শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

হোস্টেল লাইফ-১

গ্রুপ স্টাডি মেডিকেল লাইফে খুব সাধারণ একটি ঘটনা। মেডিকেলের পড়াশুনা যত কঠিনই হোকনা কেন এই গ্রুপ স্টাডি পড়াশুনার জন্য অন্যরকম খোরাক যোগায়। সামনে পরীক্ষা, অবশ্য পরীক্ষা সর্বদা সামনেই থাকে! আমি আর আমার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবি সুমাইয়া প্ল্যান করছিলাম কবে থেকে হলে থাকব। বিশাল এক পড়াশুনার প্ল্যান নিয়ে হলে উঠব এরকমই চিন্তা আমাদের। আগে থেকে বলে রাখি আমি কোনদিনও রুটিন মাফিক পড়াশুনা করতে পারিনি। যতবারই পড়াশুনার জন্য প্ল্যান করেছি সব ভেস্তে গেছে নিমেষেই। তাই নিজের উপর বিশ্বাস নেই। সুমাইয়াকে বললাম, তুই প্ল্যান কর। সুমাইয়া খুব কনফিডেন্ট একটি মেয়ে। সে সুন্দর একটি প্ল্যান করে ফেলল। যেদিন আমরা হলে উঠব তার দুইদিন আগে শারমিন সুমাইয়াকে বলে রাখল যে সে আমাদের সাথে পড়বে। খুব ভাল কথা, তিনজন একসাথে পড়ব।
প্ল্যান অনুযায়ী হলে উঠে গেলাম দ্রুত। বিকেল চারটা থেকে সবাই পড়া শুরু করব। ঘুমকাতুরে আমি ঘুম থেকে উঠলাম বিকেল সাড়ে চারটায়। ফ্রেশ হয়ে পড়াশুনা স্টার্ট করতে করতে পাচটা বেজে গেল। প্ল্যান থেকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে গেলাম অলরেডি। যাইহোক বাকি দুজনের গোসল, খাওয়া-দাওয়া,প্রিপারেশান নিতে নিতেই আমার মত পাঁচটা বাজল।
প্যাথলোজি মেইন টেক্সট বই, সাথে তিনটা গাইড, পেন্সিল, পেন, মার্কার নিয়ে তিনজন একসাথে বসে গেলাম। উল্লেখ্য আমাদের তিনজনের বৈশিষ্ট্য পুরাই ভিন্ন। যেমন আমি, যখন পড়তে বসি তখন পড়া বাদ দিয়ে অন্য গল্প করলে খুব বিরক্ত হই। সুতরাং যখনি দেখি তিনজন গল্পে মেতে উঠছি তখনি আমি তাগাদা দেই মেইন বইয়ে মনোযোগ দেবার জন্য। সুমাইয়া, তার বৈশিষ্ট্য হল কিছুক্ষন পর পর চ্যাপ্টার শেষ হতে আর কত পৃষ্ঠা বাকি সেটা কাউন্ট করা। পড়াশুনার ফ্রিকোয়েন্সি যত বাড়তে থাকে তার এই পৃষ্ঠা গুনার ফ্রিকোয়েন্সিও বাড়তে থাকে। আর শারমিন, ওর খুব ইউনিক বৈশিষ্ট্য। পড়তে পড়তে হঠাৎ করে তার মার্কার খুজে পাচ্ছেনা, এই মার্কারের জন্য আধা ঘণ্টা ব্যয় করবে তবুও পড়বেনা।
যাইহোক, আমরা তিনজন খুব ডিটারমাইন্ড, হেপাটোবিলিয়ারি সিস্টেম পড়ে শেষ করতেই হবে। কারণ পরের দিন আইটেম আছে। আইটেম হল মেডিকেলের একটি টার্ম যার মানে কোন একটা নির্দিষ্ট চ্যাপ্টারের উপর দশ নাম্বারের ভাইভা পরীক্ষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার তা হল আইটেমে দশ নাম্বারের জন্য যত বেশি পড়া লাগে তার পুরা ১০০ নাম্বারের জন্য এত বেশি পড়া লাগেনা। কারন আইটেমে নির্দিষ্ট টপিকসের উপর জোর দেয়া হয়।
পড়া শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনজনের বৈশিষ্ট্য প্রকট হতে শুরু করল। বলা বাহুল্য, পড়ছি আধা ঘণ্টা আর বাকি আধা ঘণ্টা গল্প। এভাবেই ঘণ্টার কাটা যেতে লাগল। তিনভাগের একভাগ পড়া শেষ করলামলিভার সিরোসিসে মলিকিউলার মেকানিজম পড়েই চিন্তা করলাম আরে! আমরা তো অনেক পড়ে ফেলেছি। তাহলে এখন একটু গল্প করা যায়। এভাবেই একটু একটু পড়া আর গল্প চলতে লাগল। আমি যদিও গল্প না করার তাগাদা দিচ্ছি তবুও আমিই গল্পে দারুন ভাবে পার্টিসিপেইট করতে লাগলাম।

এভাবে রাত দশটা বেজে গেল। খেতে গেলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে আবার স্টার্ট করলাম। যেভাবেই হোক হেপাটোবিলিয়ারি সিস্টেম শেষ করতে হবে। রাত এগারটা নাগাদ এক ফ্রেন্ডের কাছে খবর পেলাম পরেরদিনের আইটেম ক্যান্সেল করা হয়েছে। ব্যস! পড়ার মুড তখনি দুই ধাপ নিচে নেমে গেল।
উল্লেখ্য,আইটেম হবে কি হবেনা সেটা টিচারের উপর ডিপেন্ড করেনা। ব্যাচের সবার ডিসিসানের উপর আইটেম হয়। অন্তত থার্ড-ফোর্থ ইয়ারে আমরা এরকম ফ্রিডম পেয়ে থাকি। তবে কিছু আতেল ব্যাচ থাকে যারা রেগুলার আইটেম দেয়। আইটেম সবাইকেই কমপ্লিট করা লাগে। তবে রেগুলার আইটেম না দিলে পরে লোড বেশি পড়ে যায়, এই যা! তবে আমরা যারা রেগুলার আইটেম দেইনা তারা মনে করে থাকি মেডিকেল লাইফটাই হচ্ছে ওভার লোড। সুতরাং এসব আইটেমের লোড কোন ব্যাপারনা। সুতরাং পুরা ব্যাচ বেশিরভাগ সময়ই সিদ্ধান্ত নেই রেগুলার আইটেম দিবনা, পরে সেগুলো বেশি করে আইটেম নিয়ে কাভার করে দিব।পরের দিন আইটেম হবেনা এই নিউজে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। কারণ এখন হাজার চেষ্টা করেও পড়ার মুড দুইধাপ উপরে নিতে পারবনা।

এরমধ্যে আমার ভাইএর কাছে ফোন করলাম। ওরা গেছে সুন্দরবন ট্যুরে। ব্যাপক মজা করতেছে। এটা শুনে মেজাজ আরো খারাপ হতে লাগল। ধুর! মেয়ে হয়েছি বলে কি ওদের মত আমরা লাইফে মজা করতে পারবনা? এসব আজাইরা চিন্তা করতে করতে পড়ার মুড একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এল।
বাকি দুজন এতক্ষন জ্বীন-ভূতের গল্প করতেছিল। আমি এসব মারাত্বক ভয় পাই। যদিও বিশ্বাস করিনা, কিন্তু ভয় নামক ব্যাপারটা আমার পুরা অন্তর জুড়ে ব্যপৃত থাকে। ওরাও যে ভয় পায়না তা না। কিন্তু সেই ভয়কে ওরা বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। যেহেতু ভয় আমার কাছে ভয়ই তাই বিনোদন হিসাবে নিতে পারিনি। ওদের বললাম টপিকস চেইঞ্জ করতে। কিন্তু ওরা আমার অবস্থা দেখে পূর্ণ উদ্যোমে নতুন করে জ্বীন-ভূতের গল্প শুরু করল। এই আলোচনা চলল রাত দুইটা পর্যন্ত। আমি ইতোমধ্যে ভয়ে অস্থির। ওরা আমাকে দেখে খুব মজা পাচ্ছে। পরে সেই ভয়ার্ত মন নিয়েই রাত তিনটার দিকে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমানোর সময় অবশ্য সুমাইয়া আমার পাশেই ঘুমাল, তাই ভয় কিছুটা কম পেলাম।
এভাবে মহা প্ল্যানের একটি দিন ভয়ের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেল।

(চালানোর ইচ্ছা আছে...)

কোন মন্তব্য নেই: