বুধবার, ৯ মে, ২০১২

ভাগাভাগির সংসার

আজ পাঁচদিন হল বাসায় আব্বু-আম্মু কেউ নেই। দাদী, ছোট ভাই মামুন আর আমার সংসার। এমনিতেই বাসায় খুব হইচই থাকে। যদিও ভাই-বোন মোটে দু’জন আমরা তবু বাসায় সবসময় অনেক ভাই-বোন মিলেই থাকতে হয়।
খুব ছোটবেলা থেকেই অনেক অনেক ভাই-বোনের খুব শখ আমার। কারণ একটাই, অনেক খেলা করা যাবে, আনন্দ করা যাবে। খুব ছোটবেলায় এ শখ পূরণ না হলেও বড়বেলায় এ শখ একেবারে ষোলআনা পূর্ণ হয়েছে আমার। খালাত ভাই, বোন, ফুফাত ভাই-বোন সবাই মিলে সবসময় বাসায় পাঁচ-ছয় ভাই/বোন একসাথে থাকা হয়। আর দাদী সবসময় আমাদের সাথেই। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে এটা দেখে আসছি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এদের মধ্যে যেসব কাজিনের বিয়ে হয়ে যায় কিংবা পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে যায় এর পরেই আসে নেক্সট আরেক গ্রুপের কাজিন। এভাবে করে এখনও চলছে ব্যাপারটা।

সবাই মূলতঃ পড়াশুনার জন্যই থাকার সুবিধার্থে মেসে থাকার পরিবর্তে আমাদের বাসায় উঠে। আর আমার মা, যিনি খুব অতিথিপরায়ণ এবং অতিমাত্রায় সামাজিক তাদের পড়াশুনা,থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য একেবারে বাসায় রেখে দেয়। তো আল্টিমেইটলি আমার মায়ের জন্য আমরা দু’ভাই বোন অনেক ভাই বোন না থাকার ব্যাপারটা কখনই মিস করিনা।
আব্বু খুব গম্ভীর এবং রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। খুব বেশি মানুষজন খুব একটা পছন্দ করেননা। তবু আমার মায়ের এই সামাজিকতার কাছে তার এই গম্ভীরতা খুব একটা ধোপে টিকেনা। যাইহোক বাসায় খুব হইচই এর মধ্যেও আব্বু সবসময় নিজের জগতে একাকি বিচরন করতেই ভালবাসেন এবং আমরাও কেউ তার জগতে ডিস্টার্ব করিনা। মাঝে মাঝে মনে হয় আব্বু-আম্মু পুরোপুরি দুই মেরুর মানুষ হয়েও এতকাল একসাথে সংসার কিভাবে করেছে।

জমিজমা সংক্রান্ত কাজে আব্বু কিছুদিন আগেই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। আমার কলেজ বন্ধ হওয়াতে আম্মাও এই সুযোগে আমাকে বাসায় রেখে নানীকে দেখতে চলে গেল। বাকি যেসব কাজিন ছিল তারাও হরতালের ফাকে ,ছুটি কাজে লাগাতে ঢাকার বাইরে নিজেদের বাড়ি চলে গেল। দুম করে পুরা বাসা একবারে ফাকা হয়ে গেল।

তো এখন সংসার পুরা আমার হাতে। রেগুলার রান্না-বান্না, ঘর গুছানো, ঝাড়ু দেয়া, দাদীর আর আমার কাপড়-চোপড় পরিস্কার করা, দাদীর যত্ন নেওয়া সব আমাকেই করতে হচ্ছে। এই প্রথম সবকিছু আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আব্বু-আম্মু পুরাপুরি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই ছোট সংসারেও মামুন আমাকে তার সাধ্যমত ভালই সাহায্য করছে।
আম্মু চলে যাবার দিন থেকেই কাজ আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছি। ও পানি ফুটাবে প্রতিদিন, জগে-বোতলে পানি ভরবে, বোতলে পানি ভরে ফ্রিজে রাখবে আর বাজার করবে টুকটাক। কিন্তু প্রথমদিন কাজ করার পর দেখা গেল আমার কাজ অ-নে-ক বেশি ওর তুলনায়। তাই দ্বিতীয় দিন আবার কাজ ভাগ হল। এবার ওর এক্সট্রা কাজ হল সকালে অথবা রাতে সব প্লেট,গ্লাস,হাড়ি-পাতিল সব মেজে পরিষ্কার করবে। মামুন মেনে নিল।

তৃতীয় দিন বুঝতে পারলাম, খুব ভোরে ঘুম বাদ দিয়ে ভাত রান্না করে দাদীকে মেখে খাওয়ানো, সব ঘর গুছানো,ঝাড়ু দেবার পরে একটু পড়তে বসা। এরপর দুপুরে রান্না-বান্না ,গোসল করে, নামাজ পড়ে দাদীকে খেতে দিতে দিতে খুব টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছি। তাই তৃতীয় দিন আবার কাজ ভাগ হল। এবার মামুনের ভাগে আরো যোগ হল ও ঘর ঝাড়ু দিবে, দুপুরে দাদীকে গুছিয়ে খেতে দিবে এবং প্লেট ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখবে। যাইহোক এতে করে আমার একটু রিলাক্স হল।

রান্না-বান্না একেবারে কিছুই পারিনা তা না। সব মোটামুটি শিখে ফেলেছিলাম কয়েক মাস আগেই। কে জানত এই রান্না-বান্নার ইন্টার্নিও আমাকে করতে হবে পুরোদমে ! এরমধ্যে আমার এক ফ্রেন্ডকে বাসায় ইনভাইট করলাম আমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য। বাসার কাছেই বাসা তার, তাই অফারটা সাথে সাথে লুফে নিল। দুপুরে মুরগি, বিকেলে নুডলস খাওয়ালাম ওকে। সর্বশেষে ও তো আমার এত্ত গুনে একেবারে মুগ্ধ। আগেই বলে রাখি, আমার ওই ফ্রেন্ড রান্না-বান্নার এ ব সি ডিও জানেনা। সুতরাং একেবারে যিরোর কাছে আমার পারফর্মেন্স একেবারে পিকে উঠে গেল।
আমার ভাই এত ভদ্র টাইপের না। ওকে যা বলা হবে ও সেভাবেই করবে এধরনের তথাকথিত ভদ্র সে না। কিন্তু সে এখন আমার সাথে কাজ ভাগাভাগি করে ঠিকমতই সংসার করছে। আমার ধারণা, আমি যা রান্না করছি সেটা ওর খেতে খুব ভালই লাগছে। তাই ভালমনেই সব কাজ করে যাচ্ছে। যদিও মামুন আমাকে ব্যাপারটা বলছেনা তবু আমি আন্দাযে ধরে নিচ্ছি।

চতুর্থ দিন ভাগাভাগির কাজে ভালই দিন কেটে গেল। এবার আর কারো কোন অভিযোগ নেই। বিকেল বেলা দুজন মিলে গল্প করলাম। ছোটবেলার কিছু স্মৃতিচারণ করলাম...বেশ সুন্দর, মিষ্টি এক বিকেল হল আমাদের দু’ভাই-বোনের।

পঞ্চম দিন কিছু বই আনতে আমি কলেজে গেলাম। রাস্তায় খুব জ্যাম আর বাস/রিকশা পেতে অনেক দেরি হওয়ায় কলেজে পৌছলাম অনেক দেরি করে। ফলে কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে তিনটার বেশি বেজে গেল। মোবাইলে মামুনকে মেসেজ পাঠালাম ভাত রান্না করে, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি করতে। ফ্রিজে ডাল ছিল ওটা গরম করতে বললাম। বাসায় এসে দেখি ও সব ঠিকমত করে রেখেছে, নিজের ভাগের কাজ তো করেছেই সাথে দাদির কাপড় পরিস্কার করে নেড়ে দিয়েছে, দুপুরে নিজে রান্না করে দাদিকে খেতে দিয়েছে। সব একেবারে পারফেক্টলি করেছে। আমিও খুব খুশি হয়ে গোসল করে ওর রান্না করা ভাত্, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা আর ফ্রিজ থেকে গরম করা ডাল দিয়ে পেট ভরে খেলাম।
বিকেলে এবার মামুন বলছে, ‘ আজকে তো সব কাজ আমার ভাগেই দিয়ে দিলি!’ আমিও সাথে সাথে বললাম, দেখেছিস তাহলে আমার কাজগুলো কত কষ্টের।
একেবারে মিনা কার্টুনের মত গড়গড় করে বাকিটুকুও বললাম...... ষষ্ঠদিন থেকে চল আমরা দুজন কাজ এক্সচেইঞ্জ করি। তোর কাজ আমি করব আর আমার কাজ তুই করবি। কিন্তু এবার আর ও রাজি হলনা। অলরেডি বুঝে গিয়েছে আমার ভাগের কাজ ওর চেয়ে কষ্টের।

সবকিছু ভালই চলছিল। মিনা কার্টুনে দেখাত যে পরিবারের সবাই ছেলে হওয়াতে রাজুকে বেশি গুরুত্ব দেয়। মেয়ে হিসাবে মিনা বঞ্চিত। এমনকি মিনার দাদিও রাজুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করত। কিন্তু আমাদের বাসায় ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রে উলটো হত। অবশ্য অনেক ভাই-বোন একসাথে থাকার সুবাদে কেউ গুরুত্ব কম বেশি পাবার কোন স্কোপ আসতনা। কিন্তু আজ বাসায় আসতেই যখন দাদি বলল, আজ মামুন সব কাজ করেছে। তখনই মনে হল মিনার দাদির মত হয়ে গেল না তো ব্যাপারটা ! আমি প্রতিদিন সব করছি, কিন্তু আজ মামুন করতেই দাদি খুব স্পেশালি আমাকে জানান দিল।
কি জানি !!

কবে আমাদের এই ভাগাভগির সংসার সমাপ্ত হবে জানিনা। কারণ আব্বু-আম্মু কেউই কবে আসবে এ ব্যাপারে কিছুই বলছেনা।কিন্তু একেবারে খারাপ যাচ্ছেনা আমাদের দু'ভাই-বোনের এই ভাগাভাগির সংসার........
ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড : রান্না-বান্না, সংসার
বিষয়শ্রেণী: ব্লগর ব্লগর

কোন মন্তব্য নেই: