বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রজন্ম

১.
বর্তমানে যে বাসায় আছি সেখানে যেদিন প্রথম আসি লিফটে খুব হাস্যোজ্জল এক আংকেলের সাথে পরিচয় হয় । আলাপচারিতায় জানতে পারলাম উনি আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন । খুব আনন্দের সাথে উনি জানালেন তার ওয়াইফ এবার গল্প করার সঙ্গি পাবে । অনেকদিন ফ্ল্যাটটি ফাকা ছিল বিধায় তার ওয়াইফ খুব নিঃসঙ্গ অনুভব করতেন ।
যাইহোক পরবর্তিতে জানতে পেরেছিলাম আংকেল পাকস্থলির ক্যান্সারে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন, সাথে ছিল ডায়াবেটিস । একদিন উনার কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করে দেখলাম উনার ক্যান্সার ছিল এমন পর্যায়ে যা অপারেশানের উপযুক্ত না । কিছুই খেতে পারতেন না তিনি । যা খেত তাই বমি হয়ে যেত। উনার মৃত্যুর শেষ কয়েকটা মাস উনি কেবল ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইডের উপর বেচে ছিলেন । প্রায়ই সময় আমাকে যেতে হত উনার শিরায় ফ্লুইড চালু করে দেবার জন্য । জীবনে রিজিক আল্লাহ উনাকে ভরপুর করে দিয়েছেন । ব্যাঙ্কে টাকা পয়সা অগণিত । দুই ছেলের নামে দুইটা ফ্ল্যাট কিনবেন বলে মনস্থির করেছেন । মৃত্যুর আগেও উনি কেবল স্ত্রী,সন্তান নিয়ে চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকতেন । কিন্তু ফ্ল্যাট কিনে দেবার পূর্বেই একদিন আল্লাহর ডাকে উনি পরপারে পাড়ি জমান ।
উনার মৃত্যুর ঠিক চল্লিশ দিন পর চল্লিশা অনুষ্ঠানে বিল্ডিং এর সবাইকে দোয়া করার উদ্দেশ্যে দাওয়াত করা হয় । বাসায় হুজুর এনে কুরআন শরীফ খতম দেওয়ানো হচ্ছে । আমার বাবা গেলেন দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে । বাসায় গিয়ে আংকেলের দুই ছেলেকে নিয়ে একসাথে দোয়ার উদ্দেশ্যে ডাকলেন । বড় ছেলে বাসায় ছিলনা, ছোট ছেলে এসে জানাল তার খুব মন খারাপ । আমার বাবা আর বাকি হুজুর সবাইকে মন ভরে দোয়া করতে বললেন । এরপর মাগরিবের আযান দিয়ে দিল । আব্বু আবার ছোট ছেলেকে ডাকতে গেলেন । ছোট ছেলে এবারও জবাব দিল, ‘ আংকেল আপনারা মসজিদে গিয়ে আব্বুর জন্য দোয়া করবেন ,ওতেই হবে ।‘ এরকম জবাবে আব্বু তো পুরাই তাজ্জব হয়ে নামাজ পড়তে চলে গেল ।

২.
এক পরিচিত আন্টির স্বামী মারা গেলেন । মারা যাবার মাসখানেক পর দেখি আন্টি ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে যায় মন ভাল করার উদ্দেশ্যে । ছেলে-মেয়েরা ফেইসবুকে ছবি আপলোড দেয় মা কে নিয়ে । বাবাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণমূলক কথা লিখে । বাবার ছবি আপলোড দিয়ে ছবির ক্যাপশানে লিখে “ বাবা তোমাকে ছাড়া কোথাও যেতে ভাল লাগেনা , তুমি যেখানেই থেক ভাল থেক “। কমেন্টে বন্ধুরা সান্ত্বনা দেয় । বন্ধুরা লিখে R.I.P Uncle. যদিও কারও মৃত্যুতে ইন্নানিল্লাহ পড়ার নিয়ম কিন্তু এই R.I.P এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে । অতঃপর প্রতি বছর বছর মৃত্যু দিবসে হুজুর ডেকে কুরআন শরীফ খতম করিয়ে পালিত হয় ।

৩.
জীবনে একবার একজন মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের চিকিতসা খরচ ঊঠানোর উদ্দেশে এক মুভি শো তে গিয়েছিলাম । জানতাম না এব্যাপারে কিছুই। কাছের ফ্রেন্ডরা সবাই যাচ্ছে বিধায় আমিও গেলাম । মুভি শো এর টিকিটের সব টাকা দিয়ে সেই মেয়ের চিকিতসা খরচ বহন করা হবে । এই নিয়ে ফেইসবুকে ইভেন্ট খোলা হয়েছিল । এরপরের অভিজ্ঞতা ছিল খুব তিক্ত । মুভি শো তে ছেলে মেয়েরা খুব আয়েশ করে মুভি এনজয় করছে । মাগরিবের আযান দিয়ে দিল, কোন বিরতি নেই । দিব্যি সবাই মানবিক তাগিদে একজনের চিকিতসা খরচ দেবার জন্য মুভি দেখার উসুল আদায় করছে । উঠে গেলাম ওখান থেকে। সোজা বাসায় । সুস্থ করার মালিক যিনি তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কেবল টাকা দিয়ে একজনের সুস্থতা কামনা করার মত বোকামির জন্য নিজেকেই বারবার ধিক্কার দিলাম । আর কাউকে যদি সাহায্য করতেই হয় তাহলে কেন সেটা মুভি দেখে উসুল করতে হবে? এরকম আরো অনেক অনেক ইভেন্ট দেখেছি ফেইসবুকে। কনসার্ট, মুভি কোনটাই বাদ নেই । গান,বাজনা,সিনেমা দেখে সাদাকা করার এই নিউ থিম কোথা থেকে এল আমি আজও বুঝতে পারলাম না ।
মৃত্যুর পর যে আমল সবসময় জারি থাকে তার মধ্যে অন্যতম হল সন্তানের দোয়া । কিন্তু সেই সন্তান যদি হুজুর ডেকে দোয়া পড়িয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে তাহলে বাবা-মায়ের বিন্দুমাত্র উপকার আসেনা । যে বাবা-মা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানের ভালর জন্য সারাজীবন এত পরিশ্রম করে গেলেন তার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কি কেবল ফেইসবুকে বন্ধুদের নিয়ে মন ভাল করার উদ্দেশ্যে মুভি দেখতে গেলেই শেষ হয়ে যায় ? আমরা কি বাবা-মা কে ভালবাসি? সত্যিই যদি ভালবাসি তাহলে তাদের হক আমরা কতটুকু আদায় করছি? আল্লাহর কাছে দোয়া করি এরকম সন্তান যেন আমরা না হই আর এরকম সন্তান যেন আমাদের না হয় ।

কোন মন্তব্য নেই: