বুধবার, ৯ মে, ২০১২

হারানো আকাশ !


https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhB65N-OY__vuCWLh1UDfhT2my9fanypdqns6sYxm9Zx5_ZCVgZbnjfjtEwPeQC7zF0-dHowPOhd2-6arStYwezo4vBzYBwkCUAtOzyt3oICWbZ0VYGHd7roUw2bxW-Fb5cY18IFyxGkk0b/s1600/kapal.jpg

শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই প্রিয়তমা স্ত্রীকে ডেকে বললেন, তোমার কাছে যে মূল্যবান অলংকার রয়েছে সেটা হয় সরকারি কোষাগারে জমা দাও নয়ত আমাকে ত্যাগ কর। বুদ্ধিমতি স্ত্রী সাথে সাথে সমস্ত অলংকার সরকারি কোষাগারে জমা দিল।

শাহী বাসভবনে প্রবেশ করলেন শাসক। বংশের সকল লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কি কি উপহার এবার তারা পাবে,কেননা প্রতিবার শাসন ক্ষমতা বদলানোর পরেই বংশের লোকেরা শাহী বাসভবন হতে প্রচুর উপহার পেয়ে থাকে। কিন্তু শাসক শাহি বাসভবনে প্রবেশ করেই সকল সম্পত্তি সরকারি কোষাগারে দান করলেন। সবাই তীব্র ক্ষোভ ও রাগ নিয়ে বিদায় নিল।

প্রিয় বন্ধু শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বন্ধুত্বের খাতিরেই সরকারি কোষাগার থেকে প্রাপ্য অর্থ আদায় করতে বন্ধুর কাছে আগমন। একটি শাহী ফরমান দেখিয়ে বন্ধুকে বলল, এটা পূর্বের শাসক হতে প্রাপ্ত যেখানে সে সরকারি কোষাগার হতে বিপুল পরিমান অর্থের দাবিদার। সব দেখে শাসক বন্ধুকে বলল, সরকারি কোষাগার জনগনের সম্পদ, পবিত্র আমানত। সেখান হতে কিভাবে পূর্বের শাসকের এই শাহী ফরমান দেখে তোমাকে অর্থ দেই যেখানে পূর্বের শাসকরা ন্যয় বিচার করে এই শাহী ফরমান লিখে যাননি ? বন্ধু বিষন্ন হৃদয়ে ফিরে গেল।

চাচাত ভাই এসে দাবি করল, পূর্বের সকল শাসক সরকারি কোষাগার হতে বংশের সকল লোকের জন্য ভাতা বৃদ্ধি করে গিয়েছে তাই তার ভাতাও যেন এবার বৃদ্ধি করা হয়। শাসক তাকে খুব ধীর স্থির ভাবে বললেন ভাই, আমি তো কেবল আমার বংশের লোকের জন্য শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইনি ! বরং আমার পূর্ববর্তী যারা তোমাদের অন্যায়ভাবে কেবল স্বজনপ্রীতিমূলকভাবে জনগনের সম্পদ হতে অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে গিয়েছেন সেটা আজ থেকে বন্ধ করে দিলাম।

অনেক অভিযোগ নিয়ে ফুফু এসেছেন শাসকের নিকট দেখা করতে। ভাতিজা কে বললেন তোমার পূর্বে তোমার বাবা, চাচা আমার জন্য যে ভাতা বরাদ্দ করে গিয়েছিলেন সেটা নাহয় তুমি বৃদ্ধি করলেনা, কিন্তু বরাদ্দকৃত ভাতা কমালে কেন? খুব শ্রদ্ধার সাথে এবার শাসক ফুফুকে বললেন, সাধারণ জনগন যে ভাতা পাবে আপনিও তাই পাবেন। সরকারি কোষাগার হতে জনগনের সম্পদ আপনাকে দিয়ে তো আমি আপনাকে সুখী করতে পারিনা !

চাচাত ভাই এসে রাজনৈতিক মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করল। বলল, বংশের লোকেদের অখুশি করে তো শাসন ক্ষমতায় বেশিদিন থাকতে পারবেনা। তারচেয়ে বরং আমাদের যে ভাতা দেয়া হত সেটাই নির্দিষ্ট থাকুক, সেটা তোমার আর বৃদ্ধি করা লাগবেনা। সব শুনে শাসক বললেন আল্লাহর নিকট আমি সমগ্র জনতার সামনে অপমানিত হওয়াকে খুব ভয় করি। শাসক হবার মত কন্টকপূর্ণ জীবন আর হয়না। ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীনতা থাকে কিন্তু শাসকের জীবনে কোন স্বাধীনতা থাকেনা। কারন শাসক কোন ব্যক্তি নয় পুরা জাতি। সাধারণ মানুষ যে অবস্থায় থাকবে আমাকেও আজ সেই অবস্থায় থাকতে হবে। রাজনৈতিক চালকে ধূলায় মিশিয়ে দিলেন শাসক। চাচাত ভাই ক্ষুব্ধ মনে ফিরে গেল।

ব্যক্তিগত যত সম্পত্তি বংশানুক্রমিকভাবে শাসক পেয়েছিলেন সব বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে জমা দিলেন। শুধুমাত্র একান্ত ব্যক্তিগত একটি জায়গীর রেখে দিলেন যা থেকে খুব সামান্যই আয় হয়। সরকারি কোষাগার হতে শাসক হিসেবে প্রাপ্য ভাতাও তিনি গ্রহন করতেননা। কারণ তার যে ব্যক্তিগত জায়গীর রয়েছে, ওতেই তার হয়ে যাবে। শুধু শুধু কোষাগারের উপর চাপ বাড়িয়ে কি লাভ!

ওমর বিন আব্দুল আজিজ ছিলেন ঠিক এরকমই একজন শাসক। যিনি খলিফা হয়েই পূর্ববর্তী সব খলিফাদের অন্যায়,যুলুম,অত্যাচার, অবিচারের নিষ্কাশন করেছিলেন।

একবার সাধারণ এক লোক ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বংশের কোন এক লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলল তার জমি দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ভাবে দখল করেছে সে। ওমর তার বংশের লোককে এর কারণ দর্শাতে বললে সে জমির দলিল নিয়ে দেখাল এটা পূর্বের খলিফা তাকে দিয়ে গেছে। এবার ওমর তাকে বললেন যদি এমন কোন অবস্থা দাঁড়ায় যে একজন আব্দুল মালেকের দলিল দেখাচ্ছে অন্যজন মারওয়ানের দলিল দেখাচ্ছে সেক্ষেত্রে কোনটা গ্রহন করা উচিত? সাথে সাথে বংশীয় লোক জবাব দিল পূর্বের দলিল অর্থাৎ মারওয়ানের দলিল গ্রহন করা উচিত। ন্যয়পরায়ন ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ বললেন আমিও সবচেয়ে পুরান দলিল- কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এই জমি ওই সাধারণ লোককে দিয়ে দিলাম।
http://www.kalamullah.com/img/ibnmajah.gif

ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ, ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম। যিনি উমাইয়া বংশের সেই খলিফা যে উমাইয়া বংশীয় সকল পাপ-পংকিলতার উর্ধে থেকে একেবারে স্বতন্ত্র ও সঠিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

ইসলামিক ইতিহাসের কিছু পার্ট আমি সবসময় এভয়েড করে যাই। বনু হাশেমী ও বনু উমাইয়া গোত্রের পারস্পরিক বিরোধের যে লজ্জাজনক ঐতিহাসিক পরিণতি তা আমি বরাবরই এভয়েড করি। কিন্তু হঠাৎ করে ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের জীবনী পড়তে খুব আগ্রহ হল। আগ্রহের প্রধাণ কারণ ছিল উমাইয়া গোত্রের লোক হয়ে, মারওয়ানের পৌত্র হয়েও কিভাবে তিনি এতটা স্বতন্ত্র ছিলেন?
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg_C-dg1weksuDzboTPbD2mfcqp9BGMyPAXb8yStAyOkxSS2ySXIjLY_HQuwhMP3xc8oxCx2TB5JjPSpcPOSXv12ltziYWC6Jc8IJJc5ae73hUbQr8rzsjBB-38nz9Hv27e9Wg0taB29-sF/s1600/fondillo_1920x1200.jpeg
খুব গভীরভাবে ব্যপারটা খোঁজার চেষ্টা করি। ঠিক একজায়গায় এসে কিছুটা মানসিক তৃপ্তি পেলাম । ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ, যার মাতা ঊম্মে আসেম। উম্মে আসেমের দাদা ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ)। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা না উল্লেখ করে পারছিনা।

হজরত ওমর (রাঃ) যখন খলিফা ছিলেন তখন একবার রাতে সাধারণ জনগনের অবস্থা সফরকালে এক বিধবার ঘরে এসে শুনতে পেলেন বিধবা এবং তার মেয়ের কথোপকথন। সেসময় দুধে পানি মিশানো ওমর(রাঃ) নিষেধ করে দিয়েছিলেন। বিধবা দুধে পানি মেশাতে চাইলেও মেয়ে কিছুতেই পানি মিশাতে দিবেনা। বিধবা তার মেয়েকে বলল, এখন তো ওমর দেখছেনা, পানি মেশালে কি হবে? কিন্তু মেয়ে বলল, ওমর হয়ত দেখছেনা যে দুধে পানি মিশাচ্ছি কিন্তু ওমরের আল্লাহ তো দেখছেন ! এই কথোপকথনে মুগ্ধ হয়ে ওমর (রাঃ) তার পুত্র আসেমের সাথে বিধবার কন্যার বিয়ে দেন। খলিফা ওমর (রাঃ) কেবল দ্বীনি গুনে মুগ্ধ হয়েই এটি করেন, উচ্চবংশ না নিম্ন বংশ এটা একেবারেই পাত্তা দেননি। পরবর্তীতে এই ঘরেই জন্মগ্রহন করেন উম্মে আসেম যাকে বিবাহ করেন মিশরের শাসক আব্দুল আজীজ ইবনে মারওয়ান।

এতো গেল ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বংশ পরিচয়। এরপর যেটা পড়ে আরো বেশি মানসিক তৃপ্তি পেলাম সেটা হল ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বাল্যজীবন ও পড়াশুনা। তিনি মদিনায় প্রতিপালিত হয়েছেন মাতামহের গৃহে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তাঁকে নিজ হাতে লালন পালন করেছেন, আরবি ভাষা-সাহিত্য শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওতবাকে ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের অন্যতম শিক্ষক নিযুক্ত করেন। অন্যদিকে পিতা আব্দুল আজীজও পুত্র ওমরের সঠিক শিক্ষার জন্য মদিনায় তার জন্য মাসিক দিনার বরাদ্দ করেছিলেন। ফলস্বরূপ উমাইয়া বংশের উত্তরাধিকারী হয়েও ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বাল্যজীবন, কিশোর ও শিক্ষা-দীক্ষা সরাসরি দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর পরিবার হতেই পরিচালিত হয়েছিল।

ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের উপর তার শিক্ষকের কিরূপ প্রভাব বিরাজ করত সেটার একটি ঘটনা উল্লেখ করি। উমাইয়া বংশের সকল লোক হযরত আলী (রাঃ) ও তার পরিবারবর্গকে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করত। ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ একদিন বংশের ধারা অনুযায়ী হযরত আলী (রাঃ) এর নামে কিছু কটু কথা বলেন। এটি শুনে ওবায়দুল্লাহ ইবনে উতবা রাগ করে ওমরকে বলেন, “ তুমি কবে থেকে অবগত হলে যে আল্লাহ বদরবাসীদের উপর সন্তুষ্ট হবার পর পুনরায় অসন্তুষ্ট হলেন?” ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন কখনও এরকম আর করবেননা।
ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের বাল্যজীবন, কিশোর, শিক্ষা-দীক্ষা ,পরিবেশ ও শিক্ষকের ভূমিকা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সেটা তাকে উমাইয়া বংশ থেকে একেবারে পৃথক করে দিয়ে স্বমহিমায় মহিমান্বিত করেছিল।

এইতো সেই ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ, যাকে বলা হয় দ্বিতীয় ওমর, উমাইয়া বংশের একমাত্র নক্ষত্র যাঁকে ইতিহাস অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরন করে।
http://t2.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcSrDwi-ToBul_L-vsvcmjsdrqjynZlgPSpGG2rtMY2Q8WYT1J0afSFv-aFX
বর্তমান যুগের শাসকদের দূর্নীতি, অন্যায়-অবিচার দেখে দেখে যখন মন খুব বিষাক্ত হয়ে উঠে তখন এধরনের স্বর্ণালি জীবনী আশার আলোকে এখনও জিইয়ে রাখে। হয়ত কোন একদিন এমন কোন শাসক আসবেন যেদিন সুরঞ্জিতের মত মন্ত্রীরা জনগনের টাকা নিয়ে লুটপাট করবেনা, রাতের আধারে কেউ নৃশংসভাবে খুন হবেনা, বিনা অন্যায়ে কেউ শাস্তি পাবেনা। এখনও আশা রাখি কোন এক ওমর আসবেন যিনি জনগনের কাতারে নেমে যাবেন, ব্যক্তিগত সুখ বাদ দিয়ে সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহন করবেন। আর ধীরে ধীরে আমাদের হারানো আকাশ আবার দীপ্তিময় হয়ে উঠবে.....

কোন মন্তব্য নেই: