শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৩

হাটি হাটি পা পা......




পাঁচ বছরের ছেলে আবির। বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান। খুব কিউট চেহারা। একটি অনুষ্ঠানে সব মায়েরা যেখানে গল্প করে সেখানে আবিরের মা খুব গর্বের সাথে অন্য এক ভাবিকে বলছে তার ছেলে সিনেমার নায়কের মত বিকেলে খেলতে গিয়ে কোন মেয়েকে ফুল দিয়েছে। এটা শুনে সবাই হাসছে আর আবিরকে আদর করে অনেকেই বলছে একদম নায়কের মত হবে দেখতে। সব মেয়েরা পিছনে ঘুরে বেড়াবে।
ঘটনাটা খুব সাধারণ একটি ঘটনা। কিন্তু এই পাঁচ বছরের বাচ্চার নিজস্ব জগতে ঘটনাটা মোটেই সাধারণ না। পরিবার, পরিবেশ কিভাবে একজন বাচ্চাকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে সেটার উপর ব্যাসিস করেই এই সিরিজ লেখা চলবে। আমাদের বাবা-মায়ের ভূমিকা কতটুকু এবং বাচ্চাকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনটা নেগেটিভ ও পজিটিভ সেটাই এই সিরিজে ফুটে উঠবে ইনশয়াল্লাহ।
শিশুদের জগত আর আমাদের বড়দের জগত একেবারেই আলাদা। আমরা বড়রা যখন একটি শিশুকে ধীরে ধীরে বড় হতে দেখি তখন যদি এই শিশুর জগতের সাথে একেবারে মিশে না যাওয়া যায় তাহলে শিশুদের নিজস্ব জগতের হাসি,কান্না, আবেগ, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জগতে বিরাট আলোড়ন ঘটে যায়। একটা নেগেটিভ ইম্প্যক্ট নিয়ে শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
আচ্ছা বাচ্চাদের জগতের সাথে আমাদের জগতের পার্থক্য কোথায়?
বাচ্চাদের ব্রেইনের গঠন শুরু হয় মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যখন তার বয়স মাত্র তিন সপ্তাহ। বাচ্চা পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই তার কিছু প্রাইমারি ব্রেইন গঠন পূর্ণ হয়ে যায়। যেমনঃ কান্না করা, হাত-পা নাড়াচাড়া, ফিডিং রিফ্লেক্স, আই কন্ট্যাক্ট ইত্যাদি। বাচ্চাদের ব্রেইনের সাথে বড়দের ব্রেইনের পার্থক্য হল বাচ্চাদের ব্রেইন অনেক বেশি ইম্প্রেসনেবল। অর্থাৎ তাদের যত ইনপুট দেয়া তারা সেটাকেই ক্যাপচার করবে। কিন্তু আমাদের কোন ইনপুট দেয়া হলে আমরা সাথে সাথেই সেটা ক্যাপচার করবনা। আচ্ছা আপনার খুব অভ্যাসগত বিষয়কে কেউ যদি এখন বদলে দিতে চায় সেটা কি আপনি মেনে নিবেন? নিবেননা। কিন্তু বাচ্চাদের এই ইম্প্রেসনেবল ব্রেইন যেকোন ইম্প্রেসন সাথে সাথেই তাদের ব্রেইনের নিউরনে সিন্যাপ্স তৈরি করে ফেলবে। ফলে যত ধরনের ইনপুট আপনি দেননা কেন এতে বাচ্চা মোটেই বিরক্ত হবেনা।
ব্রেইনের পরিপূর্ণ গঠন নির্ভর করে জেনেটিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর । একটু সহজভাবে বুঝিয়ে বলি। একটি টেলিফোন লাইনের কথা চিন্তা করেন। যেখানে সব ডিজিট নির্দিষ্ট ও নেটওয়ার্ক কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে সেটাও নির্দিষ্ট। কিন্তু আপনি এই টেলিফোন লাইন দিয়ে কিভাবে আপনার নেটওয়ার্ক মেইনটেইন করবেন, কাদের সাথে কথা বলবেন, কি কাজে কথা বলবেন সবই অনির্দিষ্ট। জেনেটিক ব্যাপারটা ঠিক টেলিফোন লাইনের ডিজিট ও নেটওয়ার্কের মত, এখানে কারো কোন হাত নেই। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ হল এই টেলিফোন আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন সেটা নির্ধারণ করে।
জন্মের পরপরই ব্রেইনে নিউরনের সংখ্যা থাকে প্রায় ১০০বিলিয়ন। বাচ্চা যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখন এই নিউরনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়না বরং এক নিউরনের সাথে আরেক নিউরনের সংযোগ বৃদ্ধি পায় যাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় সিনাপ্স। এই সিনাপস্পই মূলতঃ শিশুর ব্রেইনকে ধীরে ধীরে পরিবেশের সাথে ম্যাচিউর করে তুলে। সিনাপ্সের কার্যকারিতা নির্ভর করে মায়েলিনেশানের উপর। মায়েলিনেশান হল পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার যোগ্যতা। অর্থাৎ একটি বাচ্চাকে যখন আপনি কোন কমান্ড করবেন তখন সেটা প্রথমে সে শুনবে এরপর এই কমান্ড তার ব্রেইনে গিয়ে আপনার কমান্ডকে প্রোসেসিং করে কি করতে হবে সেটা নির্দিষ্ট করবে, এরপর বাচ্চাটি আপনার কমান্ড অনুসরন করবে। এই যে এত ধীর গতিতে বাচ্চাটি কাজটি করবে এটার কারণ হল দূর্বল মায়েলিনেশান। অর্থাৎ এক নিউরনের সাথে আরেক নিউরনের সংযোগ বৃদ্ধি পাবেনা যদিনা মায়েলিনেশান ঠিকমত না হয়।
শিশুদের ব্রেইনের সিনাপ্স তিন বছর বয়সে প্রায় ৮০%, পাঁচ বছর বয়সে ৯০% পূর্ণ হয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধিতে সিনাপ্স প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এজন্য একজন বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকে যে ভাষায় শিক্ষা দিবেন ঠিক সে ভাষাই সে সুন্দরভাবে রপ্ত করে ফেলবে। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পর যে ভাষা সে শিখবে সেটার কিছু দুর্বলতা থাকবে। যেমন বাংলা ভাষার একজন শিশু যখন বয়ঃসন্ধির পর ইংরেজি ভাষা শিখবে হয়ত সে ব্যাকরণ, শব্দভান্ডার, কথা বলা সবই শিখতে পারবে কিন্তু উচ্চারনগত একটা বাঙ্গালিয়ানা ভাব থেকেই যাবে। ইংরেজদের মত করে উচ্চারন হবেনা কিছুতেই। আসলে বয়ঃসন্ধির পর ব্রেইনের ইম্প্রেসনেবল ক্যপাবিলিটি ধীরে ধীরে কমে যায়। সিনাপ্স পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই নতুন কিছু শেখা মানেই পুরান কিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুছে যাওয়া।
যাইহোক ব্রেইনের কার্যক্ষমতা আসলে ইলেক্ট্রিক্যাল সারকিটের মত। যত বেশি পরিবেশের সাথে ব্রেইন পরিচিত হবে তত বেশি নিউরনাল সার্কিট তৈরি হবে। বাচ্চাদের এই সার্কিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জন্মের পরপরই বাচ্চার সাথে মা কথা বলছে, গান গেয়ে শুনাচ্ছে, বিভিন্ন গল্প করছে এতে করে বাচ্চা কথা কিছু না বুঝলেও তার নিউরনাল সার্কিট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সে কোন ব্যাকরন, শব্দভান্ডার ছাড়াই কেবলমাত্র শুনে শুনে সে কথা বলা শিখে যাবে।
বয়সভেদে শিশুদের ব্রেইনের ম্যাচিউরিটি বিভিন্ন হয়ে থাকে। একেক বয়সে শিশু একেকরকম ভুবন গড়ে তোলে তার নিজের মধ্যে। এই ভুবন গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি যারা ভূমিকা রাখেন তারা হলেন পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন প্রমুখ। এই ভুবন গড়ে তোলার মুহুর্তে যদি বাচ্চাকে আমাদের অজান্তেই নেগেটিভলি আমরা স্টিমুলেশান দেই তাহলে সেটার পরবর্তি ফলাফল হবে খুব অপ্রত্যাশিত।
ছয় মাসের বাচ্চা কিংবা দুই বছরের বাচ্চার সাথে যদি সঠিক প্যারেন্টিং গাইডলাইন না থাকে তাহলে বাচ্চার মানসিক, শারীরিক উভয়ই মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই শিশু লালন-পালন বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন ও আগ্রহী হওয়া খুব জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই: