইন সেই অসাধ্য সাধন করে গেছে। পৃথিবীতে সব কিছুই আপেক্ষিক, কোন কিছুই পরম নয়। আমার কাছে যা সুখ অন্যের কাছে তা অসুখ। কিন্তু তারপরও সুখের সংজ্ঞা মিললেও সুখ খুজে পাচ্ছেনা মানুষ। সমাজের একটা পার্ট বাদ দিয়ে সুখের অন্বেষণ যেন ট্রেডিশানে পরিণত হয়েছে। শরীরের একটা অংশ প্যারালাইসিস হলে হয়ত তার ব্যথা অনুভব করা যায়না কিন্তু সেই অঙ্গের অনুপস্থিতি ঠিকই অনুভুত হয়।
অপূর্ণ শরীর হাজার চেষ্টা করলেও পূর্ণ হতে পারবেনা যতক্ষন না ওই অংশ ঠিক হয়। এসব কথা ভাবতেই পরিচিত একজনের কথা মনে পড়ল। সে বছরে আনুষ্ঠানিক একবার এতিমখানায়, মসজিদে টাকা দান করে আত্বতৃপ্তি অনুভব করে। মনে করে ইসলামের বড় একজন খাদেম...সবকিছুই ঠিক ছিল কিন্তু যদি সে ব্যাপারটা ট্রেডিশনালি না নিত , যদি মনে করত তার উপার্জনের টাকায় গরীবেরও হক আছে তাহলে হয়তবা সে এরকম অকেশনাল ইসলামের সেবা করে আত্বতৃপ্তি পেতনা। পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস/বিজয় দিবস উদযাপন সবই আজ নিছক ট্রেডিশান। একারনেই যারা পহেলা বৈশাখে লাল-সাদা শাড়ি পরে পুরো বাঙ্গালিয়ানা সাজে তারাই আবার থার্টি ফার্স্ট নাইটে ওয়েস্টার্ন কালচার খুব গর্বের সাথে পালন করে। নারী দিবসে নারী অধিকারের দাবি যাদের মুখে সোচ্চার হয় তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকার পাতায় নারী নির্যাতনের অভিযোগে নিউজ আসে। খুব বিচিত্রভাবেই ট্রেডিশানের এই সিলসিলা প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ বিদ্যমান।
মানব মনের প্রকৃতি অনুসন্ধান করে চলছিলাম। অভিজ্ঞতা অর্জন নাকি এই রিসার্চে ওনেক হেল্পফুল হবে। সব কিছু প্র্যাকটিক্যালি অভিজ্ঞতা অর্জন যেহেতু সম্ভব না তাই দেখে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। প্রকৃতি কখনও মনকে শূন্য থাকতে দেয়না। সুখের জন্য আকুল মন যে অংশ ডিলিট করে সেই অংশটি মন আরেকটি অংশ দিয়ে রিফিল করে। অটোমেটিক প্রোসেস। যে সত্তা মনকে একটিভলি লিড দিবে সে আজ প্যাসিভ। এই জন্যই হয়তবা যা কিছু করছি সব ট্রেডিশান, সব শুণ্য মনকে রিফিল করার চেষ্টা মাত্র। প্রকৃত সুখ পাবার প্রোসেসকে ইগ্নোর করে, সমাজের একটা পার্টকে বঞ্চিত করে সব কিছু ট্রেডিশনালি করে সবাই আমরা কৃত্তিম সুখের নিদ্রায় বিভোর । জানিনা এই নিদ্রার প্রহর কখন শেষ হবে...জানিনা দেখে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের দিন কবে শেষ হবে...জানিনা ট্রেডিশনাল সুখের কালচার কবে সমাপ্তি হবে...