শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

হোস্টেল লাইফ-৬

ঢাকায় থাকি বলে সবসময় হোস্টেলে থাকা পড়েনা। তারপরও মেডিকেলে হোস্টেলে থাকাটা কিছুটা বাধ্যতামূলক। তা না হলে পড়াশুনা করা যায়না। আমার তো এখন ভাবতেই অবাক লাগে কিভাবে মানুষ বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। হোস্টেলে না থাকলেও এটলিস্ট লাইব্রেরিতে বসে রিডিং পার্টনারের সাথে পড়া ছাড়া আমি বাসায় একা একা পড়াশুনার কথা ভাবতেই পারিনা। সেকেন্ড প্রফ শেষ হল। বলা যায় প্রায় টানা আড়াই মাস হোস্টেলে আছি। মাঝখানে একদিন-দুইদিন করে মাঝে মাঝে বাসায় বেড়াতে যেতাম।

আসলে হোস্টেলে লাইফের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হল মানুষকে চেনা, বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরো বেশি উপলব্ধি করা। আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে হল এই তো পাচ মাস হল। ওর ধারণা ছিল জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হল হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। বাকি সব সম্পর্ক কারো সাথে না থাকলেও চলে। ও ভেবেছিল বন্ধুত্বের সম্পর্কও হাজব্যন্ড দিয়ে ফিল আপ করা যাবে। কিন্তু কি আর করা, ভাইয়াও ডাক্তার। সময় দিতে পারেনা একটুও। তাই আমার ফ্রেন্ড একটু দুঃখ করে বলছিল আসলে জীবনে সব সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই যে হোস্টেলে আছি, ফ্রেন্ডের সাথে পড়ছি, অনেক কিছু শেয়ার করছি এটা তো আর সবার সাথে শেয়ার করা যায়না। বন্ধুদের সাথে যেটা শেয়ার করা যায় তা কি আর হাজব্যান্ডের সাথে শেয়ার করা যায়? কিংবা হাজব্যান্ডের সাথে যা শেয়ার করা যায় তাতো আর বন্ধুদের সাথে করা যায়না।

আবার বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝেও অনেক ধরনের সম্পর্ক থাকে। সেই সম্পর্কও মেইনটেইন করা শেখা যায় হোস্টেলে থেকেই। আমার হয়ত তিনজন ফ্রেন্ড খুব ক্লোজ, কিন্তু তারপরও আমার কোন ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে হয়ত আমি কেবল একজনকেই সব শেয়ার করব। কিংবা আমি যাকে খুব ফ্রেন্ড ভাবছি সে আমাকে আদৌ তা হয়ত ভাবছেনা। যাকে ফ্রেন্ড মনে করে অনেক কিছু শেয়ার করলাম সে হয়ত সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলনা। এরকম বন্ধুত্বের মাঝে বহু সম্পর্ক থাকে যা আসলে ডিফাইন করা যায়না। কিন্তু তারপরও আমরা সবাই ফ্রেন্ড।

হোস্টেলে থাকার ফলে আমি যে জিনিসটা খুব প্র্যাক্টিক্যালি শেখার চেষ্টা করেছি তা হল এটিচিউড পরিবর্তন করা। প্রতিটা মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। একেকজন একেকরকম। আমার চিন্তা-ভাবনার সাথে হয়ত সবাই মিলে যাবেনা। হয়ত আমি যেরকম করে একজনকে নিয়ে ভাবি, সে আমাকে নিয়ে ভাববেনা। আবার আমাকে নিয়েও কেউ হয়ত একরকম চিন্তা করবে, আমি মোটেই সেরকম না। এরপর বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কিছুটা ফাটল। একটা কথা আছে, নিজে ভাল তো জগত ভাল। এই ব্যাপারটা আসলেই তাই। নিজে যদি সবসময় যেকোন সিচুয়েশানে এটিচিউড পজিটিভ রাখতে পারি তাহলে সব সমস্যা নিমেষেই শেষ।

থিওরিটিক্যাল এরকম বহু কথা এর আগে আমি শুনেছি। কিন্তু যে আমাকে ভুল বুঝল, মনে করল আমি তার আসল বন্ধু না, এজন্য হয়ত এমন কিছু কাজ করল যা কখনই পজিটিভ এটিচিউড দেখানোর মত মানসিক পরিস্থিতি থাকেনা। কিন্তু এই সি্চুয়েশানেও যদি পজিটিভ এটিচিউড দেখানো যায় তাহলে অন্যরকম একটা আউটপুট পাওয়া যায়। একেবারে প্র্যাকটিক্যাল, কোন হাইপোথিসিস না।

কিন্তু এর জন্য যেটা দরকার সেটা হল নিজের প্রতি পর্যবেক্ষন। আমি কখনই ১০০% সঠিক না। অন্য কেউও ১০০% সঠিক না। কিন্তু সবার মাঝেই অবশ্যই ভাল কিছু থাকে যা সবকিছুর উপরে থেকে তার প্রতি পজিটিভ এটিচিউড দেখানো যায়। একজন যদি ভাল নাও হয় , জেনে রাখতে হবে সে একেবারে খারাপও না। তার সেই ভাল দিক চিন্তা করেই পজিটিভ এটিচিউড দেখাতে হয়।

জীবনের আসলে অনেক অর্থ আছে। জীবনে অনেক কিছু করার আছে। ছোট এই জীবনে শুধু শুধু মাইনর ব্যাপার নিয়ে সম্পর্কের মাঝে একটি অবিশ্বাস তৈরি করার কোন মানে নাই। কারো সাথে শত্রুতা মনোভাব নিয়ে থাকারও কোন মানে নাই। কেউ আমাকে বন্ধু ভাবুক আর নাই ভাবুক আমি অন্তত কাউকে শত্রু ভাববনা। এই পজিটিভ এটিচিউড যদি নিজের মধ্যে গ্রো করানো যায় তাহলে দেখা যায় সময় গুলো আর বন্ধুদের সাথে অন্য কারো সমালোচনা, গীবত করে কাটেনা। বন্ধুদের সাথে সময়গুলো আরো বেশি মধুর আর অর্থবোধক হয়ে উঠে। জীবনের আসল মিশন থেকে দূরে গিয়ে আর অন্যের ব্যাপারে শত্রুতা পোষণ করাকে তখন খুব বোকামি মনে হয়। মনে হয় আসলে সত্যিই বন্ধুত্ব একটি অন্যরকম উপহার।

বন্ধুত্বের প্রতি না কেবল, জীবনের সকল সম্পর্কের প্রতি যদি পজিটিভ এটিচিউড দেখাতে পারি তাহলে আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই সুন্দর হয়ে উঠবে যা আগে কখনও এত সুন্দর হয়ে দেখা দেয়নি। মনে হবে এই একটি মাত্র জীবনে আসলে ইরিভারসিবল বলে কিছু নাই। সবকিছুই রিভারসিবল হতে পারে। যাকে কখনই ক্ষমা করবনা বলে মনে করা হয় সেই হতে পারে জীবনের পরম বন্ধু। যে ভুল কখনই শোধরানো যাবেনা বলে মনে হয় সেই ভুল থেকেই কেউ হয়ত আরো বেশি শুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।

হোস্টেলে থেকে আসলে বিভিন্ন বন্ধুর সাথে পজিটিভ এটিচিউড দেখানোর একটি প্র্যাক্টিক্যাল প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যায়। আর সেটা যদি জীবনের সকল সম্পর্কেও এপ্লাই করা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। !!!

কোন মন্তব্য নেই: