বুধবার, ৯ মে, ২০১২

অতঃপর এক মুঠো রোদ্দুর....

এই লেখাটি পড়ার পূর্বে একটি লেখা পড়তে হবে। 
http://shetuzohra.blogspot.com/search?updated-min=2010-01-01T00:00:00%2B06:00&updated-max=2011-01-01T00:00:00%2B06:00&max-results=21

অবশেষে পাশ করেছে রুহিত। হয়ত ভাবছেন যেখানে ফেইল ব্যাপারটাই খুব ব্যতিক্রম, এ প্লাসের ছড়াছড়ি চারিদিকে সেখানে রুহিতের পাশ কি আর এমন ব্যাপার ! কিন্তু এটাই অনেক বড় একটি ঘটনা। ড.ইউনুস যখন শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেলেন- সমগ্র বাংলাদেশ যেমন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ল, কিংবা মুসা ইব্রাহীম প্রথম এভারেস্ট জয় করলেন সারাদেশে চরম উত্তেজনা অনেকটা সেরকম উত্তেজনার মধ্যে আছি আমি। শুধু আমি না সাথে মামুনও। কারণ আমাদের দুজনের কম্বাইন্ড স্টুডেন্ট হল রুহিত।

থার্ড ইয়ারে থাকতে যখন সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ড করতে জাতীয় মানসিক হাসপাতালে প্রতিদিন যেতাম তখন সত্যিই খুব ভাল লাগত সাইকিয়াট্রি সাবজেক্ট। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মানসিক সমস্যার ইতিহাস নিতে অন্যরকম ভাল লাগত। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পার্ট ছিল কাউন্সিলিং করা। কারণ জীবন সমুদ্রে পরাজিত চরম হতাশাগ্রস্থ একজন মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব পজিটিভ দিক খুজে বের করতে হয়, সেই অনুযায়ী তাকে আশার আলো দেখিয়ে জীবন সমুদ্রে বাকি পথ পাড়ি দেবার কথা বলা এত সোজা না। আর যদি সেটা হয় দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রতিনিয়ত অবজার্ভেশান করা, ফলো আপ করা তাহলে সেটা কত কঠিন বলার অপেক্ষা রাখেনা।

স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় মানসিক সমস্যাগ্রস্থ মানুষের প্রধাণ সমস্যা একটাই, সেটা হল যে ধারণা একবার তাদের ব্রেইনে সেট হয়ে যাবে সেটা থেকে বের করে আনা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। স্যার এক গল্প শুনিয়েছিলেন। ঠিক গল্প না এক কিশোরী মেয়ের ঘটনা। মেয়েটির ধারণা ছিল এক ছেলে তাকে ভালবাসে, যার জন্য সে প্রতিদিন ভোরে বাড়ির পাশেই খেলার মাঠে সেজে গুজে অপেক্ষা করত। মেয়েটির ডিলিউশান ছিল। কোন ফোন আসলে, কলিংবেল বাজলে সে ভাবত হয়ত ছেলেটিই তাকে নিতে এসেছে। এই ডিলিউশান থেকে মেয়েটিকে বের করে আনার কাউন্সিলিং প্রসেস খুব সহজ ছিলনা। খুব সহজে প্রেসক্রিপশানের পাতায় কয়েকটি ড্রাগস লিখে দিলাম, ব্যস। সেরকমও না।

ভেবেছিলাম সাইকিয়াট্রি তে ক্যারিয়ার করব। প্রথমত অনেক বেশি ইন্টারেস্ট খুজে পেতাম এই সাবজেক্টে, আর স্যারও অনেক বেশি কো-অপারেটিভ ছিলেন। সবমিলিয়ে ভালই লাগত। কিন্তু এই ক্যারিয়ার চুজিং এর চিন্তা যে সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এটা পরে বুঝেছিলাম রুহিত কে পড়াতে গিয়ে।

রুহিত বছরে দু’বার ব্যংকক যায় মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করাতে। ২০১১সালে ওর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। কিন্তু ওর মানসিক ভয়, টেনসান এত বেশি ছিল যে পরীক্ষা দেবার কথা ভাবতেই রুহিত আরো বেশি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষমেষ ওকে পরীক্ষার হলে না গিয়ে ব্যাংকক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লেগেছিল।
২০১১সালের পুরোটা বছর খুব ধৈর্য্যের সাথে ওকে পড়ানো লেগেছে। সপ্তাহে তিনদিন কমপক্ষে তিনঘন্টা করে ওকে কাউন্সিলিং করা লেগেছে। ওকে এটাই শুধু বুঝাতে হয়েছে যে তুমি পরীক্ষায় পাশ কর আর নাই কর পরীক্ষা দেবার ফলে যে অভিজ্ঞতা হবে সেটাই অনেক বড় একটা এচিভমেন্ট।

পড়াতে গিয়েই যখন দেখতাম ও মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বসে আছে তখন আমারও মন খারাপ হয়ে যেত। মন ভাল করার জন্য বলতাম,
- আচ্ছা রুহিত তোমার পিছনেই এক বিশাল সমুদ্র আছে, এটা তুমি বিশ্বাস কর?
- না আপু, বিশ্বাস করিনা।
- এক বিশাল পাহাড় রয়েছে, এটা বিশ্বাস কর?
- না আপু, করিনা।
- তাহলে তুমি এটা কিভাবে বিশ্বাস কর যে তুমি পরীক্ষা দিলেই ফেইল করবে। তুমি তো এখনও পরীক্ষায় দেউনি !
- আমার টেনসান হয়, খুব মেন্টাল স্ট্রেস হয় পরীক্ষার কথা ভাবলেই।
- সেটা তো আমারো হয়। তাই বলে কি আমি তোমার মত পরীক্ষা না দিয়ে ঘরে বসে ফেইল করব ভেবে আর পরীক্ষা দিইনি !
- আপু, আপনার কথা আলাদা।
- মোটেই আলাদা না রুহিত। জাস্ট পরীক্ষায় তুমি এটেন্ড কর। পাশ/ফেইল পরে চিন্তা কর।
- জ্বি.....( খুউব মন খারাপ করে, মাথা নিচু করে বসে থাকবে)

সাইকিয়াট্রিতে যাবার চিন্তা আমি বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম রুহিতকে পড়াতে গিয়ে। আসলে এত ধৈর্য্য রাখা সত্যিই খুব কঠিন। যখন আমারও পরীক্ষা চলত সেসময় নিজের পরীক্ষার চিন্তা, রুহিতের কাউন্সিলিং সব মিলিয়ে মেজাজ সবসময় ভাল থাকতনা। এরমধ্যেও বাড়িওয়ালা আন্টির খুব আন্তরিক রিকুয়েষ্টের কথা ভেবে রুহিতের কেয়ার করা লেগেছ। মনের সব কষ্ট, নিজের পরীক্ষার টেনশান চেপে রেখে হাসিমুখে রুহিতকে কাউন্সিলিং করা লেগেছে।

মানসিক সব চাপকে কিছু সময়ের জন্য চাপা দিয়ে হাসিমুখে কারও দিকে চেয়ে কিছু ফর্মালিটি রক্ষা করা হয়ত সহজ। কিন্তু অন্য একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্থ মানুষের জীবনের গভীরে ঢুকে গিয়ে তার জীবনের একটি পার্ট হয়ে জীবনকে কল্পনা করা, তার সব না বলা কষ্টের অনুভূতির সাথে মিশে যাওয়া, অতঃপর জীবনের বেঁচে থাকার পয়েন্টগুলো খুজে বের করে হাসিমুখে সেটাই ফোকাস করা, নিছক ফর্মালিটি রক্ষার চেয়ে অনেক কঠিন।

কিন্তু এত কষ্টের পরেও ভাল লাগত যখন একদম শেষের দিকে রুহিত খুব ভাল রেসপন্স করত। যখন বড় বোন হিসেবে সে খুব কো-অপারেটিভ হয়ে উঠত আমার সাথে, অন্যরকম আনন্দে মন ভরে যেত। যখন সামনে গোল সেট করে দিতাম বাক প্রতিবন্ধি সাবেরা ইয়ামিন কে যে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে ইউনিভার্সিটিতে সফলতার সাথে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে তখন রুহিতের হৃদয়েও অন্যরকম স্পন্দন তৈরি হত। সেও আশায় বুক বাধত, হয়ত আশার তরী তারও একদিন সব গন্ডি পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পৌছবে।

অতঃপর রুহিত এস.এস.সি তে পাশ করল। জীবনে নিজের পরীক্ষার সর্বোচ্চ রেসাল্টেও কোনদিন এত খুশি হইনি। বাসায় এসে রুহিত আমাকে,মামুনকে সালাম করল । মনের খুশি ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলল, 'ঈদের আনন্দ কি জানিনা। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি যে কি পরিমান অস্বাভাবিক আনন্দ মনের ভিতর হচ্ছে বলে বুঝানো যাবেনা।'

রুহিতের এই অসামান্য কৃতিত্ব আমার কাছেও মনে হচ্ছে বহুদিন ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা শেষে এক মুঠো রোদ্দুর হাসি মনের কোণে ঝিলিক দিয়ে গেল। সাথে আল্লাহর নিকট অনেক শুকরিয়া। প্রকৃতপক্ষে সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।

ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড : টিউশনি,রেজাল্ট, আনন্দ
বিষয়শ্রেণী: বিবিধ

কোন মন্তব্য নেই: