শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মেহমান

আব্বু- আম্মু হজ্বে যাবার এক সপ্তাহ পূর্বে যখন ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়িতে গেল সবার সাথে দেখা করতে তখন একদিন আব্বু হঠাত ফুফুর বাড়ি যাবার পথে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ফোন দিয়ে আমি সাথে সাথে ঢাকায়
আসতে বললাম। তারা আরো দুইদিন পর
ঢাকায় আসল।

আমি আব্বুকে নিয়ে কার্ডিওলোজি ডিপার্টমেন্টে দেখালাম।স্যার কে দিয়ে ইকো করালাম। রিপোর্ট
খুউব খারাপ। রিপোর্ট রিভিউ
করাতে আরেকজন প্রফেসর স্যার
কে দেখালাম। সেই স্যার রিপোর্ট খুউব
খারাপ এবং আব্বুর হার্ট চেইক
করে আরো কিছু
পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে দিলেন।
সাথে ইকো রিপিট করতে বললেন
আরেকজন বিখ্যাত এবং দক্ষ
কার্ডিওলোজিস্টের কাছে। 

আমার এক ছোট ভাইয়ের সহায়তায়
সেখানে অতি দ্রুত প্রথম সিরিয়াল
নিয়ে আবার আব্বুর ইকো রিপিট করালাম।
সেখানেও একই রিপোর্ট। সেই স্যার
নিজেও হজ্জ করে এসেছেন গত বছর তার
মা কে নিয়ে। আমাকে আব্বুর রিপোর্ট
নিয়ে বললেন এই মুহূর্তে হজ্জ জীবনের
জন্যই হুমকিপূর্ণ। সামান্য দুই কদম হাটার
মত ক্যাপাসিটি আব্বুর হার্টের নেই। দ্রুত
অপারেশান ছাড়া অন্য কোন অপশন নেই।

এসব শুনে বাসায় আম্মুকে ডিটেইলস
জানালাম। তখন হজ্জ ফ্লাইটের আর মাত্র
দুইদিন বাকি। সব আত্মীয় স্বজন
এসে আব্বুকে সান্তনা দিচ্ছে আর ফ্লাইট
ক্যান্সেল করার পরামর্শ দিচ্ছে।সবার
যুক্তি হজ্জের চেয়ে জীবন বড়।

আমি নিজে আব্বুর শারীরিক অবস্থা পূর্ণ
অবগত হওয়া সত্ত্বেও আব্বুকে হজ্জ
ক্যান্সেল করার কোন পরামর্শ দিচ্ছিনা।
আমার মা তো আব্বুকে প্রতিনিয়ত
আধ্যাত্মিক এবং মানসিক সাপোর্ট
দিয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহর ঘরে মেহমান
হতে যাচ্ছে সেখানে আমি ডিমোরালাইজ
আব্বুকে কিভাবে করব? আমি খুউব মেন্টাল
স্ট্রেইসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। মৃত্যু
কে তো আমরা কেউই এভয়েড
করতে পারবনা। আল্লাহর কাছেই
আমাদের সবাইকে ফেরত যেতে হবে।
আল্লাহর ঘরে মেহমান
হতে গিয়ে যদি আল্লাহর কাছেই
চলে যেতে হয় তাহলে এটা তো সৌভাগ্য।
আমি মনে মনে এরকমভাবে নিজেকে সেট
আপ করছিলাম।

আত্মীয় স্বজনের ডিমোরালাইজেশান
উপেক্ষা করে আমাদের সাপোর্টে আব্বু
মানসিক শক্তি নিয়ে আল্লাহর
ঘরে মেহমান হতে আমাদের কাছ
থেকে বিদায় নিলেন।

এরপর হজ্বে যাবার মাত্র ৩দিন পর আমার প্রাণপ্রিয় দাদী মারা গেলেন।দাদীর এই হঠাত মৃত্যুর খবর সবার নিষেধ সত্ত্বেও
আমি আব্বুকে সাথে সাথে ফোনে জানালাম।
আব্বু খবর পেয়ে সরাসরি কাবা ঘরের
সামনে গিয়ে দাদীর জন্য
কান্নাকাটি করে দোয়া করতে লাগলেন।
দাদীকে যখন কবরে নামানো হয়
তখনো আব্বু কাবার সামনেই।
আমি দাদী হারানোর শোকে মানসিক
প্রশান্তি পাচ্ছিলাম
এটা ভেবে যে আমার দাদী কত
সৌভাগ্যবান যে মৃত্যুর পর যে সওয়াবের
দরজা খোলা থাকে সেটা দাদী কত
প্রকটভাবে পাচ্ছে। স্বয়ং তার
ছেলে আল্লাহর ঘরে গিয়ে হাত তুলে মন
প্রাণ ভরে সর্বোচ্চ আবেগ
নিংড়িয়ে দোয়া করছে। দাদীর
পরকালের প্রথমধাপ না জানি কত সুন্দর
আর মহিমান্বিত হচ্ছে!
আলহামদুলিল্লাহ।

দাদীর আকস্মিক মৃত্যুর দুইদিন পর আব্বু
উমরা করতে গিয়ে অজ্ঞান
হয়ে পড়ে গেলেন। এদিকে আমার
মা হজ্জে যাবার পর
থেকে ফোনে প্রতিদিন বলছে যে আব্বুর
অবস্থা খুব খারাপ।এক পা হাটলেই
হাপিয়ে উঠছে।

অজ্ঞান হবার পর ওখানে হঠাতই এক
বাংলাদেশি যুবক আমার মা কে সব রকম
হেল্প করল। এম্বুলেন্স খবর দেওয়া,
আব্বুকে ওখানকার নিকটস্থ
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা সব
সেই যুবকই করে দিলেন। আমার
মা তাকে চিনেনা। সেই যুবক আমার
মাকে যাবার পূর্বে শুধু বলে গেলেন
আন্টি, বৃদ্ধ বাবা মা আমার সাথে তাই
আংকেল কে হাসপাতালে দেখে আসতে পারলাম
না। এরপর সেই যুবকের সাথে আর
দেখা হয়নি আমার মায়ের।

হাসপাতালে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেলে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয় আব্বুকে। আই.সি.ইউ তে ডিউটিরত তিন
বাংলাদেশি ডাক্তার হঠাত আব্বুর
পরনে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ দেখে দ্রুত
আব্বুর কাছে চলে আসেন। 

আমার মা কে আব্বুর সমস্যা জিজ্ঞাসা করতেই
আমার মা ফোন দিয়ে আমাকে,আমার
জামাই এর সাথে কথা বলিয়ে দেয়।
আমরা ফোনে সেই ডাক্তারকে আব্বুর
হার্টের কন্ডিশান ডিটেইলস
বলে দিলে তারা আব্বুকে দ্রুত আই.সি.ইউ
তে নিয়ে যায়।
এরপর ইসিজি,ইকো,সিটি স্ক্যান সহ আব্বুর
ফুল চেইক আপের পর সেই হাসপাতাল
থেকেই কার্ডিওলোজি হাসপাতালে রেফার্ড
করা হয়। সেখানে আব্বুর মেজর
অপারেশান হয়। আব্বুর ভালভ
রিপ্লেইসমেন্ট সার্জারি হয়।

পোস্ট অপে আব্বুর অপারেশানের
ডিটেইলস জেনে আমি আমাদের
হাসপাতালের কার্ডিওলোজি স্যারের
সাথে কনসাল্ট করি।

স্যার বললেন, মেকানিক্যাল ভালভের
বদলে টিস্যু ভালভ যদি ওখানে রিপ্লেইস
হয় তাহলে বুঝতে হবে প্রচুর
দামি এবং পারফেক্ট অপারেশান
ওখানে হয়েছে।

বাসায় এসে আব্বুর কাছে খোজ
নিয়ে জানলাম যে মেকানিকাল ভালভ
এর পরিবর্তে টিস্যু ভালভ রিপ্লেইস
হয়েছে। আমি শুনে শুধু বললাম
আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর ছিল আরো ভয়াবহ কঠিন সময় আমার
বাবা মায়ের জন্য। অপারেশানের দুইদিন
পর আব্বুকে আই.সি.ইউ তে রেখেই আমার
মা কে মদিনায় চলে যেতে হয়। মেজর
অপারেশানের পর আব্বুর মানসিক
অবস্থা আমার মা কে কাছে না পেয়ে পুরাই
ভেংগে পড়ে।

এদিকে দেশে থেকে আমরা খুউব অস্থির
হয়ে পড়ি আব্বুর এই কন্ডিশানে।
মাঝে মাঝে ওখানকার বাংলাদেশি ডাক্তারের
সাথে ফোনে কথা হলে একটু রিলাক্স হই।
আর সর্বোপরি নামাজে শুধু
দোয়া করে যাই।

অবশেষে এক অবিশ্যাস্য
মিরাকেলে হজ্জের কঠিন পাচটা দিন
অনেক ঝক্কি ঝামেলার আড়ালে আব্বু
আম্মু দুজনেই হজ্জের কাজ সুসম্পন্ন করেন।আব্বু হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে হজ্বের সব কাজ সম্পন্ন করতে পারবে, এটা ছিল কল্পনার বাইরে।
আলহামদুলিল্লাহ।

এদিকে সব রিলেটিভরা আব্বুর ব্যয়বহুল
চিকিতসা খরচের জন্য অস্থির হয়ে যায়।
আমিও কিভাবে টাকা পাঠানো যায়
সে ব্যবস্থা করতে লাগলাম।কিন্তু এটাও
এক মিরাকেল যে আব্বুর
ওখানে চিকিতসার ও অপারেশানের জন্য এক পয়সাও খরচ
করতে হয়নি। সেই যুবক যে আমার
মা কে এম্বুলেন্সের
ব্যবস্থা করে হাসপাতালে পাঠায়
ওটা ছিল সরকারি হাসপাতালে,কোন
প্রাইভেট হাসপাতাল না। আর
সরকারি হাসপাতালে হাজিদের জন্য
সৌদি সরকার সম্পূর্ন
বিনামূল্যে উন্নতমানের
চিকিতসা সেবা দিচ্ছে। মিরাকেলের পর
মিরাকেল।

আমি ফোনে সরকারি হাসপাতালের
কথা শুনে কেবল চোখে আমার
হাসপাতালের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে।
নোংরা পরিবেশ,অনুন্নত ব্যবস্থা,বিস্বাদ
খাবারের
কথা চিন্তা করে চোখে পানি এসে গেল
আব্বুকে একা একা ওখানে থাকতে হচ্ছে ভেবে।
পরক্ষনেই আব্বু জানাল ওখানকার
সরকালি হাসপাতাল আমাদের দেশের
এপোলো ক্যাটাগরি হাসপাতাল। এটুকু
শুনে বললাম আলহামদুলিল্লাহ।

গতকাল আব্বু-আম্মু হজ্ব থেকে দেশে ফিরেছে।আব্বু আম্মুকে কাছে পেয়ে শুধু এটুকু
উপলব্ধি করলাম আল্লাহর উপর পূর্ণ
তাওয়াক্কুল করলে কি অভাবনীয়
ব্লেসিং আল্লাহ আমাদের প্রতিনিয়ত
দিয়ে যায়। 
আল্লাহর ঘরে মেহমান
হতে গিয়ে আব্বুকে যে মেহমানের
আতিথেয়তার ব্যবস্থা আল্লাহ করলেন
এরকম সর্বশ্রেষ্ঠ আতিথেয়তা পাবার
সুযোগ যেন আল্লাহ আমাকে খুব শিঘ্রই
দান করেন।
আমীন।

কোন মন্তব্য নেই: