বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৩

কষ্টের সাথেই স্বস্তি (১)

 তখন সবেমাত্র নতুন সংসার শুরু হল । এতদিন  বাবা মায়ের সংসারে যে আমার কখনও খুব একটা রান্না ঘরে ঢুকার প্রয়োজন হয়নি  সেই আমি তখন নতুন সংসার আর এম বি বি এসের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । যাকে বলে একেবারে কুয়ার ব্যাঙ কে সমুদ্রের মধ্যে ছেড়ে দিলে যেরকম হয় আমার অবস্থা তার থেকে কম কিছু ছিলনা। চোখের পানি আর নাকের পানিতে আমার একেবারে কাহিল অবস্থা। এখনও সেসব কষ্টের দিনের কথা মনে পড়লে কান্না আসে। 

 প্রতিদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর রান্না ঘরে চলে যেতাম। আলু ভর্তা,ডিম ভাজি কিংবা খিচুড়ি রান্না করে আমি চলে যেতাম আমার হাসপাতালে আর ফাইয়াজের বাবা তার হাসপাতালে। সারাদিন হলে থেকে টানা রাত দশটা পর্যন্ত আমি আর আমার রিডিং পার্টনার একসাথে প্রফের প্রস্তুতি নিতাম। এরপর ফাইয়াজের বাবা আমাকে নিতে আসত। দুজনে রিকশা করে সেই রাতে আমরা ছোট্ট সংসারে ফিরতাম। এরপর কোনরকম খাবারের কিছু ব্যবস্থা, নামাজ আর ঘরের টুকিটাকি কাজ শেষ করে যখন বিছানায় যেতাম তখন রাত একটা পার হয়ে যেত। এরপর আবার সেই পুরান রুটিনের সাইকেল। ঘরের কাজ বলতে দুই একদিন পরপর ঝাড়ু দিতাম। আর মাসে দুই একবার আমার মা এসে পুরা সংসার ঝেড়ে মুছে, কাপড়-চোপড় সব ধুয়ে একেবারে তকতকে করে দিয়ে যেত। মাঝে মাঝে আব্বু এসে একগাদা রান্না তরকারি দিয়ে যেত। সেসব ফ্রিজে রেখে কয়েকদিন পার করে দিতাম। সে কয়েকদিন হয়ত আমার রান্নাবান্নার ঝামেলা কম থাকত। একটু সকাল সকাল রাতে ঘুমাতে যেতে পারতাম। এই তো ! কারণ সবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও আমাদের দুজনের সাপ্তাহিক ছুটি বলে কিছু ছিলনা। ফাইয়াজের বাবার শুক্রবারও ডিউটি থাকত আর আমিও চলে যেতাম সেই ভোরে আমার হলে, টানা গাধার মত পড়ার জন্য। এতকিছুর পরেও স্বস্তি ছিল এটা যে সংসারের সব ঝামেলা আমরা দুজন মিলেই করতাম। হয়ত আমি রান্না করেছি, খাওয়া শেষে ফাইয়াজের বাবা সব প্লেট-বাটি সুন্দর করে ধুয়ে রেখেছে। হয়ত আমি ঘর ঝাড় দিচ্ছি ওদিকে সে নোংরা কাপড়-চোপড় সব ওয়াশ করছে। কখনও আমি একটু অসুস্থ হলে রান্না বান্না, ধুয়া মুছা সব সেই করেছে। আমার ফাইনাল প্রফের বিরাট ধাক্কা বেচারার উপরও গিয়েছে। 

আর হলে থেকে আমি আর আমার রিডিং পার্টনার ম্যারাথন পড়া দিতাম। দুজনই ছিলাম বিবাহিত। তাই দুজনেরই কিছু সাংসারিক ঝামেলা মিটিয়ে প্রফের প্রস্তুতি নেয়া ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এজন্য অন্য কারো সাথে আমাদের পড়াশুনার রুটিনের বিন্দুমাত্র কোন মিল ছিলনা। সবাই রাতে জেগে পড়ে,সকালে দেরি করে উঠে। আর আমরা মোটামুটি সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টানা পড়তাম। মাঝখানে কেবল খাওয়া,গোসল আর নামাজের বিরতি। আমাদের এরকম হাভাতের মত পড়া দেখে আশে পাশে সবাই টিজ করত। কিন্তু আমরা দুজন জানতাম এরকম না পড়লে প্রফে পাশ তো দূরের কথা বসার যোগ্যতাও হবেনা। সারা বছরের জমানো মেডিসিন, সার্জারি আর গাইনির পাহাড়সম সিলেবাসের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ডাক্তার হবার জন্য এরকম পড়াশুনা ছাড়া আমাদের সেকেন্ড কোন অপশন ছিলনা। তার উপর তো ওয়ার্ডে গিয়ে গিয়ে কেতাবি জ্ঞান রোগীদের উপর একদফা ঝাড়া লাগত। হুম, এভাবেই চলছিল নতুন সংসার আর বহু কাংখিত ডাক্তার হবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি ।

জানুয়ারির ১তারিখে ফাইনাল প্রফ শুরু হল। রিটেন শেষ হল খুব ভালভাবেই। এরপর অসপিও ভালভাবে শেষ হল। এরমধ্যে ফাইয়াজের বাবার বিসিএসের ভাইভার রেসাল্ট দিল। আলহামদুলিল্লাহ টিকে গেল। কষ্টের মধ্যেও একটু আনন্দের ছোয়া। ভালভাবেই চলছিল সব । কিন্তু ভাইভা  শুরুর কয়েকদিন আগেই আমি টের পেলাম ফাইয়াজকে আল্লাহ পৃথিবীতে আসার জন্য নির্ধারন করে দিয়েছেন। প্রেগন্যান্সি টে্সটেও পজিটিভ আসল। শুরু হল প্রেগন্যন্সির প্রথম তিন মাসের শারীরিক ধাক্কা, সাথে ভাইভার মহা টেনশান। সবমিলিয়ে এক দুর্বিসহ জীবন শুরু হল.........



চলবে...



কোন মন্তব্য নেই: