শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

আসুন, প্রযুক্তির অপব্যবহারের ভয়াল গ্রাস থেকে আমাদের কচি প্রাণ শিশুদের বাচাই!!

একটা মুভি দেখছিলাম “ফাইনাল ডেসটিনেশান”। আমি, ফাহিম, যুথী, মহিমা, আনিকা সবাই মিলে। ইনফ্যাক্ট মুভি আমরা দেখছিলামনা, রায়হান দেখাচ্ছিল। সে আমাদের মুভির ফোকাসিং পার্টগুলো দেখাচ্ছিল। এরকম প্রায়ই আমরা সব কাজিনরা মিলে মুভি দেখি। কিছুদিন ধরে কয়েকটা ব্যাপার মাথার মধ্যে খুব ঘুরপাক খাচ্ছিল। থ্রিতে পড়া ফাহিমের সাথে মুভি দেখতে গিয়ে ভাবনাটা আরো বেশি সিভিয়ার হল। মুভিটাতে যাইহোক না কেন, যুথী সেগুলো দেখে ভয়ে অস্থির। আমি নরম্যালি যেকোন ভূতের ছবি দেখলে ভয় পাব কিন্তু বাস্তব কিছু দেখলে সেরকম ভয় পাইনা। একারনে রক্তারক্তি, খুনোখুনি দেখতে আমার ভাল না লাগলেও আমি কখনও ভয় পাইনা। সুতরাং খুব আগ্রহ নিয়ে ফাইনাল ডেস্টিনেশান দেখছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, মুভিতে যতবারই কেউ মারা যাচ্ছে, কিংবা মারা যাবার দৃশ্য যত ভয়ংকর হচ্ছে ফাহিম তত বেশি এক্সাইটেড হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট কেউ মারা গেলে আমি ভয় না পেলেও, যে মারা যাচ্ছে তার জন্য খুব দুঃখ লাগতেছে। কিন্তু ফাহিম দুঃখ তো পাচ্ছেইনা বরং, আনন্দিত হচ্ছে। আরে! আমি ফাহিম কে বললাম,- ভাইয়া তোমার এত্ত আনন্দের তো কিছুই নাই। এত্ত এক্সাইটেড কেন? সে জবাবে খুব অবাক হয়ে বলল,--আনন্দিত হবনা? এত্ত ফাটাফাটি একশানধর্মী ছবি! জোস!

ঠিক একইধরনের ঘটনা ঘটেছিল তার দুই দিন আগে। দুই ভাগ্নে এসেছিল বাসায়। একজন ক্লাস টু তে আরেকজন ক্লাস সেভেনে। চরম উদ্যমে তারা কম্পিউটারে গেইম খেলছিল। আমি কখনও কম্পউটারে গেইম খেলিনি। আসলে হয়ত পারিনা বলে খেলিনা। তো সেদিন তারা খেলছিল “ভাইস সিটি” নামে একটা গেইম। আমি ওদের খেলা একটু পর্যবেক্ষন করলাম। আসলে আগ্রহ ছিল কিভাবে এত ছোট বাচ্চারা গেইম খেলে, যা কিনা আমিও পারিনা। ওদের খেলা দেখে তো মাথা গরম হবার মত অবস্থা। গেইমের থিম হচ্ছে , একজনকে খুন করতে হবে, বিনিময়ে টাকা পাওয়া যাবে। এরপর শুরু হল মিশন। যখন তখন কারো গাড়ি ছিনতাই করা, পুলিশ কে ঘুশ দিয়ে ম্যানেজ করা, নিয়ম ভায়োলেইট করা, রাস্তা-ঘাটে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বিনা কারণে ছিনিয়ে নেওয়া, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা, পার্টি-ক্লাবে যাওয়া, অনিয়মের মাধ্যমে টাকা ইনকাম করা, মোটকথা বাই হুক অর ক্রুক; মিশন সাকসেসফুল হওয়া। আমি ওদের মুখে ভার্চুয়াল বিভিন্ন অস্ত্রের নাম ও ব্যবহার শুনে পুরাই তাজ্জব হয়ে গেলাম। ক্লাস টু তে পড়ে যে ভাগ্নে তার ছোট ভাই যে এখনও স্কুলে যায়না, সেও এই গেইম ভাল খেলতে পারে। জানিনা পাঠকের কাছে হয়ত ব্যাপারটা খুব হালকা লাগছে। কিন্তু আমার কাছে খুব ভয়ঙ্কর লাগছে ব্যাপারটা।

একটি বাচ্চা জন্মের পর থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা সব কিছু নিয়ম ভংগ করে খেলাতে জয়ী হওয়াকে বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। আর কার্টুন তো সাথে আছেই। কার্টুনেও সেইম কেইস হচ্ছে। একটা বাচ্চার সাইকোলোজিতে একদম ছোটবেলা থেকেই অন্যায় টা বিনোদন হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে বিনোদন তাই নয়, বাবা-মায়েরাও সেই বিনোদনে উৎসাহ দিচ্ছে। তারা ভাবছে, --বাচ্চা মানুষ খেলছে, এ আর এমন কি!

এতদিন তো আমি যে বিষয় নিয়ে চিন্তায় ছিলাম তা হল, বড়দের কথার মধ্যে বাচ্চারা আছে কিনা সেটা খেয়াল রাখা, কিংবা টিভিতে তারা কি দেখছে সেটা খেয়াল রাখা। এখন দেখছি তারা কি খেলে, কি কার্টুন দেখে সেটাও চিন্তার বিষয়।উফ! আমাদের পূর্বের যুগের বাবা-মায়েরা কি শান্তিতেই তা না ছিল। তাদের তো এত কিছু চিন্তা করত হয়নাই। তখন কম্পিউটার এত এভেয়লেবল ছিলনা, ভাইস সিটির মত গেইম ছিলনা।

চারপাশের ফ্যাক্টর বর্তমান যুগে বাচ্চাদের জন্য কতটা হুমকি স্বরূপ। টিভি, বিজ্ঞাপন, কার্টুন, গেইম সর্বোপরি বাচ্চারা যেসব জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে তা কতটা ভয়াবহ খারাপের দিকে লিড করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অজান্তে। নীরবে দূষন করে দিচ্ছে আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের কোমল, নিষ্পাপ মন কে। একটু ও কি ভেবে দেখছি ব্যাপারটা আমরা?

প্রযুক্তির বিরুদ্ধে আমি কখনও নই। এসব নিরব পয়জনিং থাকা সত্বেও আমি চাইনা যে বাচ্চারা কম্পিউটার থেকে দূরে থাকুক, গেইম না খেলুক, কার্টুন না দেখুক। এসব আমার দাবি না। ইনফ্যাক্ট আমি এই দাবি করলেও খুব হাস্যকর লাগবে। কারণ আমাদের বাবা-মায়েরা রাতের বেলা শুধু গল্প শুনিয়ে মন ভুলিয়ে রাখত, আমরা দাদী/নানীর কাছে রূপকথার গল্প শুনেই বড় হয়েছি। কিংবা টিভিতে মীনা কার্টুন দেখেছি, আর বিকেল হলেই খেলতে গিয়েছি। কিন্তু এখন তো বাচ্চাদের বিনোদনের ডাইমেনশান অনেক বড় হয়ে গেছে। তাদের শুধু গল্প শুনিয়ে তাদের ডিমান্ড পূরন করা যাবেনা। কারণ আপনি হয়ত একা চেষ্টা করবেন, কিন্তু চারপাশের আবহাওয়াকে আপনি থামাবেন কিভাবে? আপনার বাচ্চা এসে যখন বলবে --তার সব ফ্রেন্ডরা কম্পিউটারে গেইম খেলে, কার্টুন দেখে, তাকে কেন দেখতে দেওয়া হয়না? তখন আপনি একা কিভাবে আপনার বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রন করবেন?

এবার আসি, কিভাবে বাচ্চাদের এই স্রোত থামানো যায়ঃ


আমার কিছু আইডিয়া এসেছে। আপনাদের মতামত প্রত্যাশা করি।
যারা ইঞ্জিনিয়ার, ইনফ্যাক্ট যারা গেইম বানাতে পারে তারা উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। আমি যতদূর শুনেছি কম্পিউটার সায়েন্স হচ্ছে সেই সাবজেক্ট যেখানে স্টুডেন্টরা গেইম বানাতে পারে। সুতরাং কম্পিউটার সায়েন্স যেসব ভাইয়া-আপুরা পড়াশুনা করছেন তারা প্লিজ এটা নিয়ে একটু ভাবুন। আর যারা এনিমেটর আছেন তারাও দয়া করে যদি এগিয়ে আসতেন বাচ্চাদের সুন্দর ভবিষ্যত রক্ষায়। আর আমরা যারা যেভাবে পারি এব্যাপারে সচেষ্ট হই, সচেতনতা বাড়াই। হয়ত এটা আপনার ক্যারিয়ারে খুব কাজে আসবেনা ডিরেক্টলি, কিন্তু এটা শিউর যে আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের সাইকোলোজি ডেভেলপ করতে অনেক দূর কাজে লাগবে। আমরা যত আধুনিক হচ্ছি তত রিস্কি হয়ে পড়ছে আমাদের চারপাশ। বাচ্চাদের জগত আরো বেশি রিস্কি হয়ে পড়ছে। তাই আপু এবং ভাইয়া রা প্লিজ আপনারাই পারেন কিছু করতে এখানে, কিছু অবদান ইচ্ছা করলেই রাখতে পারেন। দেখেন না, পারেন কিনা বাচ্চাদের জন্য কোন সুন্দর, শিক্ষনীয় গেইম বানাতে। যেখানে নিয়ম ভংগ করলে জরিমানা, অবৈধ টাকা ইনকাম করলে পয়েন্ট কাটা, সাধারণ মানুষের কোন ক্ষয় ক্ষতি করা যাবেনা, নিয়ম মেনে চললে বোনাস ইত্যাদি এরকম। এতে করে বাচ্চাদের সাইকোলোজি সুন্দর ভাবে ছোটবেলা থেকেই তৈরি হবে, তাদের কাছে কোন মানুষের করুণভাবে মৃত্যু জোস লাগবেনা, তাদের ছোট ছোট অনুভূতিগুলো যেন একশানধর্মী ফাটাফাটি মারামারির মধ্যে বিনোদন হয়েই শেষ না হয়ে যায়। এরকম ধংসাত্বক বিনোদন হতে তাদের দূরে রাখার প্রয়াসে আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। 
তাই, আসুন, প্রযুক্তির ভয়াল গ্রাস থেকে আমাদের কচি প্রাণ শিশুদের বাচাই!! সবাই মিলে...

কোন মন্তব্য নেই: