মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১০

স্মৃতির পর্দায় বন্দী করে রাখা কিছু মুহূর্ত…

স্মৃতির পর্দায় বন্দী করে রাখা কিছু মুহূর্ত…

স্টার কাবাবে প্রায় ৯/১০ জনের মত বসে খাচ্ছিলাম। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে লাঠি হাতে জীর্ন-শীর্ণ এক বৃদ্ধ ফকিরকে দেখা গেল। দেখা মাত্রই তিঁনি উঠে গেলেন। নিজ হাতে তাকে পিৎজা খাওয়ালেন, কোক দিলেন। সবচেয়ে নতুন ৫০টাকার একটা নোট দিলেন বেছে বেছে। অবাক হয়ে দেখছিলাম এই দৃশ্যটা। কিন্তু আমার অবাক হবার যে আরো বাকি ছিল সেটি তখনও বুঝতে পারিনি।
স্টার কাবাব থেকে বের হলাম সবাই। তিঁনি চিন্তা করছেন সবাই কিভাবে বাসায় যাবে? অতঃপর সবার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে তাদের যাবার ব্যবস্থা করলেন। এরপর বাকি ছিলাম আমি,যুথি আর মামুন। আমাদের জন্য একটি ট্যাক্সি ক্যাব ঠিক করে নিজে সি.এন.জি করে রওনা দিলেন।
গন্তব্য আমাদের মোহাম্মদপুর, তাঁর বাসায়। বিশেষ আতিথেয়তায় তিঁনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার বাসায়। বয়সে অনেক অনেক সিনিয়র হবেন, তবুও মনে হচ্ছিল আমাদের অন্তরংগ বন্ধুর মত। রাস্তা জুড়ে মনে আরো অনেক জল্পনা-কল্পনা করছিলাম। অবশেষে উঁনার বাসায় পৌছলাম।
দীর্ঘ বছর প্রবাস জীবন অতিবাহিত করছেন। প্রায়ই দেশের টানে, দেশের মানুষের টানে জন্মভুমিতে ফিরে আসেন। এখনও তাই কানাডা ফিরে যাবার ডেইট পার হয়ে গেলেও দেশে রয়েছেন শুধু দেশের মানুষের টানেই। বাসায় থাকে তাঁর মা ও ভাবি। খুব অনাড়ম্বর জীবন-যাপন তাঁর। রাস্তা-ঘাটে দুঃখি-গরীব মানুষের জন্য যে নিঃশর্তে ক্রমাগত দান করতে থাকে তাঁর জীবন-যাপন অনাড়ম্বর হবে এটাই স্বাভাবিক। একসাথে বসলাম, বিভিন্ন কথা শেয়ার করলাম। সবচেয়ে অবাক হলাম যেকথা শেয়ার করার জন্য মানুষ খুজে পাচ্ছিলাম না মনে হলে আল্লাহ আমাদের নিজে তাঁর সন্ধান দিলেন। খুব প্রাঞ্জল একটা আলোচনা করলাম আমরা সবাই।
জোহরের নামাজ শেষে আবার একসাথে বসলাম ফ্লোরে এক মাদূরে। সোফা ছিল কিন্তু উনার ফেবারিট প্লেস ফ্লোর। আমার মনে হচ্ছিল রাজকীয় কোন স্থানে বসে আছি। আসলে মনের প্রাচুর্যর কাছে পার্থিব সবই যে হার মানায় সেটা খুব গভীরভাবে অনুভব করলাম।
দুপুরের খাবারের জন্য প্রস্তুতি নিলেন তিঁনি। সব কিছু নিজ হাতে করলেন। আতিথেয়তায় যে তিঁনি অনন্য সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
একজন ড্রাগ এডিক্টেড মানুষের জীবনের মোড় কিভাবে ঘুরে যায় ল্যাপটপে বসে তিঁনি আমাদের সেটাই দেখাচ্ছিলেন। একবার ল্যাপটপে আরেকবার তাঁর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। এত সুন্দরভাবে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রতিটা কথার জবাব অদ্ভুত লাগছিল। অনেক ঘটনা বললেন। একটি ঘটনা শুনাই...
জাহাঙ্গিরনগর ইউনিভার্সিটি একবার এক ছেলের সাথে কথা হচ্ছিল উঁনার। ছেলেটি নাস্তিক ছিল। তাই উনাকে প্রশ্ন করলেন “ আচ্ছা আল্লাহ দেখতে কেমন?” জবাবে তিনি হাসতে হাসতে বললেন “ ভাই তুমি বিয়ে করবানা আবার কনে কিরকম তা জানতে চাও কেন?” জবাবে ছেলেটি কিছুই বুঝলনা। পরে উনি ব্যাখ্যা করলেন “ তুমি তো আল্লাহ কে বিশ্বাস করনা তাইলে আবার জানতে চাও কেন যে আল্লাহ দেখতে কেমন” এই জবাবে ছেলেটি তাৎক্ষনিক জবাব দিল “ ধরেন আমি বিশ্বাস করি এবার বলেন আল্লাহ দেখতে কেমন?” না না ভাই, কোন ধরাধরিতে আমি নাই,যদি বিশ্বাস করেন তাইলে বলতে রাজি আছি।
এবার ছেলেটা বাধ্য হয়ে বলল “ হ্যা আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আছে” এই জবাবে খুশি হয়ে তিনি বললেন “ যিনি ক্ষুদ্র পিপড়া সৃষ্টি করেছেন, তিনি বৃহৎ হাতি সৃষ্টি করেছেন, আবার তিনিই তোমারে আর আমারে সৃষ্টি করেছেন, এখন তিনি দেখতে কেমন হবে সেটা বাড়ি বসে তুমি চিন্তা কর, উত্তর পেয়ে যাবা”…কি এন্সার!!!!
এটিএন বাংলায় অনেক পুর্বে থেকে তাঁর প্রোগ্রাম দেখে রীতিমত আমি তাঁর ভক্ত ছিলাম। তাঁর বাসায় তাঁর ল্যাপটপে বসে তাঁর জীবন ইতিহাসের কিছু অংশ দেখছিলাম এটা চিন্তা করেই খুব আজব লাগছিল।
কিভাবে যে ঘড়ির কাটা দ্রুত চলে যাচ্ছিল বুঝতেছিলামনা। আসরের নামাজের পর কিছু কাজের প্ল্যানের পর তাঁর বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তায় কিছু দূরে ৩/৪ জন ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল,কেউ মোবাইলে কথা বলছিল। অনেক দূর থেকে তাঁর সালাম শুনেই ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে গেল। হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করল। মুদি দোকানদার , সেলুনের লোক, আশেপাশের বাড়ির দারোয়ান, রিকসাওয়ালা, সি.এন.জিওয়ালা কেউ তার সালামের জবাব হাসিমুখ ছাড়া দেয়নি। রাস্তায় এক ফকিরের সাথে দেখা হয়। তাকে তিঁনি সালাম দিয়ে নতুন টাকার নোট দিলেন। বৃদ্ধ খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে দোয়া দিতে চাইল। কিন্তু উনি হাত নয় বৃদ্ধকে বুকে জড়িয়ে তার প্রতিউত্তর দিলেন। আমি দেখছিলাম, ভাবছিলাম...মনে হচ্ছিল রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাতের কিছু অংশ প্র্যাকটিক্যাল দেখছি যা এতদিন থিওরিতে পড়েছিলাম।
অবশেষে সি.এন.জি ঠিক করে ভাড়া মিটিয়ে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করলেন। আসার সময় প্রতিটা মুহূর্ত তাকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আমার ভাই কখনও কোথাও গেলে বেশিক্ষন থাকতে পারেনা আমাদের সাথে। সেদিন সে সারাদিন ছিল,একটুও বোরড হয়নি। বাস্তবিকই মনে হল এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান তাকে বলেছিলেন “ কত ডিগ্রিওয়ালা হুজুরদের এটিএন বাংলায় প্রোগ্রাম করতে দিলাম। তাদের কথা বার্তা এত টানেনি আপনি কি বলেন সবই তো মন ছুঁয়ে যায়” মানবতাবোধ কে যে ইসলামের মেইন পার্ট মনে করে ইসলামের দাওয়াহ দিচ্ছে তার কথা শুনলে যে কারো মন ছুঁয়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নাই।
সন্ধ্যার কিছু পর বাসায় ফিরলাম। মনে হল এতক্ষন কোন মোহের ভিতর ছিলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম কিছুক্ষন পর। অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শে থেকেছি, অনেক ইসলামপন্থী মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সাথে মিশেছি, অনেক বন্ধুর সাথে সময় পার করেছি কিন্তু সম্বিত ফিরে আসার পর মনে হল,
এতক্ষন যাঁর সাথে ছিলাম তার জ্ঞানের প্রাচুর্য হাজার হাজার ডিগ্রিকেও হার মানায়...মানবতাবোধ যাঁর প্রকৃত ধর্ম তথাকথিত ইসলাম্পন্থীরা তার সামনে লজ্জা পাবে...সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে যে অভ্যস্ত এবং রাস্তার ফকিরদের বুকে জড়িয়ে ধরতে যে কুন্ঠাবোধ করেনা তাঁর সামনে অহংকারি উচ্চবিত্তদের প্রেস্টিজ চলে যাবে বৈকি!...আর বন্ধু? সমবয়সী অনেক ইন্টিমেইট বন্ধুর থেকেও তিনি হতে পারে যেকোন বয়সের,যেকারো প্রকৃত বন্ধু......

৩টি মন্তব্য:

HJKL বলেছেন...

ইসলাম মানেই যে মানবতা এটা অনেকেই মানতে চায়না। আসলে মানতে চায়না নাকি জানেনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন!!!!

নিজেকে যদি কখনো মানবতার জন্য বিলিয়ে দিতে পারি, তখনই আমার জীবন হবে সার্থক!!!!..... :"(

সাবিনা বলেছেন...

আসসালামুয়ালাইকুম,
কে এই মানুষ? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আপনার লেখাটাও সুন্দর। জযাকাল্লাহ খাইর!!

রেইন স্পট বলেছেন...

thnks for ur comment. niche link diye dilam.


http://www.muslimville.tv/Channel2/Video433/