বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

একটি সমাজ, অত:পর তার বোঝা.....

সবেমাত্র তখন ৩/৪ দিন হল নতুন এক ক্লিনিকে জয়েন করেছি । জুনিয়র এক ইন্টার্নের অহর্নিশ অনুরোধের ফলে ওই ক্লিনিকে ডিউটি করা । ক্লিনিকের হালচাল বুঝতে না বুঝতেই একদিন সকালে তিনজন লোক আমার চেম্বারে প্রবেশ করে ।
১ম জনঃ বাচ্চা নষ্ট করাতে চাই ।
আমিঃ এখানে বাচ্চা নষ্ট করা হয় না ।
১ম জনঃ যত টাকা লাগে আমি দিব ।
আমিঃ আচ্ছা ... টাকা পয়সা দিয়ে এসব আমি ম্যানেজ করিনা । আপনি অন্য জায়গায় ট্রাই করেন ।
এই কথা শুনে তিনজন লোক ঊঠে পাশের রুমে গেল ক্লিনিক মালিকের সাথে কথা বলতে । প্রায় ঘন্টাখানিক তারা কথা বলে সেদিন চলে গেল ।

২য় দিন
পুনরায় ওই তিনজন লোকের প্রবেশ আমার রুমে । টেবিলে কয়েকটা ইনভেষ্টিগেশানের কাগজ রাখল । খুব বিনয়ের সাথে প্রথম জন বলল-
- ম্যাডাম ,খুব বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করেন ।
- কিঞ্চিত একটু নরম স্বরে বললাম, কি বিপদ ?
- আসলে ডাক্তারের কাছে কোন কিছু লুকাতে নেই । তাই বিনা সংকোচে বলছি, আমার ওয়াইফের পেটে যে সন্তান সেটা আসলে আমার সন্তান না । এজন্য বাচ্চা নষ্ট করাতে চাই ।
- স্ট্রেঞ্জ !! আপনার সন্তান না সেটা আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন ?
- আমি মাঝখানে দেশের বাইরে ছিলাম । প্রায় ১৫ দিনের বেশি । বিদেশে থেকেই জানতে পারি আমার ওয়াইফ একজনের সাথে পালিয়ে বান্দরবান চলে গেছে । এরপর যখন দেশে আসি তার পরের মাসে শুনি সে প্রেগন্যান্ট । তাহলে এই বাচ্চা কিভাবে আমার হয় বলেন ?
- ঘটনা এটুকু শুনে আমি পুরাই তাজ্জব । বললাম, আপনি সব জেনেও আপনার ওয়াইফ কে কেন ডিভোর্স দিচ্ছেন না বলুন তো ?
- আমার বাড়ি নারায়নগঞ্জ । বাবা প্রভাবশালী লোক । আমার শশুরও ওই এলাকার প্রভাবশালী লোক । আমি ডিভোর্স দিলে আইনি জটিলতায় ফেলে দিবে আমার শশুরবাড়ির লোকেরা ।
- বিয়ে হয়েছে কত বছর ?
- ৫বছর ।
- খুব আশ্চর্যের সুরে বললাম, এই পাচ বছর আপনি সংসার কিভাবে করলেন ?
- এর মাঝখানে আমার ওয়াইফ আরো বেশ কয়েকবার অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছিল । অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ফেরত এনেছি । আসলে ভালবাসার বিয়ে তো !
- লোকটির কথা শুনতে শুনতে আলট্রাসনো রিপোর্টে হাত দিলাম । রিপোর্ট দেখেই আমার চোখ ছানা বড়া । বললাম, পেটে বাচ্চার বয়স ৬মাস প্লাস হয়ে গেছে । এই বাচ্চা কোণভাবে মুখে ওষুধ খাইয়ে নষ্ট করা সম্ভব না ।
- ম্যাডাম দেখেন না এমন কোন ওষুধ আছে কিনা !
(হঠাত মনে হল লোকটির সাথে এত কথা বলছি অথচ যার বাচ্চা নষ্ট করাবে সেই মহিলাই তো আসেনি । আর সাথে আরো দুজন যে লোক বসে তারাই বা কে ? )
জিজ্ঞেস করাতেই প্রথমজন হাসি মুখে জবাব দিল ওই দুজন তার আপন ছোট ভাই । আর তার ওয়াইফকে আনেনি কারণ তার ওয়াইফ বাচ্চা নষ্ট করতে চাইনা । যা করার গোপনে করতে হবে ।
ঘটনাতে মজা পেলাম কিছুটা । যদিও নারায়ঙ্গঞ্জ শুনে একটি ভীতও হলাম । এবার বললাম,
- দেখেন ভাই, এই বাচ্চা এখানে নষ্ট করা যাবেনা । প্রথমত বাচ্চা পেটের মধ্যে অনেক বড় হয়ে গেছে । তারউপর বাচ্চার মা রাজি না । বাচ্চার মায়ের কনসেন্ট ছাড়া নষ্ট করলে অনেক বড় আইনি জটিলতায় পড়তে হবে । তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল বাচ্চা এভাবে নষ্ট করা খুব গুনাহ ।
- আইনি জটিলতা আমি ম্যানেজ করব । আর যত টাকা লাগে আমি দিব ম্যাডাম । আপনি কেবল কাজটা করে দিন ।
- স্মিত হাসি দিয়ে বললাম , দেখেন ভাই আপনি আইনি জটিলতার ভয়ে এরকম ওয়াইফের সাথে আপনি ৫বছর সংসার করে আসছেন, ডিভোর্স দিতে ভয় পাচ্ছেন । সেই আপনাকে কোন ভরসায় ক্লিনিক কতৃপক্ষ ভরসা করবে ? ততক্ষনে আমার ডিউটি টাইম শেষ । আমি ঘড়ি দেখে বের হবার জন্য তাড়া করছি ।
- ঠিক আছে ম্যাডাম, তাহলে আপনার সাথে এটা নিয়ে আবার বসব আমি ।
আমার তখন ছেড়ে দে মা কেন্দে বাচি অবস্থা । ক্লিনিকের মালিক দিদিকে বললাম, এই কেইস আমি ডিল করবনা । আপনি যেভাবে পারেন রেফার্ড করবেন । দিদি দেখলাম কিছুটা নিমরাজি টাইপ অবস্থা ।
পরে ভাবলাম, ক্লিনিকে আমি কোন পাওয়ার খাটাতে পারবনা । এখানে টাকা দিলে সব ওকে হবে । আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম এই ক্লিনিক চাকরি আর না । কয়েকটা শিডিউল ডিউটি শেষ হলেই আমি বাচি ।
কিন্তু ঘটনা তখন আসলে শুরুই হয়নি সেটা বুঝলাম পরদিন সকালে ।

৩য় দিন
১ম জনঃ ম্যাডাম, আপনার জন্যই অনেকক্ষন ওয়েট করছি ।
- আমার জন্য ওয়েট করার কি আছে । ডিউটি ডাক্তার আর কেউ ছিলনা ?
- না আসলে আপনার সাথে বলেই বেশি স্বাচ্ছন্দ ফিল করছি । মুখে ওষুধ ছাড়া আর কি উপায়ে বাচ্চা নষ্ট করা যায় ?
- স্যালাইনে ওষুধ দিয়ে কৃত্তিম লেবার পেইনের মাধ্যমে ।
- আমি তো গত ৩মাস ধরে আমার ওয়াইফকে এন্টাসিড সিরাপের মধ্যে সাইটোমিস ওষুধ গুলিয়ে খাওয়াচ্ছি । এতে কেন কাজ হল না ?
- কি বলেন? ৩মাস ধরে সাইটোমিস খাওয়াচ্ছেন? এটা খাওয়ানোর বুদ্ধি কার কাছে পাইলেন?
- ফার্মেসির লোকেরা বলল, এটা খাওয়ালে নাকি বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায় । কই বাচ্চা তো নষ্ট হল না !
- প্রথম তিনমাস খাওয়াননি তো তাই নষ্ট হয়নি । যাইহোক ,ভাই যা হবার হয়ে গছে । আপনার ওয়াইফ কে ৫বছর এভাবে সহ্য করতে পারলে, নিষপাপ মাসুম বাচ্চা আর কি দোষ করল বলেন ? মেনে নিয়ে শান্তিমত সংসার করেন ।
- মেনে তো নিতাম । কিন্তু পেটের বাচ্চা তো ছেলে । পরে আবার আমার সম্পত্তির ভাগিদার হবে । যেখানে আমার বাচ্চা না, সেখানে কেন তাকে আমি সম্পত্তির ভাগ দিব ? আর শান্তিমত সংসারের কথা বলছেন ? ওটা আর হবেনা । আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব । কিন্তু এই বাচ্চা নষ্ট না করে যেতে পারছিনা ।
- কেন কেন ??
- প্ল্যান ছিল, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরবনা । কিন্তু এই বাচ্চাই সব ঝামেলা বাধাল ।
- কিভাবে ?
- বুঝলেন না ! আমি বিদেশে গেলে তো আমার শশুর বাড়ির লোকেরা এই বাচ্চা নিয়ে মামলা করতে যাবে ? অনেক অনেক ব্যাপার আছে ,সব বলে বুঝানো যাবে না । শুধু এই বাচ্চা নষ্ট করলেই আমি খালাস ।
- বললাম, এই বাচ্চা তো আপনার না । আপনার ভয় কিসের ? যদি মামলা করে তাহলে আপনি সুযোগ পাবেন প্যাটার্নিটি টেস্ট করে আপনার মিথ্যা পিতৃত্বের সমুচিত জবাব দিতে ।
- মামলা করলেই তো আমাকে জেলে ঢুকাবে ।
- কয়েকটা দিন জেল খাটলে কি আসে যায় বলেন !
- আমার বিরুদ্ধে আসলে আরো অনেক কেইস আছে, একবার জেলে ঢুকলে আমি অন্য কেইস নিয়ে ফেসে যাব ।
এমনিতেই আমি এসব ফালতু ব্যাপার ডিল করতে চাইনি । কিন্তু কিঞ্চিত ভয় পেয়ে এতক্ষন ধরে উনার কথা শুনতে হয়েছে । এবারের কথা শুনে আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম । গতদিন ক্লিনিক মালিকের কাছে শুনলাম ক্লায়েন্ট নাকি এলাকার প্রভাবশালী মাস্তান । সুতরাং বুঝে শুনে সেভাবে ব্যাপারটা মিমাংসা করতে হবে ।
সেদিনের মত ডিঊটি ইস্তফা দিয়ে আসলাম ।

৪র্থ দিন
- ম্যাডাম বললেন না তো কিভাবে আমাকে আপনি সাহায্য করবেন?
- দেখেন ভাই , একমাত্র ন্যাচারালি এবরসন ছাড়া এই বাচ্চা মুখে ওষুধে নষ্ট হবেনা ।
- ন্যাচারালি এবরশন বলতে কি বুঝাচ্ছেন ?
- এই ধরেন বাথরুম থেকে স্লিপ কেটে পড়ে গেল কিংবা সিড়ি থেকে পড়ে গেল এরকম ।
- আচ্ছা, এর আগে তো আমি এরকম ট্রাই করেছিলাম । বাথরুমে সাবানের ফোম দিয়ে স্লিপারি করে রেখেছিলাম । পড়েনি । বাইকে করে ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করেছিলাম । বাইক থেকে পড়েও তার কিছু হয়নি ।
- তাহলে আর কি ! আমার কাছে আর কোন ওয়ে নাই ।
- আচ্ছা বাচ্চা হবার পর পর বাচ্চা কে মেরে ফেলা যায় না ?
- শুনেই আকাশ থেকে পড়লাম । কি বলেন আপনি ? এরপর অবশ্য মনে মনে ভাবলাম জীবনে কয়টা মার্ডার করেছে আল্লাহই জানে । শুধু শুধু তো আর প্রভাবশালী গুন্ডা হয়নি ।
- দেখেন আমি খুব নিরুপায় । আমাকে সাহায্য করলে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব ।
- আচ্ছা, একটা ব্যাপার ক্লিয়ার হতে পারছিনা । আপনি বললেন শুধু বাচ্চার জন্য আপনি দেশের বাইরে যেতে পারছেন না । কেন আপনার ওয়াইফ কি আপনি বিদেশে পালিয়ে গেলে বিয়ের কাবিন নিয়ে মামলা করতে পারবে না ?
- বিয়েই তো করিনি, কাবিন আসবে কোথা থেকে ? স্যরি, আসলে আপনাকে সত্য বলতে দ্বিধা নেই । তাই সব স্বীকার করেই ফেললাম ।
- মানে এই ৫বছর বিয়ে ছাড়াই সংসার করেছেন । তার মধ্যে আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আরো কয়েকবার অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে ।
- আসলে সে অনেক লম্বা ইতিহাস । মেয়েটা তখন নেশা করত । এই আমি তাকে নেশার জগত থেকে ছাড়িয়ে এনেছি ।

এটুকু বলার পর আমার আর শুনার রুচি হলনা । বললাম, ভাই আপনি যা কিছুই করতে চান আপনি ক্লিনিক মালিকের সাথে কথা বলেন । এটা সমাধান করা আমার এখতিয়ারের বাইরে ।
পরে আর ওই ক্লিনিকে যাওয়া হয়নি । যারা উপরের লেখাটা পড়ে ভাবছেন আমি এই ঘটনার জন্য ক্লিনিক ছেড়ে দিয়েছি তবে ভুল ভাবছেন । উপরের ঘটনাটা ছিল সেই গাধার উপর অর্পিত অগনিত বোঝা যার ফলে সামান্য খড়ের ভার সহ্য করতে না পেরে গাধা টা মারা গিয়েছিল ।

হুম , এরকম আরো বহু কেইস ক্লিনিকে ফেইস করেছি । ঘুনে ধরা সমাজের ঘুন গুলোকে প্রতিনিয়ত নিজ চোখে এভাবে প্রত্যক্ষ করেছি । যখন সমাজ আর এই ঘুনের ভার সহ্য করতে পারেনা তখন টি.এস.সি তে পহেলা বৈশাখে ঘটে যাওয়ার মত নির্লজ্জ, অবর্ণনীয় ঘটনা অবলীলায় ঘটে যায় ।

কোন মন্তব্য নেই: