বুধবার, ৯ মে, ২০১২

নিশীথের ভ্রমন.....


আসলে শিরোনাম দেখে এটা ভাবার দরকার নেই যে এটি কেবল এক নৈশ রাতের ভ্রমন কাহিনী। বিস্তারিত ভিতরেই বলি??

ঢাকায় থেকে যখন আমি পুরাই বিদ্ধস্ত, যখন কোন কিছুতেই মন দিতে পারছিনা তখন থেকেই চিন্তা, কবে একটু সুযোগ পাব ঢাকার বাইরে ভ্রমনের। ২য় প্রফের পর থেকেই এরকম অস্থিরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু সময় কোথায় কোথাও যাবার?? ঠিক এরকম একটি অস্থিরতার ভিতরেই পেয়ে গেলাম পূজোর ছুটি। বাসা থেকে অনুমতি দিবে কিনা সন্দেহ ছিল, কিন্তু অনুমতি আব্বুর কাছে চাইতেই সাথে সাথে দিয়ে দিল। তবে এই তড়িৎ অনুমতির সাথে একটি বিশেষ শর্ত ছিল যে আমাদের গার্জিয়ান হিসেবে মামুন থাকবে। এবারই বুঝলাম, আমার ভাই আমার ছোট হয়েও কিভাবে এখন আমার গার্জিয়ান হয়ে গেল ! মেয়েরা আসলে মেয়েই......

আসলে এবার ভ্রমনের নির্দিষ্ট কোন প্ল্যান ছিলনা। কোথায় যাব, কে কে যাবে কিছুই জানিনা। কিন্তু বাসায় তিনজনের একই সাথে অস্থির মন এবার একীভূত হয়ে গেল। যুথি,আমি এবং আমাদের গার্জিয়ান মামুন। তিনজনেই মেডিকেলে পড়ি, সুতরাং একিসাথে এই পুজোর বন্ধে কোথাও ঘুরতে যাবার এই সুযোগ আর মিস করা উচিত না। ঝটপট সিদ্ধান্ত, চট্টগ্রামে যাব। যুথি যাবে কিনা সন্দেহ ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি ওকে কনভিন্স করালাম। হুম!কাউকে কনভিন্স করার পাওয়ার একেবারে খারাপ না আমার....

ঠিক যাবার একদিন আগে যখন ফেইসবুকে বন্ধুমহলে শেয়ার করলাম, আমাদের সাথে ভার্চুয়ালি যোগ দিল বুবু। এই মোট চারজন নিয়ে আমাদের ভ্রমন। ট্রেনের টিকিট পেলাম না, যদিও যুথি রাজি হয়েছিল এটা ভেবে যে সে এবার জীবনের প্রথম ট্রেন জার্নি করবে। আমি তাকে অবশ্য এটা বলেই কনভিন্স করিয়ে ছিলাম। ঠিক যাবার আগে যখন এই ঝামেলা, তখন যুথিকে বললাম, চিন্তা কইরোনা, আসার সময় আমরা ট্রেনে আসব...আসলে এটা ছিল কনভিন্স করার একটি পার্ট।

রাত ১১টার বাসের উদ্দেশ্যে আমি,যুথি,বুবু এবং মামুন রওনা হলাম। যদিও বাস ছেড়েছে প্রায় শোয়া বারটার দিকে। বাংলাদেশ তো, তাই এটাকে খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। নৈশ রাতের ভ্রমন শুরু হল.....

বাসের মধ্যে অনেকক্ষন ধরে চলল আমাদের গল্প। পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ঠিক যখন অলঙ্কার রোডে বাস থামল তখন প্রায় সাড়ে ছয়টা, আর তখনি দুলাভাইয়ের ফোন। ভাইয়ার দেয়া ডিরেকশান অনুযায়ী সি.এন.জি ঠিক করেই চলে গেলাম তার বাসায়। ফ্রেশ হয়ে,খেয়ে দেয়ে,রেস্ট নিয়ে ১১টার দিকে বের হয়ে পড়লাম আরিফার সাথে। আরিফা আমার কাজিন এবং বান্ধবি। ওকে গাইড ট্যুর হিসেবে নিলাম। ইনফ্যাক্ট গাইড ট্যুর হিসেবে ও একটি চমৎকার মেয়ে....থ্যাঙ্কস টু আরিফা।

মিনি বাংলাদেশে যেয়ে তো আমাদের অবস্থা পুরাই বর্ণনার অযোগ্য। পুরা বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান ঘুরার সুযোগ কি আর আছে আমাদের? একই সাথে লালবাগের কেল্লা, কান্তজির মন্দির,শহীদ মিনার,ষাট গম্বুজ মসজিদ, আহসান মঞ্জিল,কার্জন হল দেখতে পেলাম তখন আমাদের অবস্থা ঠিক মরুভূমির সেই বেদুইনের মত অবস্থা হল যে বহু ক্রোশ মরুভূমির পথ পাড়ি দিয়ে হঠাৎ পানিপূর্ণ পুকুরের সন্ধান পেল। যে সংসদ আমি প্রতিদিন প্রায় ক্যাম্পাসে যাবার পথে দেখি সেটার মিনি ফর্ম দেখে এত্ত ভাল লাগল, নিজেকে তখন নাফির সমবয়সী মনে হল। নাফি, আমার ভাগ্নে, ক্লাস থ্রিতে পড়ে যে কিনা আমাদের সেদিনের পুরা ট্যুরে সঙ্গি ছিল। ভাগ্যিস সে সাথে ছিল কারণ সেদিন নেভাল থেকে রাতে বাসায় ফেরার পথে যখন সি.এন.জি ওয়ালা বাসা চিনতেছিলনা, তখন নাফিই আমাদের পথ চিনিয়ে দিল।থ্যাঙ্কস টু নাফি।

যাইহোক প্রচুর ফটোশেসান হল। মিনি বাংলাদেশ ঘুরার মধ্যেই আমাদের সাথে যোগ দিলেন বিশিষ্ট ব্লগার হেলাল এম রহমান। ইনফ্যাক্ট চট্টগ্রামবাসীরা ন্যাচারালি বন্ধুবৎসল একটু হলেও বেশি।

(সোনা মসজিদ)


(কান্তজির মন্দির)


(আহসান মঞ্জিল)


(সোনা মসজিদ)


(লাল বাগ কেল্লা)

মিনিবাংলাদেশের পর যখন ক্ষুধাতে অবস্থা খুবই খারাপ তখন আমাদের হেলাল ভাইয়া নিয়ে গেলেন জি.ই.সির নিরিবিলি হোটেলে। আমি অন্যকিছুনা, রূপচাদা মাছ আর শুটকি ভর্তা খাওয়ার সুযোগ মিস করিনি। সবাই দেখি মুরগি, ভুনা খিচুড়ি খাচ্ছে আর আমি মহা আনন্দে একাই রূপচাদা মাছ খেলাম। উফ! চট্টগ্রাম কে আমার ভাললাগার আরেকটি কারণ, আমি সামুদ্রিক্ মাছ মারাত্বক পছন্দ করি। হেলাল ভাইয়া ফেইসবুকে একবার খুব লোভ দেখিয়ে আমার ওয়ালে সামুদ্রিক মাছের ছবি পোস্ট করেছিলেন। এবার উনি সেটাই বাস্তবে রূপ দান দিলেন। থ্যাঙ্কস টু হেলাল ভাইয়া।

এরপর পতেঙ্গা ট্যুর। কিন্তু না, রাস্তার মাঝেই আমরা নেমে পড়লাম বাংলাদেশের একমাত্র বাটারফ্লাই পার্ক ঘুরে দেখার জন্য। উল্লেখ্য বাটারফ্লাই পার্ক সম্বন্ধে আমি প্রথম ছুটির দিনে একটি ফিচার পড়ি। আর সেই ফিচারের লেখক আর কেউ না, হেলাল ভাইয়া। তাই হেলাল ভাইয়া যেহেতু সাথে আছে তাই কি আর মিস হয় এটা দেখা??

প্রথমে সবাই বলল, ভিতরে প্রজাপতি আছে কিনা সেটা কেউ দেখুক, এরপর অন্যরা যাবে। আমি টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম, কথা ছিল আমি মিসড কল দিলে অন্যরাও টিকিট কেটে ঢুকবে। অস্থির বাংগালি কি আর শুধু শুধু বলে? আমি ঢুকার সাথে সাথেই দেখি আমার আগেই অন্যরা ঢুকে চারপাশ ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। সত্যিই অসাধারণ একটি পার্ক সেটা। না দেখলে মিস করতাম অবশ্যই। মামুন এবং নাফি ধুমসে ছবি তোলায় ব্যস্ত। আসলে ছেলেরা যে নিজেদের ছবি তুলতে এত পাগল হতে পারে তা মামুনকে না দেখে কেউ বিশ্বাস করবেনা। আমরা প্রজাপতি দেখলাম, প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টির সাথে নিজেদের একাকার করে দিলাম। কি অদ্ভুত সুন্দর করে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, ভাবতেই এত প্রশান্তি লাগছিল বলার বাইরে।

(প্রজাপতি পার্কে ঢুকার প্রবেশ পথ)


(মিউজিয়ামের ভিতর)


(আমার ভাইয়ের ফটোশেসান,শেষই হয়না !)


(বাটার ফ্লাই পার্কের প্রজাপতির মিউজিয়াম)


(ছবিঃ বাটারফ্লাই পার্কের কৃত্তিম ঝর্ণা)

প্রজাপতির পার্ক থেকে ছুটে গেলাম টমটম গাড়িতে করে পতেঙ্গার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমরা প্রজাপতি দেখতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে সূর্যাস্ত মিস করলাম। তাতে কি? যেটা কখনই ভাবিনি এবার সাগরের মধ্যে স্পিড বোটে করে ঘুরা মিস করিনি। অবশ্য এখানে সব ক্রেডিট বুবুর। সে যদি খুব সাহস করে স্পিড বোটে উঠার জন্য স্টিমুলেট না করত তাহলে হতনা এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ করার। থ্যাঙ্কস টু বুবু।
ওহ! বলা হয়নি, ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ব্লগার তায়েফ ভাইয়া, আরিফ ভাইয়া।

স্পিড বোটে উঠে সে এক ভয়ঙ্কর,মজার অভিজ্ঞতা। সাতার জানি আমি, কিন্তু বহু বহু বছর কখনও পানিতে নেমে প্র্যাক্টিস করিনি বলে ভুলে গিয়েছি কিনা জানিনা। লাইফ জ্যাকেটেও ছিল বোটে। একটু ভয় ভয় লাগছিল, কিন্তু আনন্দে শিহরিত হচ্ছিলাম আরো বেশি। একবারে অন্যরকম.........

শিহরিত আনন্দ শেষেই গেলাম পতেঙ্গা মার্কেট ঘুরে দেখতে। সাথে ছিলেন আরিফ ভাইয়া। সে আমাদের যাবতীয় যেকোন কিছু কিনতে যেভাবে ডিসকারেজ করতেছিল তাতে আমার মনে হচ্ছিল এই পতেঙ্গার ব্যবসায়িরা যদি জানত তাহলে আরিফ ভাইয়াকে দলবেধে মারতে আসত। একটি জুতা পছন্দ হল, কিনতে যাব ঠিক এই মুহুর্তেই আরিফ ভাইয়া বললেম, ' জুতাটা সুন্দর, সন্দেহ নাই, তবে সেটা পরার জন্য না, শোকেজে সাজায় রাখার জন্য।" এরপর কি আর ওই জুতা কিনার মুড থাকে? নো থ্যাঙ্কস টু আরিফ ভাইয়া।

এরপর নেভাল। ভেবেছিলাম, কিইবা দেখব সেখানে, কিন্তু আরিফার জোরাজুরিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে মনে হল, ভাগ্যিস আরিফা জোর করেছিল। তা না হলে নেভালে বসে রাতের অন্ধকারে পানির বুকে জাহাজ দেখা হতনা। অন্ধকার আকাশ সাথে সাগর আর জাহাজ একইসাথে পাওয়া হতনা। একরকম অদ্ভুত চিন্তার জগতে ঘুরাফেরা করা হতনা। অবশ্য এর মধ্যেই সবাই আর্লি ম্যারেজ এবং নিজেদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে বলে আলোচনা শুরু করে দিল। তাদের সেই আলোচনা মনে হচ্ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে তারা কথা বলছে। আমি ফাকে ফাকে কিছু পার্টিসিপেইট করছি। আর ডুবে যাচ্ছি নিসংগ কিছু ভাবনার জগতে। এত সুন্দর পরিবেশে ভাবনাগুলো কে আর্টিকুলেইট করার সুযোগ কি মিস করা যায়??

এরপর সেদিনের মত ভ্রমন বিরতি দিয়ে রাত ৯টার দিকে সবাই আপুর বাসায় ফিরলাম। জাস্ট একটা ঘুম দিয়েই সকাল ৭টায় চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ড। উদ্দেশ্য রাঙ্গামাটি ভ্রমন। প্ল্যান বুবুর..

সকাল ৮টার বাসে উঠে পড়লাম। এই রাঙ্গামাটি ভ্রমনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্ট ছিল উচুনিচু পাহাড়ের বুক চিরে আকাবাকা পথ বেয়ে, সবুজ পাহাড়ের সমারোহে পুরা রাস্তার দৃশ্য অবলোকন করা। সকালের নাস্তা রাংগামাটিতে সেরেই চলে গেলাম কাপ্তাই লেক ভ্রমনে। দুঃখজনক হলেও সত্য ঝুলন্ত ব্রিজ আর ঝুলে নাই, সেটা পানিতে ডুবে আছে। তাই ঝুলন্ত ব্রিজে আর ঝুলতে পারলমনা। কিন্তু সেজন্য আমাদের রাঙ্গামাটি ভ্রমন একেবারে পানিতে ডুবে যায়নি। সাম্পানে করে সবাই মিলে পানির বুকে বিচরন করলাম ঘণ্টাখানেকেরও বেশি। উফ!! সেটা ছিল এক দারুন অভিজ্ঞতা। মামুন তো সেখানের স্বচ্ছ পানি বোতলে ভরে ঢকঢক করে পান করল। আর তখনি ওর সাথে আমার শুরু হল সিভিক সেন্স নিয়ে তর্ক বিতর্ক। থাক সেটা আর না বলি।


(বাসের জানালা থেকে পাহাড়ি আকাবাকা পথ)


(ঝুলন্ত ব্রিজ এখন ডুবন্ত)


(সাম্পানের উপর থেকে কাপ্তাই লেক)

এরপর সোজা রেস্টুরেন্ট। সেখানে ছুরি শুটকি ভর্তা,সব্জি,ডাল দিয়ে আমি আর বুবু খেলাম। আর মামুন ও যুথি খেল রুই মাছের তরকারি। খুব হাই প্রাইস ছিল খাবারের, এক বাটি শুটকি ভর্তা ৮০ টাকা।

এরপর চট্টগ্রাম ফিরে যাবার টিকিট কাটলাম বিকাল ৪টায়। হাতে দুইঘন্টা সময় ছিল, বেরিয়ে গেলাম রাঙ্গামাটি মার্কেট ঘুরে দেখতে। একটি সুন্দর, বড়, মার্কেটে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে এ.সি। চরম গরমে তখন ওই মার্কেটকে জান্নাতের কাছাকাছি মনে হচ্ছিল। অনেক কিছু কিনব বলে সিলেক্ট করলাম। যা কিনতে ইচ্ছা করে কিন্তু কিনতে পারবনা বলে সাসপেক্ট করলাম সেগুলো নিয়ে বহু ছবি তুললাম। শেষমেষ দুইটি ওড়না কিনেই পাশে একটি সবুজ মাঠে বসে গেলাম আরো কিছু সময় পার করার জন্য। তখনই হিসাব নিকাশ করে দেখি আমার কাছে কোন টাকা আর নাই। মামুনের সাথে তখন ছোট খাট একটি ঝগড়া হয়ে গেল। কারণ সে কোন টাকা দিতে পারবেনা এই ভ্রমনে, সবকিছু বিয়ার করতে হবে আমাকে।

যাইহোক খুব বিরক্ত মন নিয়ে যখন বাসে উঠলাম তখন মামুন আমাকে ৫০০টাকা দিয়ে বলল, "আর কত লাগবে বল? কোথায় কোথায় ঘুরবি, সব টাকা আমি দিব..." মন ভাল হয়ে গেল।থ্যাঙ্কস টু মামুন।

আপুর বাসায় রাত৯টায় পৌছলাম। সেখান থেকে রাত ১০টায় আরিফার নিজ হাতে রান্নার বিশেষ নিমন্ত্রনে চলে গেলাম আরিফার বাসায়। এত মজা লেগেছিল ওর হাতের রান্না, যে আমি প্রতিটা মেন্যু খেয়ে মুগ্ধ। ওর জামাই অনেক লাকি হবে নিঃসন্দেহে।

প্ল্যান ছিল ভোরে কক্সবাজার যাব, কিন্তু হেলাল ভাইয়ায় পা মচকানোর সংবাদের কক্সবাজার প্ল্যানে ভাটা পড়ল। তাই আর ভোরবেলা উঠিনি। সকাল ১০টায় যখন নাশতার টেবিলে সবাই নাশতা করছি তখন মামুন নাছোড়বান্দা আমাদের কক্সবাজারে নিয়েই ছাড়বে। এজন্য নাকি সে গত রাতে দুলাভাইয়ার কাছ থেকে টাকা ধার করে নিয়ে এসেছে। ভাঙ্গা পা নিয়ে হেলাল ভাইয়া আমাদের সাথে গেলেন। আরিফা,যুথি,আমি,মামুন এবং হেলাল ভাইয়া সহ দুপুর ১টার বাসে রওনা হলাম সাগর পানে।

এরমধ্যে যুথির এক্সাইটেশান ছিল সবচাইতে বেশি। সে কখনও সাগর দেখেনি, এবার দেখবে...৪ঘন্টা জার্নি শেষে যখন কক্সবাজার পৌছলাম তখন সন্ধ্যা। হোটেল রিগ্যাল প্যালেসে ২টি রুম ঠিক করে আমাদের যাবতীয় ব্যাগ রেখেই ছুটে গেলাম রাতের সাগর দেখতে।

সাগরের গর্জন ছিল মাইন্ডব্লোয়িং। সাথে সাথে ফোন দিলাম মা কে। সেই ক্লাস ফাইভে থাকতে বাবা-মা সহ কক্সবাজার এসেছিলাম। তখনের অনুভূতি আর এখনের অনুভূতি পুরাই ভিন্ন। মা বলল," এই বয়সে নাকি সামান্য সবুজ ঘাস দেখলেই খুব রোমাঞ্চ লাগবে, আর সাগর, সাগরের ঢেউ তো কথাই নেই"...আসলেই তাই। থ্যাঙ্কস টু মামনি।

জুতা খুলে পা ভিজালাম। সামনে অসীম সাগর, উপরে বিশাল আকাশ, সাথে চাদের আলো, ঢেউয়ের রিদমিক গর্জন..........এক অন্যরকম পরিবেশ। এটাকে বর্ননা করা যাবেনা, ছবি দিয়ে প্রকাশ করা যাবেনা, কাউকে শুনিয়েও তৃপ্তি পাওয়া যাবেনা। এত সুন্দর মোহময় পরিবেশের মধ্যেও হেলাল ভাইয়া এবং মামুন দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের জুতা পাহারা দিচ্ছিল, পানিতে নামার বিন্দুমাত্র তাদের ইচ্ছা হয়নি। নাহ! এতটা ধৈর্যশিল না আমি। সাগর দেখতে এসে যদি সাগরের পানি দিয়ে নিজেকে না ভিজালাম তাহলে আর কি দেখার মানে রইল?



(কক্সবাজারে হোটেলের বারান্দা থেকে সাগরের দৃশ্য)


(সমুদ্র বিলাসে মত্ত তিনটি মেয়ে)

সমুদ্র বিলাস শেষে ঘুরতে বের হলাম বিভিন্ন মার্কেট দেখতে। সেই মার্কেটেই পরিচয় হল বুয়েটের এক স্যারের সাথে। বেচারা এই মধ্য বয়সেও তার ওয়াইফের বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরে নানা জিনিস কেনার পেইন সহ্য করতে হচ্ছে। মেয়েরা কেবল মেয়েই থেকে গেল। এরপর আমরা ঢুকে গেলাম রেস্টুরেন্টে রাতের ডিনারের জন্য। অর্ডার দিলাম লইট্যা মাছের ফ্রাই,শুটকি ভর্তা,গরু, চিংড়ি শুটকি,ডাল,সব্জি ও সাদা ভাত। লইট্যা মাছের ফ্রাই অদ্ভুত টেস্টি একটি খাবার। না খেলে এটাও মিস করতাম।

এরপর রুমে ফিরে গেলাম, গোসল, নামাজ সেরেই ঘুম। সকালে উঠে নাশতা করে আবার সাগর পানে ছুটে গেলাম। টানা দু'ঘন্টা সাগরের পানিতে ভিজলাম। তখনও মামুন এবং হেলাল ভাইয়া আমাদের জুতা ও ব্যাগ পাহারার দায়িত্বে ছিলেন, পানির ধারে কাছেও তারা আসেনি। সাগরে যখন মনের সুখে ভিজতেছি তখন পরিচয় হল ঢাকা মেডিকেলের ফরেন্সিক মেডিসিনের স্যারের সাথে। স্যার তার ছোট মেয়ে নিয়ে সাগরে নেমেছে। আমাদের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি আচরন করলেন, ফেইসবুকে তাকে এড দিতে বললেন। ফেইসবুক একটা জিনিস বটে! ফ্রেন্ড হবার জন্য বয়স সেখানে কোন বাধা দেয়না। আমরা যখন স্যারের ছোট মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম স্যার তখন জানিয়ে দিলেন তার একটি বড় মেয়ে আছে যে কিনা আমাদের চেয়েও বড়। ফ্যামিলি প্ল্যানিং টা দারুন লেগেছিল। যাইহোক সাগরে দৌড়াদৌড়ি,ঝাপাঝাপি, ভেজাভেজি আমরা তিনটি মেয়ে একসাথেই করলাম। আর দূর থেকে আমাদের কেবল পাহারা দিচ্ছিল দু'টি নিরস ছেলে।

এরপর ফেরার পালা। চট্টগ্রামের বাসে ঊঠে পড়লাম ১টার দিকে।মন খুব বিষন্ন ও খারাপ। মনে হচ্ছিল খুব কাছের কাউকে ছেড়ে চলে আসছি। সমুদ্র পাড়ে যদি সারাজীবন থাকতে পারতাম !! সমুদ্র পাড়ের কোন ছেলেকে বিয়ে ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকলে একবার ট্রাই করতাম। !!! সত্যি !!

চট্টগ্রাম পৌছেই ঢাকা ফিরার টিকিট কেটে আপুর বাসায় চলে গেলাম। সেখানে গোসল,খাওয়া,ও রেস্ট নিয়েই রাত ১১টার বাসের উদ্দেশ্যে বিদায় নিলাম সবার কাছ থেকে। যথারীতি ১১টার বাস আসল ১২টায়। মন খারাপ আর ঘুমের মধ্যে শেষ হয়ে গেল আমাদের ভ্রমন। এক নিশীথের চরম উদ্দীপনা নিয়ে যে ভ্রমন শুরু করেছিলাম, চরম মন খারাপ নিয়েই সেই নিশীথেই ভ্রমন সমাপ্তি হল।

শেষ কথাঃ আমরা প্রতি ওয়াক্তের নামাজ বিভিন্ন জায়গায়,বিভিন্ন পরিবেশে পড়েছি। কোথাও জায়গা না থকলে অপরিচিত কাউকে বলতেই সে আমাদের বিশেষ ভি.আই.পি জায়গায় নামাজের প্লেস করে দিয়েছে। রাঙ্গামাটি তে,বাটারফ্লাই পার্কে,মিনি বাংলাদেশ,পতেঙ্গা,কক্সবাজার সবজায়গায় নামাজ আদায় করার অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করার মত। সাগরের বিশালতা যেমন মনে প্রশান্তি এনেছিল, কিংবা সবুজ পাহাড় মনে রোমাঞ্চ যুগিয়েছিল তখন বুঝেছিলাম কৃত্তিম সৌন্দর্যের কাছে সৃষ্টিকর্তার আর্কিটেকচারের কোন তুলনায় হয়না। কারন ঢাকায় ফেরার পর প্রজাপতি পার্ক কিংবা মিনি বাংলাদেশের অনুভূতি আমাকে টানেনি যতটা এখনও টানে অদম্য সাগরের ভিজে যাওয়া, ঢেউয়ের গর্জন, রাতের সমুদ্রে চন্দ্রাসক্ত হবার স্মৃতি, সবুজ পাহাড়ের সাথে না বলা বহু বাক্য......
আর চট্টগ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে যারা আমাদের সংগ দিয়েছে তাদের বন্ধুবাৎসল্যের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড : চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি-কক্সবাজার-ঢাকা
বিষয়শ্রেণী: ভ্রমন কাহিনী

কোন মন্তব্য নেই: