শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

হোস্টেল লাইফ-৫

হলে উঠার পর প্রথম যে ব্যাপারে আমি আর তনিমা উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেটা হল হলের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রতিদিন হল পরিষ্কার করার জন্য একজন বুয়া আসে কিন্তু তারপরও বাথরুম খুব নোংরাই থাকত। কারণ টা ছিল মেয়েরা খুব অসচেতন। দেখা যাচ্ছে শ্যাম্পুর প্যাকেট, প্যাড, বিভিন্ন কাগজ বাথরুমে পড়ে থাকে। এরপর দোতলায় যে পানির ফিল্টার আছে, দেখা যায় সেই ফিল্টার থেকে অনেকেই গ্লাস, বাটি এসব ওয়াস করছে এবং আল্টিমেইটলি পুরা জায়গাটা নোংরা করে রাখতে একটুও দ্বিধা করছেনা। খুব দৃষ্টি কটু হলেও সবাই সেটার সাথে মানিয়ে নিচ্ছে।
একদিন আমি আর তনিমা এব্যাপারে সিনিয়র এক আপু ও আমাদের কিছু ব্যাচমেটের সাথে কথা বললাম। সবাই এব্যাপারে বিরক্ত, কিন্তু কেউ কোন উদ্যোগ নিবেনা এটার বিরুদ্ধে। সুতরাং আমরাই উদ্যোগটা নিলাম। অনেকগুলো কাগজে কতগুলো রুলস এবং রেগুলেশান মানার জন্য সবাইকে নির্দেশনা দিয়ে হলের সবজায়গায় লাগিয়ে দিলাম। অস্বাভাবিক পজিটিভ রেসপন্স পেলাম। দেখলাম পরেরদিন থেকেই সবাই সেই রুলস মেনে পরিবেশ পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে সহায়তা করছে। এটা ছিল আমাদের উদ্যোগের খুব সামান্য একটা দিক, কিন্তু এই সামান্য দিক থেকে বুঝতে পারলাম যে আপামর জনসাধারণ উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকবে, তবু নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করবেনা

এরপর হলের রুমে দেখা যায় যখন তখন একেকটা ফ্রেন্ড সার্কেল খুব জোরে জোরে হাসাহাসি, ঠাট্টা, ফাযলামি করছে, অন্যদিকে কেউ ঘুমাচ্ছে। একদিন একজন খুব বিরক্ত হয়ে এব্যাপারে আমার সাথে কথা বলছিল, অনেকটা অভিযোগের সুরে যে কেন তারা ঘুমানোর সময় এরকম হাসাহাসি করে। আমি আর তনিমা সাথে সাথেই বললাম তাহলে তোমরা সাথে সাথে কেন সেটা নোটিফাই করে দাওনা তাদের? কিন্তু অন্যরা কি মনে করবে, এতজনের একটা ফ্রেন্ড সার্কেলের বিরুদ্ধে সে এটা নিয়ে কথা বলবে কেমন দেখায়? বুঝলাম স্বকীয়তা জ্ঞান অধিকাংশ মেয়ের মধ্যে নাই। অনেকেই অনেক ব্যাপারে চরমভাবে সাফার করছে, কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছেনা। অনেকটা সাইলেন্ট ডিক্টেটরশীপ চলছে কোথায় যেন! সুতরাং একদিন আমি এবং তনিমা অনেক গল্পোচ্ছলে এব্যাপারে অন্য সবার সাথে আলোচনা করে এ ডিসিসানে পৌছলাম যে দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে জোরে জোরে হাসাহাসি, ঠাট্টা, ফাযলামি করা যাবেনা। আমাদের ওই উদ্যোগটাও সেদিন মারাত্বকভাবে কাজে লেগেছিল।
এরপর আরেকদিন সার্জারি ওয়ার্ডে যাব বলে সন্ধ্যার দিকে হল থেকে বের হলাম কয়েকজন একসাথে। জরুরি বিভাগের সামনে দিয়ে যেতেই দেখি একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা খুব ইমার্জেন্সি কন্ডিশানে আছে। কিন্তু কেউ তার ধারে কাছেও ঘেষছেনা, তার সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছেনা। আমরা সেদিন সাথে সাথে সেই মহিলাকে গাইনি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলাম। কিন্তু কোন বেড খালি নাই, বলে ফেরত দেয়া হল। রোগীর অবস্থা এমন ছিলনা যে তাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাব। সুতরাং তনিমা আর আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলামনা, বাকিরা আমরা কি করি সেই আশায় আছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই মহিলার চিকিৎসা এই হাসপাতালেই করতে হবে যেভাবেই হোক। সুতরাং অনারারি একজন চিকিৎসক ছিলেন তাকে ব্যাপারটা খুলে বলার পর তিনি রাজি হলেন এই শর্তে যে আমরা যদি মহিলাটার কোন ক্ষতির দায়িত্ব নিতে পারি তাহলে তিনি লেবার রুমে ঢুকাবেন। আমরা কোন কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলাম।

পরবর্তিতে সেই মহিলার ডেলিভারিতে প্রচুর সময় লাগল, এবং একটা সময় পরিস্থিতি এতই খারাপ হল যে গাইনি ডিপার্টমেন্টাল হেড ছাড়া সেই কেইস কেউ আর ডিল করতে পারছেনা। রাত তখন ৯টা বাজে। হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি এম্বুলেন্সে করে মিরপুর গিয়ে সেই হেড ম্যাডাম কে নিয়ে আসা হল, এরমধ্যে আমাদের এক ফ্রেন্ড রক্তের জন্য সন্ধানিতে চলে গেল। সবমিলিয়ে যখন রাত দশটা বাজে তখন লেবার রুমে সব চিকিৎসকরা ঢুকলেন আবার। ততক্ষনে মহিলার অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। যাইহোক এরপর বাচ্চা ডেলিভারি হল, কিন্তু শিশু বিভাগে তখন স্পেশালিস্ট ছিলনা তাই সেই মুহূর্তে বাচ্চাকে নিয়ে আমি, তনিমা আর একজন ফ্রেন্ড চলে গেলাম সিএনজি তে করে মিরপুর শিশু হাসপাতালে। সেখান থেকে আমাদের হাসপাতালে যখন ফিরলাম তখন রাত বারটা বাজে।
জানিনা সেদিন অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজ হঠাৎ ঝোকের মাথায় করেছিলাম, শুধু এই চিন্তা করে যে আমাদের এটা করতে হবে, করা উচিত। বাকিটা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছুইনা, কারণ সেদিনের পর গাইনি চিকিৎসকরা আমাদের ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন এরকম ঝুকিপূর্ণ কাজে আমাদের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এরকম কেইসে ভিন্ন ঘটনাও ঘটে যেতে পারত, নানা ধরনের ঝামেলাতেও আমরা জড়িয়ে পড়তে পারতাম।
রাত সাড়ে বারটায় বাচ্চার বাবা যখন হাসপাতালে আসলেন তখন প্রথমেই বাচ্চার খালাকে জিজ্ঞাসা করলেন ছেলে হয়েছে না মেয়ে হয়েছে? আমি সামনে ছিলাম, খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওই প্রশ্ন শুনে। এতক্ষন কোন খবর ছিলনা, এখন আসছে ছেলে না মেয়ে এই খবর নিতে! মেজাজ সামলে সেই লোকটাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম।

এই হচ্ছে আমাদের সার্বিক পরিবেশের কিছু খন্ডিত চিত্র। যেখানে ভাল কাজে কেউ উদ্যোগ নেয়না, ঝুকিপূর্ণ কাজ বলে সামনে কেউ এগোতে চায়না। তবে সবার উদ্যোগে অনেক ঝুকিপূর্ণ বড় কাজও নিমেষেই করে ফেলা সম্ভব সেটা হলে থেকে প্রথমবারের মত প্র্যাক্টিক্যালি অনুভব করলাম।

( আপাতত চালানোর আর ইচ্ছা নাই...)

কোন মন্তব্য নেই: