শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০

আমার স্টুডেন্ট !

টেনশনে আছি রুহিত কে নিয়ে। রুহিত আমার স্টুডেন্ট। উহু, শুধু আমার না। আমার ভাইয়েরও। দুজনই পার্ট টাইম পড়ায় ওকে। যখন আমার পরীক্ষা থাকে তখন আমার ভাই আর আমার ভাইয়ের যখন অন্য কাজ থাকে তখন আমি। এভাবেই চলছে আজ চার মাস। আসলে বাড়িওয়ালা আন্টির সাথে এরকমই কথা হয়েছিল যে আমি বিজি থাকলে আমার ভাই পড়াবে। তো সেভাবেই চলছে...
এই পর্যন্ত খুব বেশি যে স্টুডেন্ট পড়িয়েছি তা না। তবে যাদের পড়িয়েছি তাদের থেকে রুহিত আলাদা। কি রকম আলাদা?
যদিও আমি শুধু ম্যাথ আর বিজ্ঞান পড়াই তারপরও আমি মাঝে মাঝে রুহিতের সাথে গল্প করার জন্য অন্য সাবজেক্টের আলোচনাও করি। একদিন রুহিতকে বললাম,
- আচ্ছা রুহিত, হাজার বছর ধরে উপন্যাস কেমন লাগে তোমার?
- ভালই তো লাগে, আপু।
- একটু বলবা হাজার বছর ধরে উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনী?
- (কিছুক্ষন চুপ থেকে শুরু করল) মকবুল বুড়া খুব খারাপ একটা লোক। একদিন করল কি জানেন আপু?
- কি করল?
- সে রাতে তার বৌ দের দিয়ে সবার অগোচরে অনেক অনেক কষ্টের কাজ করাল যা কিনা কেবল গরুই করতে পারে, মানুষ না।
- আচ্ছা, কাহিনী টা আমি জানতে চাইছি...
- এটাই তো কাহিনী!
- হুম, বুঝেছি। তাহলে আমাকে একটু বলতো হাজার বছর ধরে উপন্যাসের সামারি কি?
- আমি আসলে আপু বুঝতেছিনা কিভাবে মানুষ হাজার বছর বেচে থাকে? এই নাম দেয়ার মানে বুঝতেছিনা, তাই সামারি আমার ব্রেইনে আসতেছেনা।
- ওকে বলা লাগবেনা। তুমি পরের ম্যাথটা কর।

এই হচ্ছে রুহিত। যে কোন উপন্যাস বা গল্পের কাহিনী বা সামারি বলতে বললে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কাহিনী শেষ করে। গত রোজার ঈদের পরে রুহিত কে বললাম
- তোমার দেখা সবচেয়ে প্রিয় মুভি কোনটি?
- আমি তো মুভি দেখেছি একটা। ভালই লেগেছে
- মাত্র একটা?
- জি। কারণ পড়ার চাপে আমি মুভি দেখার টাইম পাইনা।
- আচ্ছা, কোন মুভি দেখেছ?
- থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
- হুম। এই মুভির কাহিনী কি?
- এত বড় কাহিনী কিভাবে বলি!
- না না, সংক্ষিপ্ত করে বললেও হবে।
- আচ্ছা। একদিন রুবা সন্ধায় তার স্বামীর সাথে হাটছিল। হঠাৎ পুলিশ ওদের ধরে থানায় নিয়ে গেল। এরপর ওদের বহু প্রশ্ন করতে লাগল। এরকম করে কাহিনি এগিয়ে যায়...
- আচ্ছা বুঝেছি। মুভিটার সামারি কি?
- মুভিটার সামারি তার নামের মধ্যেই আছে। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। মানুষ হচ্ছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। তাই তার আরো মানুষ দরকার যেন সে প্লুরাল হতে পারে। হাজার হলেও মানুষ হচ্ছে সামাজিক জীব।
- গুড। দারুন বলেছ তো!

আমার পরে যখন একদিন আমার ভাই পড়াতে গেল সেতো রীতিমত বিরক্ত। মেজাজ খারাপ করে সে আমাকে বলল “ আচ্ছা তুই রুহিতকে পড়াস কি করে? আজকে ওকে আমি চার ঘণ্টা ধরে সাইন থিটা=লম্ব/ অতিভুজ, কস থিটা= ভূমি/অতিভূজ পড়ালাম। অথচ সে বার বারই ভুল লিখে যাচ্ছে। ধ্যাৎ আজকে আমার সারাদিন নষ্ট ওর জন্য।“
আমার ভাইকে বললাম, “ রুহিত হচ্ছে যান্ত্রিক টাইপ বুঝেছিস। তুই ওকে সাইন থিটা, কস থিটা ২০ বার করে মোট ৪০ বার লেখা। দেখবি পরে ঠিক হয়ে যাবে। কারণ বার বার লিখতে লিখতে সেটা ওর ব্রেইনে সেট হয়ে যাবে।“ সত্যি সত্যি আমার ভাই ওকে ২০ বার করে মোট ৪০বার লেখানোর পর রুহিত ঠিকভাবে বলতে পারে।
যাইহোক ইদানিং আমি রুহিত কে নিয়ে খুব বেশি টেনশনে আছি। ২০১১ তে ওর এসএসসি পরীক্ষা। ম্যাথ ওকে রিভাইস করাচ্ছি। রুহিতের আরেকজন টিচার আছে যে ম্যাথ ও বিজ্ঞান ঠিকমত পড়া হচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করে। সেই টিচার রিভাইস করা ম্যাথ থেকে ওকে আটটা অংক করতে দিয়েছে সেদিন, রুহিত ৩ঘণ্টা পর একটা অংক মিলাতে পেরেছে। সেই খাতা পরে দেখে আমার তো মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা। আমি রুহিত কে এবার বললাম
- রুহিত, তোমার এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে কি টেনশন হয়?
- জি আপু হয়।
- তাহলে পড়াশুনা বাদ দিয়ে টেনশান কর।
- মানে?
- মানে হল, তুমি যখন টেনশান কর তখন তোমার ব্রেইনের যে পার্ট পড়াশুনা মেইন্টেইন করে সেটা ব্লক হয়ে যায়। তাই তুমি যদি সত্যি সত্যি পরীক্ষায় পাশ করতে চাও তাহলে টেনশান বাদ দিয়ে পড়াশুনা কর।
- আপু, আমার মনে হচ্ছে আমি ছিটকে পড়ে যাব।
- হুম, যাবা তো! কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তুমি তো সর্বোচ্চ ফেইল করবা। তাহলে টেনশান কিসের?
- ফেইল করলে তো আমি পানিতে ডুবে যাব।
- মানে?
- মানে পরীক্ষা হল পানির মত। পাশ করতে না পারলে সেই পানিতে আমি ডুবে যাব।
- হুম। তো কি হয়েছে? তোমাকে সেই পানি থেকে উঠিয়ে সাতার শেখাব। তারপর আবার পরের বছর তোমাকে পানিতে নামিয়ে দিব। তখন ডুবে যাবানা। তাহলে টেনশান কিসের???
- একবার যদি ডুবে যায়, তাহলে কি আর আমি পানি থেকে উঠতে পারব?
- আচ্ছা, রুহিত আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে...
- ঠিক আছে আপু, আপনি টেনশান কইরেননা। আমি দেখি কি করা যায়...

উফ! বাসায় এসে মনে হল, ছেড়ে দে মা কেন্দে বাচি টাইপ অবস্থা। আহারে! ওর জন্য খুব খারাপও লাগে আবার। পাশ করতে পারলেই ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে মাথায় করে রাখবে। কিন্তু সেই পাসই ওর জন্য ভয়াবহ কঠিন ব্যাপার। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আমি অপেক্ষা করছি। রুহিত যদি পাশ করে তাহলে আমি যতটা খুশি হব তা মনে হয় আমার নিজের পরীক্ষার ভাল রেজাল্টের জন্য তত খুশি হবনা………

কোন মন্তব্য নেই: