শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

হোস্টেল লাইফ-৪

বন্ধুত্বের প্রকৃত সংগা আসলে কি? এই বন্ধুত্ব নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি কনফিউশানে ছিলাম। মেডিকেলে দেখতাম একঝাক গ্রুপ ফ্রেন্ড নিয়ে একেকটা ফ্রেন্ডশীপ গড়ে উঠে। একেকটা গ্রুপে ৩জন থেকে শুরু করে ১০জন পর্যন্ত থাকে। ইন্টারমিডিয়েটে থাকতে আমাদের ৭জনের একটা গ্রুপ সার্কেল ছিল। সেটা কেবলই বন্ধুত্ব ব্যতিত আর কিছু না। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স তিনগ্রুপের মিলে মোট সাতজন। জমজমাট ছিল আমাদের ওই বন্ধুত্ব। এখন আমরা সেই সাত জন সাত জায়গায়। ভাবতেই কষ্ট লাগে।

যাইহোক মেডিকেলেও চারপাশে একেকটা গ্রুপ সার্কেল তৈরি হতে লাগল। আমারও একটা সার্কেল তৈরি হল ৫জন মিলে। কিন্তু কয়েক মাসের ভিতরে সেই সার্কেলে ২জন বের হয়ে গেল, বাকি রইলাম তিনজন। খুব তুচ্ছ এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ছাড়াছাড়ির ঘটনা। আমি কিছুটা শকড। কিন্তু সেবারই বুঝতে পারলাম যে আমি অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করি যেটা অন্যরা করতে পারছেনা।
এরপর তিনজন মিলেই একসাথে হলে উঠা। সাবরিনা যদিও হলে রেগুলার আমাদের সাথে থাকতনা, কিন্তু আমি আর তনিমা রেগুলার থাকতাম। হুম, মেডিকেলে প্রথম আমার যে ঘনিষ্ঠ হয় সে হচ্ছে তনিমা। খুব স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড মেয়ে সে। ওর এই গুনটাই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত। কিন্তু মাঝে মাঝে ওর এই গুণের মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ অন্য সবার জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে যেত। আমিও চরম স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড মেয়ে, কিন্তু ওর কাছে আমার এই গুন কিছুইনা। কারণ আমি পরিবেশ বুঝে ব্যালান্সড আচরন করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ও কোন কিছুকেই কেয়ার করতনা। সুতরাং হলে উঠে অন্য সবার সাথে প্রথমেই তনিমার কিছুটা বিবাদ শুরু হতে লাগল। আমি সবসময় ব্যাপারটা ডাইলিউট করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হতনা। খুব একরোখা ও জেদি টাইপ ছিল তনিমা।
একদিন হলে সিনিয়র এক আপুর সাথে ওর তুমুল আকারে ঝগড়া বেধে গেল। কারণ টা খুব নগন্য। আসলে সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশানে অলিখিত কিছু শর্ত থাকে, তনিমা সেই শর্ত মানতনা বলেই ঝগড়ার সূত্রপাত। আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম সবক্ষেত্রে এক্সট্রিম আচরন করা ঠিক না। কিন্তু এতে তনিমা আমাকে ভুল বুঝে।এরপর মেইন যে কারণে তনিমার সাথে আমার বন্ধুত্ব টিকেনি সেটা নিছক কোন ঝগড়া নয়।
বন্ধুত্বের সংগাতে ফিরে যাই। হলে আমার রুমে ছয়জনের এক সার্কেল আছে। খুব এক্সপ্রেসিভ তারা, ডমিনেটিংও বটে। নিচতলার রুমেও তিনজনের এক সুন্দর ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। এছাড়াও আরো অনেক ফ্রেন্ড সার্কেল ক্যাম্পাসে ছিল,কিন্তু যেহেতু তারা হলে ছিলনা তাই ওদেরটা বিস্তারিত বলবনা।
ছয়জনের ফ্রেন্ডশীপ খুব জটিল ছিল। কিন্তু দেখতাম একজন কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ করে অথবা ভুল পথে যায় অন্যরা কেউ সেটাকে বাধা দেয়না। বরং জেনেশুনে তারা নিজেদের কাছের বন্ধুকে ভুল পথে যেতে সহায়তা করে। এধরনের বন্ধুত্ব আমাকে এবং তনিমাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। একদিন নয় বহুদিন আমি,তনিমা এবং সাবরিনা বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। সারারাত হলের বারান্দায় রাত জেগে এসব নিয়ে অনেক গল্প করেছি। আলোচনার টপিকস ছিল সত্যিকার বন্ধুত্ব আসলে কি?
সবাই আমরা একমত হয়েছিলাম সত্যিকার বন্ধু আসলে সে, যে অপর বন্ধুর দর্পন স্বরূপ। অর্থাৎ দর্পনে যেমন সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায় বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও তাই। আমি যদি অপরাধ, অন্যায়, ভুল করি অন্যজন দর্পনস্বরূপ সেটা দেখিয়ে দিবে, এটাই স্বাভাবিক।
ক্যাম্পাসে তখন হঠাৎ করেই হিন্দু-মুসলিম এফেয়ারের ঘটনা বেড়ে গেল। নিচতলার সেই তিন ফ্রেন্ডের একজন এর মধ্যে ছিল। আমরা এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা করলাম, কিন্তু ওদের ফ্রেন্ডশীপ আসলে কি ছিল জানিনা, তাদের এটা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। এরপর সেই ছয় ফ্রেন্ডের মধ্যেও এরকম কেইস ঘটে গেল, কিন্তু বাকি ফ্রেন্ড তাদের এটা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। বরং যে জিনিস দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম সেটা হল তারা অবলীলায় একটা অন্যায়কে ঢাকতে বন্ধুর জন্য গার্ডিয়ানের কাছে মিথ্যা বলল। যেখানে হবার কথা ছিল এক বন্ধু অন্যের অন্যায়কে শুধরে দিবে সেখানে জাস্ট উলটা হল। একজন অন্যজনের অন্যায় কাজে সহায়তা করল।
আমি জানিনা বন্ধুত্ব কি নিছক আড্ডা মারা, গল্প করা, লাইফ এনজয় করা? নাকি একটা আইডিওলজিক্যাল প্ল্যাটফর্মে সবার একাত্বতা ঘোষণা করা। এই প্ল্যাটফর্মে একজন অপরের দর্পন। অন্তত আমার,তনিমা আর সাবরিনার কাছে ব্যাপারটা এরকমই ছিল।
কিন্তু তনিমার সাথে বন্ধুত্বের এক বছর পরেই আমি ধীরে ধীরে টের পেলাম তনিমা একটা বড় অন্যায় করতে যাচ্ছে যেটা তার জন্য চরম ভুল সিদ্ধান্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি ওকে ওর ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করে দিলাম। ভাল লেগেছিল যে তনিমা সেদিন স্বীকার করেছিল যে সে আসলেই ভুল করতে যাচ্ছিল এবং আমাকে সে ভুল বুঝেনি। কিন্তু আবেগিক ভালবাসার কাছে তনিমার প্রখর যুক্তিবোধ হার মেনেছিল। তাই সে নিজেকে ভুলের স্রোত থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি, নিজেই ভেসে চলে গেছে ভুলের সাগরে।
তনিমার সাথে বন্ধুত্বের গভীরতা সেদিন থেকে ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। কারণ হলে তনিমা বেশি থাকতনা, ওর তখন লাইব্রেরিতে পড়ার আগ্রহ বেশি। একদিন তনিমার বাসা থেকে ওর মা ফোন করে আমার কাছে তনিমার ব্যাপারে জানতে চাইল। আমি মিথ্যা বলতে পারিনি কিছুই। আমি চেয়েছিলাম তনিমা ভুল থেকে ফিরে আসুক যেমন তনিমার মা চায়। কিন্তু সেদিন থেকেই তনিমা আমাকে ভুল বুঝা শুরু করল। কেন জানিনা আমিও তনিমার ভুল ভাঙ্গাতে চাইনি আর। কারন আমাদের ফ্রেন্ডশীপের কমন প্ল্যাটফর্ম ততদিনে ভেঙ্গে গেছে। সাবরিনা এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার কোন মানে নেই। কারণ আমাদের বন্ধুত্ব নিছক লাইফ এনজয় করার জন্য ছিলনা। ইনফ্যাক্ট তনিমাও বুঝে গিয়েছিল যে আমার সাথে ওর ফ্রেন্ডশীপ আর থাকবেনা, কারণ আমরা দুজনই দুজনকে ভালভাবে চিনতাম ও বুঝতাম।

অতঃপর কেবল আমি আর সাবরিনা। সাবরিনা হলে থাকতনা। যদিও খুব খারাপ লেগেছিল তারপরও তনিমার সাথে আমার আর সেভাবে বন্ধুত্ব আর রক্ষা করা গেলনা। আসলে আমি চেয়েছিলাম সবসময় ওর পাশে থাকতে কিন্তু তনিমা নিজেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল, আমি কাছে যাবার প্রেরণা হারিয়ে ফেললাম।
তনিমার সাথে বন্ধুত্ব টিকেছিল ২বছর। এরপর সুমাইয়া, যাকে আমি সবচেয়ে খারাপ মেয়ে বলেই জানতাম। হলে থাকার সুবাদেই আমি বন্ধুত্বের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলাম, নিজেকে চিনতে পেরেছিলাম। অন্যায়কে মেনে নেবার মত কিংবা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার মত বন্ধু আমি হতে পারিনি, এই ব্যাপারটা আমার নিজের কাছে কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরল। এরপর তনিমা ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্বের আসল সংগাতে কেউ এক হতে পারিনি বলেই বন্ধুত্বটা সবসময় সুপারফিশিয়াল থেকে গেছে। কারণ বর্তমান বন্ধুত্ব কেবল নিছক শাব্দিক বন্ধুত্ব শব্দে বন্দী। কেউ কারো দর্পন না এখানে। তাই অবলীলায় এক বন্ধুকে অন্য বন্ধু অন্যায় কাজে সহায়তা করতে পারে।
সুমাইয়ার সাথে একদিন এরকম আলোচনা করছিলাম তনিমাকে নিয়ে। হলে তখন তনিমা ছিলনা। সুমাইয়া আমাকে তনিমার ব্যাপারে প্রশ্ন করাতেই আলোচনার সূত্রপাত। তনিমার সাথে আমার বন্ধুত্বের বিচ্ছেদের কারণ সুমাইয়া খুব ভালভাবেই বুঝতে পারল। শুধু যে বুঝতে পারল তাই নয়, সুমাইয়া আমাকে সেদিন শান্ত্বনা দিল যে একমাত্র সত্যিকার বন্ধু মাত্রই এরকম অনুভব করতে পারে যেরকম আমি তনিমার জন্য করতাম। হুম, সুমাইয়ার সাথে বন্ধুত্বের শুরু আমার সেদিন থেকেই হল...

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

কোন মন্তব্য নেই: